যেখানে অহরহ স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে
লিখেছেন লিখেছেন সুঘ্রাণ কাদের ২৩ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:০২:১৮ সন্ধ্যা
অনেক আগে থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা লাভে ব্রিটেনে আসছে। এখনও দলে দলে শিক্ষার্থীরা পড়তে ব্রিটেনে আসছে। বিদেশ থেকে বিলেতে পড়তে আসা এই ছাত্রদের সংখ্যা কখনও কমেনি। যারা এখানে পড়তে আসে, তাদের মনে থাকে অনেক স্বপ্ন। অতীতে যারা এসেছিল, তাদের বেশিরভাগ নিজেদের স্বপ্নের পথে হাঁটতে পেরেছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে সবাই কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমানে ব্রিটেনে বিদেশ থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা চরম অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করছে। ব্রিটেনে সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনোকালেই বিদেশী ছাত্ররা এরকম দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়নি। বিশেষ করে ব্রিটেনে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্ররা এখন কঠিন সময় পার করছে। দিন দিন তারা সমস্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। এই দুঃসহ দুঃস্বপ্ন থেকে যেন তাদের কোনো মুক্তি নেই। একের পর এক ইমিগ্রেশন আইন কড়াকড়ি, কলেজ বন্ধ, কাজের অনুমতি সীমিতকরণ এবং প্রতিনিয়ত বিদেশী ছাত্র ধরতে পুলিশের ব্যাপক রেইড। এসব শিক্ষর্থীদের অনেকেই বিদেশে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই প্রতারণার শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
কেস স্টাডি (১) : মেহেদি (ছদ্মনাম)। ২০০৮ সালে দেশের একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। তারপর পোষ্টগ্রাজুয়েট করার জন্য স্বপ্নের দেশ যুক্তরাজ্যে আসেন। দেশে থাকতেই এজেন্টের কাছে ভিসা লেটারে উল্লেখিত ১৫০০ পাউন্ড পরিশোধ করেন। লন্ডনে আসার পর কলেজ রিসেপশন থেকে বলা হলো, তারা অফার লেটারে লেখা কোনো অর্থই তারা রিসিভ করেনি। কিন্তু অর্থ রিসিভ না করে পেইড লেখার কারণ না বলে তার নগদ এক হাজার পাউন্ড পরিশোধ করতে বলে। না হয় কলেজ থেকে বের করে দিবে বলে হুমকি দেয়।
কেস স্টাডি (২): আজাদ (ছদ্মনাম) এইচএসসি পাশের পরই বিদেশ আসার স্বপ্ন দেখে। লন্ডনে আসার পরপরই তার কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। আজাদের মাথায় যেন বাজ পড়ে। দেশে থাকতেই সে পুরো এক বছরের টিউশন ফি প্রদান করে এসেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো অর্থই ফেরত দেয়নি। এখন ইমিগ্রেশন আইনে তাকে ৬০ দিনের মধ্যে অন্য কলেজে ভর্তি হতে হবে। তার পরিশোধিত টিউশন ফি’র ব্যাপারে হোম অফিসের কোনো নির্দেশনা নেই। নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিন মাসের মাথায় আবার কলেজ বন্ধ। তার ছাত্রজীবনের স্বপ্ন এখানেই শেষ। আজাদ আইটিতে পড়তে যুক্তরাজ্য এসেছিলো।
কেস ষ্টাডি (৩) : শওকত (ছদ্মনাম) মধ্যবিত্ত পরিবারের জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছেলে। গ্রাজুয়েশন করতে যুক্তরাজ্য এসেছে। দেশী এজেন্টের প্রতারণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে কলেজে ভর্তি হয়েছে। একদিন হঠাৎ করে তার কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের আশা ও স্বপ্নকে মাঠিচাপা দিয়ে সে দেশে ফিরে যায়।
কেস ষ্টাডি (৪): জাফরের (ছদ্মনাম) যুক্তরাজ্য আসার পর সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু দ্বিতীয়বার ভিসা বাড়াতে গিয়ে ইংলিশ টেষ্ট দিতে এক পরিচিত বড় ভাইয়ের পরামর্শ নেয়। এই পরামর্শ গ্রহণ তার জীবনের জন্য কাল বয়ে আনে।
বড় ভাই তাকে ভুল পরামর্শ দেন। তিনি জাফরকে ইংলিশ টেষ্ট টোয়েক দিতে বলেন। যা হোম অফিসের অনুসন্ধানে জাল প্রমাণিত হয়েছে। পরিণামে হোম অফিস আপিল রাইট না দিয়ে তাকে রিফিউজ করেছে। এখন সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
উল্লেখিত ঘটনাগুলোর একটির সাথে হয়তো আরেকটির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সবাই এখানে ভুক্তভোগী এবং ঘটনার শিকার। কলেজ কেন বন্ধ হচ্ছে? কেনইবা তাদের জরিমানা করা হচ্ছে? এসব কোনো খবর কেউই জানে না। এ ঘটনাগুলোতে অসহায় হয়ে পড়ছে বাংলাদেশসহ তৃতীয়বিশ্ব থেকে আগত অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। তাদের শিক্ষাজীবন শিকেয় উঠেছে। টিউশন ফি প্রদান করে বারবার তারা প্রতারিত হয়েছে। হোম অফিসের হাইলি ট্রাস্টেড কলেজে ভর্তি হলেও নিশ্চয়তা কেউ পাচ্ছে না। কখন কলেজ পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। আর সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বিকৃত মস্তিষ্কের কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ। ছাত্রছাত্রীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তারা তাদের নূন্যতম মজুরী না দিয়ে কলুর বলদের মতো খাটাচ্ছে।
যারা ছাত্রদের সাথে এরকম আচরণ করছে, তাদের অধিকাংশই আবার বাংলাদেশী। তারা আপন দেশের ভাইদের সাহায্য না করে কঠোর পরিশ্রম করাচ্ছে। এই উচ্চবিত্তরা সবাই যেন এক অসম প্রতিযোগীতায় লিপ্ত। নানামুখী হেনস্তার মুখোমুখি হয়ে ছাত্রদের অনেকেই এখন দেশ অথবা ইউরোপের অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
ছাত্রদের এই করুণ দশার জন্য মূলত দায়ী দেশের একশ্রেণীর কলেজ এজেন্টরা। তারা দেশে ছাত্রদের সুন্দর সুন্দর কথা বলে। বিলেতী কলেজের চটকদার ওয়েবসাইট দেখায়। এভাবেই প্রতারণা শুরু হয়। যার পরিণাম ছাত্রছাত্রীদের কয়েক বছর ভোগতে হয়। দেশীয় এজেন্টদের সাথে আছে এদেশীয় কলেজের পার্সেন্টেজ বিজনেস। ফলে এজেন্টরা কোনো যাচাই-বাছাই না করে নামমাত্র কলেজ হলেই তাতে স্টুডেন্ট পাঠাচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপে প্রতারণা করে কলেজ মালিকেরা। বিদেশীদের পড়তে আসা ব্রিটেনের এসব কলেজের বেশিরভাগই ভিসা কলেজ। তারা কলেজের লাইসেন্স নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কখন তাদের প্রতারণার মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে। সুযোগ আসার পর তারা এটাকে পূর্ণভাবে কাজে লাগায়। নিয়মিত ক্লাশের ব্যাবস্থা না করে দায়সারাভাবে কাজ চালায়। যখন কলেজ বন্ধ হয়, তারা উধাও সবাই চিরতরে উধাও। যেসব ছাত্রদের পুরো টিউশন ফি’র অর্থ তারা গ্রহণ করেছে, তার কোনো সমাধান তারা করে নাই।
অনেক কলেজ তো বন্ধ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ লাইসেন্স ফিরে পাবার জন্য কোনো চেষ্টাই করেনি। ফলে কলেজগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক কলেজ তো বন্ধ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের থেকে টিউশন ফি’র অর্থ নিয়েছে। আদায়কৃত কোনো টিউশন ফি’র অর্থ তারা ছাত্রদের পরিশোধ করেনি। কলেজ মালিকরা সবাই বাঙ্গালী কোটিপতি। তাদের হীন মানসিকতার কারনেই ছাত্ররা এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে একশ্রেণীর অর্থলিপ্সু মানুষ ন্যায় অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে জাল সার্টিফিকেট করেছে। যা হোম অফিসের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে। যদিও ইংলিশ টেষ্টের জন্য ছাত্ররা দায়ী নয়, কিন্তু হোম অফিস শুধুমাত্র ছাত্রদেরকেই শাস্তি দিচ্ছে। শাস্তির সম্মুখীন হয়ে অনেকে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছে। অনেকেই অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করছে। ছাত্রদের সকল সমস্যার জন্যে শুধু ছাত্ররাই এককভাবেই দায়ী নয়। আমাদের অনেকেরই লোভী মানসিকতা তাদেরকে বারবার বিপদে ফেলছে।
এখন কথা হলো, কমিউনিটির লোকেরা ছাত্রদের এই নাজুক সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে নিরাপদ থাকতে পারেন না। ছাত্রদের অনিরাপদ গন্তব্য আমাদের জাতিসত্বাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে নিঃসন্দেহে। তাই সময় এসেছে, অসহায় ছাত্রদের পাশে দাঁড়াবার। তাদেরকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার। আইনজীবিদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। হোম অফিসের অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আইনী চ্যালেঞ্জের পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের জাতির প্রত্যেকটি মানুষের জন্যে আমাদেরকে কল্যাণকর কিছু নিজস্ব অবস্থান থেকেই করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১০১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন