শাহবাগের কথায় রায় দেয়া হলে ট্রাইব্যুনালের আর প্রয়োজন কি?
লিখেছেন লিখেছেন তাহাবীতাহাপিন ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০১:৫৫:৪৩ দুপুর
গত মঙ্গলবার বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সভা ও সমাবেশ করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিল জামায়াতে ইসলামী। যথাযথ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসন সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। জায়ামাতকে সভা করার অনুমতি না দেয়ার প্রতিবাদে মতিঝিল, বাংলামটর ও পান্থপথসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে জামায়াতে ইসলামী প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এসব মিছিলে বিনা উস্কানিতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ফলে অন্তত ২০জন আহত হয়। এ ছাড়াও পুলিশ আরো ২০ জন শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। অথচ এরই পাশাপাশি তথাকথিত নিরপেক্ষ যুব সমাজের নামে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী তরুণ-তরুণীদেরকে নির্বিঘেœ সমাবেশ করার সুবিধা দেয়ার জন্য শাহবাগ চত্বর থেকে সরকার প্রায় ১ মাইল রেডিয়াস এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। যান চলাচল বন্ধ করে এই বিশাল নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে পুলিশ যেমন শাহবাগে জমায়েতের নেতাদেরকে প্রটেকশন দিচ্ছে তেমনি সমাবেশের অভ্যন্তরে অর্থাৎ শাহবাগ চত্বরে র্যাব এবং পুলিশ তাদেরকে নিñিদ্র নিরাপত্তা দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়। নির্বাচন কমিশনে তারা নিবন্ধিত দল। জাতীয় সংসদেও রয়েছে তাদের প্রতিনিধিত্ব। একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে একটি ফ্যাসিষ্ট শাসক গোষ্ঠী যে রকম দমন পীড়ন চালায়, জামায়াতে ইসলামী এবং শিবিরের বিরুদ্ধে তার চেয়েও বেশি এবং আরো বিভৎস দমন পীড়ন চালাচ্ছে সরকার। শাহবাগের জমায়েতকে দল নিরপেক্ষ তরুণ-তরুণীদের সমাবেশ বলে প্রচারণা চলানো হলে প্রথম দুই একদিন সরলমনা সাধারণ মানুষ সেই মতলবী প্রচারণায় বিশ্বাস স্থাপন করে বিভ্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। আওয়ামী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী মিনিস্টারদের সূত্রে জানা গেছে যে, খাওয়া থাকা নাস্তাসহ সব রকম খরচ আওয়ামী সরকার চালাচ্ছে, তবে নেপথ্য থেকে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়, দলীয় পর্যায় এবং হাই কমান্ড, অনেক ধনবানদেরকে এই সমাবেশের খরচপত্র চালাবার হুকুম দিয়েছেন! যেখানে শুধুমাত্র এক বেলা ভাত খেতেই লাগে কোটি টাকা সেখানে দুই বেলা ভাত এবং এক বেলা নাস্তা আসছে দেদারসে অথবা সে সবের খরচ বহনের জন্য টাকাও আসছে দেদারসে। হাজার হাজার মানুষের মল মূত্র ত্যাগের জন্য সরকার মোবাইল টয়লেটের ব্যবস্থা করেছে। এ ভাবে একটি সমাবেশকে সরকার দিচ্ছে সর্বাত্মক সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা! অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামীকে সরকার চেঙ্গিসখান এবং হালাকু খান স্টাইলে দমন করছে।
একটি বিচারের আর্তনাদ
সারা পৃথিবীর বাঙ্গালীরা একটি কথার সাথে পরিচিত। সেটি হলো, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। বাংলাদেশে তেমন একটি বিচারের নাম ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার’ বা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার। এই বিচার কাজ পরিচালনার জন্য ১ নম্বর ও ২ নম্বর মিলে ২টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। গত মাসের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামে গঠিত ২ নম্বর ট্রাইব্যুনাল মওলানা আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিস্টরা ‘মারহাবা’ ‘মারহাবা’ বলে ট্রাইব্যুনালের বিচারকে সাধুবাদ দিয়েছে এবং আনন্দ উল্লাসে মিস্টান্ন বিতরণ করেছে। যারা মওলানা আযাদের মামলার রায় দিয়েছিলেন সেই একই বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ তিনজনের ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার মামলারও রায় দিয়েছেন। কিন্তু কাদের মোল্লার রায় মৃত্যুদণ্ড না হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার সাথে সাথেই রায়টি বিতর্কিত হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট ও আওয়ামী ঘরানার লোকজন বলেন যে তারা হতাশ। কারণ তারা চেয়েছিলেন মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড হলেই সেটি সবচেয়ে ভালো রায় হচ্ছে, আর তার এক ধাপ নিচে, অর্থাৎ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেই সেটি খারাপ রায় হচ্ছে। তাহলে এটি কোন ধরনের বিচার?
সুতরাং তরুণ সমাজকে
নামিয়ে দেয়া হলো
তারা দাবি তুলেছে, আসামির কাঠগড়ায় যাদেরকে দাঁড় করানো হয়েছে তাদের সকলকে ফাঁসি দিতে হবে। এমন অদ্ভুত আবদার পৃথিবীর কোথাও কেউ কোনো দিন শুনেছেন বলে জানা যায়নি। আওয়ামী লীগ ঘরানার দাবি হলো, সকলকেই ফাঁসি দিতে হবে। তাহলে আর তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে কেন? জামায়াতে ইসলামী নেতাদেরকে টপাটপ ধরে গলায় দড়ি পরিয়ে দড়ির অবশিষ্টাংশ ধরে টান মারলেইতো সব শেষ হয়ে যায়। তাহলে আর এতো বিচার আচার, শুনানি, সওয়াল-জওয়াব, স্বাক্ষী-সাবুদের প্রয়োজন কি? তাহলে এই ট্রাইব্যুনাল গঠনেরই বা প্রয়োজন কি? ওরা ট্রাইব্যুনালের একটি আদেশ মানবেন, আর আরেকটি আদেশ মানবেন না, এমন ডবল স্ট্যান্ডার্ড কি বিচার বিভাগে চলতে পারে?
কার ডিক্টেশনে চলবে? শাহবাগের?
না আইন-কানুনের?
শাহবাগ থেকে বলা হচ্ছে যে ফাঁসি না নিয়ে তারা ফিরে যাবেন না। তাদের আবদার পূরণ করে ফাঁসি দেয়ার জন্য সরকার আইন-আদালতের বিধানাবলীও পরিবর্তন করছে। কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এখন সেই যাবজ্জীবনের সংশোধন করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। সেটি করতে হবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। কারণ ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ। যদি তাই হয় তাহলে সেটি একটি ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে থাকবে। এটি করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে। ইতোমধ্যেই সেই সংশোধন মন্ত্রিসভায় পাস হয়ে গেছে। এখন জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাবটি পাস হলে এটি দেশের আইনে পরিণত হবে। তাহলে ব্যাপারটি এই দাঁড়াচ্ছে যে আইন-কানুন এবং ন্যায় বিচার এগুলো শুধুই বাত্ কি বাত্। আসল কথা হলো, আওয়ামী লীগ সরকার এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে একটি মাত্র কাজ করার জন্য। আর সেটি হলো জামায়াতের সব নেতাকে ফাঁসি দেয়া। যখন কাদের মোল্লার ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন হলো তখন তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সে জন্য রায় ঘোষণার পরদিন অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগ চত্বরে নেমে আসে কতিপয় তরুণ, পেশাজীবী, ব্লগার এবং ছাত্রছাত্রী। তাদের এক কথা, যাবজ্জীবনের রায় তারা মানে না। তাদের একমাত্র দাবি হলো শুধু মাত্র কাদের মোল্লা নয়, সমস্ত আসামীর ফাঁসি দিতে হবে।
কিন্তু কোন পথে?
আইসিটির আইন বলছে, সরকার পক্ষের আপিল করার সুযোগ নাই। আসামি পক্ষের কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবনের রায় হয়েছে। কাদের মোল্লার ব্যাপারে ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালের কাজ শেষ। তাহলে তাকে ফাঁসি দেবে কে? অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রাষ্ট্র পক্ষ আপিল করতে পারবে রায়ের সেই অংশের বিরুদ্ধে যেই অংশে অথবা যে অভিযোগটি প্রমাণিত হয় নাই এবং যেই অভিযোগ থেকে তাকে খালাশ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু ট্রাইব্যুনাল যে অভিযোগে তাকে বেকসুর খালাশ দিল সুপ্রিম কোর্ট কি তাকে সেই একই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেবে? এটি সাধারণভাবে অবিশ্বাষ্য মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি!
সেদিন জাতীয় সংসদে বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিচারের রায় দেবে ট্রাইব্যুনাল। আইন দেখেই তারা চলবে। তারপরও তাদের অনুরোধ করব, মানুষের আকাক্সক্ষা, সেটাও তারা যেন বিবেচনায় নেন।’ এ ব্যাপারে ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য স্বাধীন বিচার ব্যাবস্থার জন্য হুমকি স্বরূপ। তার এই বক্তব্যের পর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এখানে আদৌ ন্যায়বিচার হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী জনআকাক্সক্ষার কথা বলেছেন। আইনের দৃষ্টিতে এই আকাক্সক্ষার কোনো মূল্য নেই। বিচারকরা আইনের বিধান এবং সাক্ষ্য প্রমাণ বিবেচনা করে রায় দেন। বিচার কাজে তারা স্বাধীন। এ অবস্থায় কোনো মহল থেকে দাবি করা আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞার শামিল। এখন সংশ্লিষ্ট বিচারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার করবেন না প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনবেন। তবে তারা যে রায়ই দেন, তা নিয়ে এখন বিতর্ক হবে। তাই ট্রাইব্যুনাল আবার নতুন করে গঠন করে আবার বিচারকাজ শুরু করা যেতে পারে। সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সম্পাদক এডভোকেট সাঈদুর রহমান বলেন, শাহবাগের আন্দোলনে ট্রাইব্যুনালের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। শাহবাগ থেকে যে দাবি ওঠানো হয়েছে, তা অগণতান্ত্রিক, অবৈধ ও সংবিধানবিরোধী। শাহবাগের এ আন্দোলন বিচার বিভাগ তথা আইনের শাসনকে সমূলে বিনাশ করে দেবে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ ও সরকারের প্রধান মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বলেছেন, সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়া হবে।
গত বুধবার আমার দেশে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের আর অস্তিত্ব থাকে না। নির্বাহী বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তিত্বের এ আহ্বান ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষ বিচার কাজের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, যা আইনের শাসনকে ধ্বংস করবে। কারণ তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিচারকদের তার আকাক্সিক্ষত রায় চেয়ে নির্দেশ (ডিক্টেট) করেছেন। ট্রাইব্যুনাল এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কিনা সংশয় হওয়া স্বাভাবিক। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা হাইকোর্টের বিচারপতি। তারা সংবিধান অনুযায়ী রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে ন্যায়বিচারের শপথ নিয়েছেন। এ অবস্থায় সারা দেশের মানুষও যদি আইনসিদ্ধ নয়, এমন রায়ের দাবি করে, বিচারকরা সে দাবি পূরণে বাধ্য নন। বিচারকরা বিচার করবেন আইন অনুযায়ী মামলার সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক মন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এক আইনজীবী বলেন, আইন চলে তার নিজস্ব গতিতে। বিচারকরা আইন মোতাবেক সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনা করে রায় দেন। এ অবস্থায় শাহবাগে কথিত যে আন্দোলন হচ্ছে, সেখান থেকে ফাঁসির যে দাবি করা হচ্ছে এরপর আর ট্রাইব্যুনালের অস্তিত্ব থাকে না। কী রায় হবে, শাহবাগ থেকে তার ডিক্টেশন (নির্দেশ) এলে এর চেয়ে বড় নৈরাজ্য আর কী হতে পারে?
ধন্যবাদান্তে, জামশেদ ভাই
সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
বিষয়: বিবিধ
১০৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন