ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করুন, নিরাপদ থাকবেন।

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১১ জুন, ২০১৭, ১১:০৯:৪৯ রাত



১৮৫২ সালের ২রা এপ্রিল, বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত দুইটা, দিল্লির লাল কেল্লার বিশাল লাহোর গেট দিয়ে এগারো বৎসর বয়সী যুবরাজ জওয়ান বখত-এর বিয়ের বরযাত্রী বের হলো। সে এক বিশাল লাট বহর। কি ছিল না সে বহরে? নবাবী জৌলুসের যেন কোন কমতী না হয় সে প্রচেষ্টর বিন্দুমাত্র বাঁকি রাখেন নি রাণী জিনাত মহল।

সেই ৩১ শে মার্চ সকালে মালাগড় থেকে জিনাত মহলের ভাই, আর আসন্ন শুভ বিবাহের দশ বৎসর বয়সী কনে নওয়াব শাহজামানী বেগমের বাবা ওয়ালীদাদ খাঁনের বাড়ী হতে বরের জন্য বিরাট বিরাট সোনার থালায় সাঁজানো উপঢৌকন আসার পর থেকেই পুরো রাজপ্রাসাদ জুড়ে বিয়ের আনন্দ; নাচ-গান, বাজনা, খানা পিনা শুরু হয়েছে, আর তা বিরতিহীনভাবে চলছে। বিখ্যাত কবি গালিব সহ প্রায় পঞ্চাশজন নামকরা কবি দিন রাত কবিতার আস চালিয়ে যাচ্ছে, নর্তকীরা নেচে চলেছে, শিল্পীরা সুর করে গান গাইছে।

দিল্লির প্রচন্ড গরমে দিনের বেলায় উত্তপ্ত সুর্যের নিচে রেশমী কাপড়ের ভারী পোশাক পর নবাব পরিবারের সদস্যগণ সহ বর যেন ঘামে ভিজে না যান, তা নিশ্চিত করতেই এই রাত দুটোর সময় বরযাত্রী বের হয়েছে লাট বহর সহ।

রাত্রী বেলা তো কী হয়েছে? সামনে পেছনে মশালবাহী শান্ত্রী, ছয়টি হাতির পিঠে স্বর্ণের কারুকাজ করা রেশমী কাপড় দিয়ে মোড়া হাওদা বসানো হয়েছে। মাথার উপরে প্রকান্ড ছাতা, একটু পরেই সুর্য উঠলে যেন কারো গায়েই রোদ না লাগে, তার জন্য। সেই ছাতার মধ্যেও রয়েছে নবাবী জৌলুসের ছাপ। মূল্যবান রেশমী কাপড়ের উপরে স্বর্ণের সুক্ষ কারুকাজ আর তারই মাঝে বসানো হয়েছে হীরা'সহ রক্তলাল রুবী পাথর।

বর সহ নবাবদের পরণে মহামুল্যবান পাথর বসানো জরিদার শেরওয়ানী, স্বর্ণের কারুকাজ আর হিরা-চুন্নির ঝকমকে রং চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। পাগড়ীর উপরে সামনের দিকে এমন কুশলী হাতে লাল রুবী বসানো হয়েছে যে, দুর থেকেও জ্বলজ্বলে সেই পাথরের রুপ ছিটকে এসে দর্শকের চোখে পড়ে, নজর এড়ানো যায় না চাইলেও।

এক হাতির পিঠে হাওদার উপরে আটাত্তর বৎসর বয়সী বৃদ্ধ নবাব বাহাদুর শাহ জাফর তার দেহরক্ষী পরিবেষ্ঠিতাবস্থায় আসীন। শরীরে বার্ধক্য ও ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠার পাশাপাশি তাঁর কপালে চিন্তার রেখা সুষ্পষ্ট।

হবেই না বা কেন? প্রবল প্রতাপশালী মোগল সাম্রাজ্য আর নেই। ১৭৫৭ সালে বাংলা হাতছাড়া হবার পরে এক এক করে ১৭৯৯ সালে মহিশুরের টিপু, ১৮০৩ সালে মারাঠারা আর ১৮৪৯ সালে শীখদের পরাজিত করে ইংরেজরা পুরো ভারত গ্রাস করে খোদ দিল্লিতে এসে বসেছে!

দিল্লির লালকেল্লার নবাব মহল ছাড়া আর কোনো এলাকার উপরে জাফর শাহের কর্তৃত্ব নেই। লাল কেল্লার ভেতরের আলিশান প্রাসাদে নবাব বাস করেন বটে, তবে সেটা অনেকটা বন্দীত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। নবাবের সাথে বাইরে থেকে কেউ দেখা করতে আসলে কিংবা নবাব বাহাদুর শাহ জাফরও যদি কাউকে ডেকে পাঠান, তবে তাকেও কোম্পানীর ইংরেজ আবাসিক দুত Sir Thomas Metcalfe 'র অনুমতি নিতে হয়।

নবাব জাফর তার নিজের জায়গীর থেকে প্রাপ্ত অর্থও খরচ করতে পারেন না এই Thomas Metcalfe 'র অনুমতি ব্যাতিরেকে! তিনি নিজের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেন না, সে কারণে বহু কর্মচারীকে চাকুরি থেকে বিদেয় করতেও হয়েছে। সৈন্যদের বেতনও ঠিক মত দিতে পারেন না দেখে বহু রেজিমেন্টও ভেঙ্গে দিতে হয়েছে। এমন আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যেও এমন বিলাসি একটা বিয়ের আয়োজন সত্যিই বড় বেমানান ঠেকে বৈকি।

কিন্তু নবাব নিরুপায়। বেগম জিনাত মহলের কথাই চুড়ান্ত কথা, তার স্বিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। বেগম জিনাত মহল যখন নবাব বাহাদুর শাহ'র জীবনে আসেন রাণী হয়ে তখন তার বয়স সবেমাত্র উনিশ বৎসর, আর নবাবের বয়স ছিল চৌষট্টি বৎসর। উনিশ বৎসরের জিনাত মহল রাণী হয়ে এসে নবাবের স্ত্রী রাণী তাজমহলকে কৌশলে নবাবের কাছ থেকে দূরে সরিয়েছেন

এমনকি জেলেও খাটিয়েছেন। নবাবের পাঁচ স্ত্রীর মধ্যে প্রথম ও সর্বশেষ স্ত্রীর মধ্যে এই যে দ্বন্দ তা আর কোনোদিনই থামেনি। নবাবের ষোল পুত্র আর একত্রিশ, মোট ৪৭ জন সন্তান সন্ততির মধ্যে রাণী তাজমহল চেয়েছেন বড় সন্তান নবাবের উত্তরসূরা হিসেবে সিংহাসনে বসুক, কিন্তু রাণী জিনাত মহল মানতে নারাজ। তাঁর একই কথা, তার গর্ভের সন্তান, জওয়ান বখতই পরবর্তি নবাব হবে।

সকলেরই ধারণা ছিল নবাবের বড় ছেলে মির্জা ফখরু'ই হবেন পরবর্তি নবাব। কিন্তু বেগম জিনাত মহলের একচ্ছত্র প্রভাবে শেষ পর্যন্ত নবাব তার মত বদলে ষোল ছেলের পনেরোতম পুত্রকেই নিজের উত্তারাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করলেন। নবাবের যতটা না তাড়াহুড়ো ছিল তার চেয়ে বেশি তাড়াহুড়ো ছিল বেগম জিনাত মহলের।

বুড়ো নবাব কখন তার মত পাল্টান বা কখন তার শরীরের অবস্থা কোন দিকে মোড় নেয়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাই মাত্র এগারো বৎসরের ছেলেকেই উত্তরাধিকার ঘোষণা ও বিয়ে দিয়ে দিল্লীর সিংহাসনের পরবর্তি উত্তরাধিকার বানাতে উঠে পড়ে লাগেন। এর জন্য যে বিরাট অর্থের দরকার ছিল, তার জোগান দেবার ক্ষমতা জাফর শাহের না থাকলে বেগম জিনাত মহল সে সবের তোয়াক্কা করেন নি। তিনি বিশ্বস্থ উজির মাহবুব আলী খানের সাহায্যে দিল্লির প্রত্যেক শেঠের নিকট থেকে উচ্চ সুদে টাকা কর্জ আনিয়েছেন। যেখানে কর্জ মেলেনি সেখানে প্রয়োজনে মাহবুব আলী খান জোর খাটিয়েছেন অর্থ আদায়ে। শেষ পর্যন্ত টাকার জোগাড়ও হয়েছে।

নির্ধারিত দিনে বিয়ের বরযাত্রী বহরে বড় ছেলে মির্জা ফখরু না যাবার স্বিদ্ধান্ত নিলেও তার শ্বশুর ধুরন্ধর মির্জা ইলাহী বখশ'এর পরামর্শে শেষ পর্যন্ত বরযাত্রী হিসেবে বাপ ভাই এর সাথে শামিল হয়।

মির্জা ইলাহী বখশ নিজ জামাতা, জাফর শাহ এর জেষ্ঠ পুত্রকে নবাবী হতে বঞ্চিত করাটা মেনে নেন নি। তিনিই নবাবপুত্র মির্জা ফখরুর সাথে যোগযোগ করিয়ে দেন কোম্পানীর প্রতিনিধি Sir Thomas Metcalfe 'র সাথে।

জামাই শ্বশুর মিলে এই বিয়ের প্রায় তিন মাস আগেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে গোপনে এক চুক্তি করেন, চুক্তি অনুযায়ী মির্জা ফখরু তার বাবা নবাব বাহাদুর শাহ জাফরের বিরুদ্ধে এক প্রাসাদ ক্যু করে লালকেল্লা হতে সরে গিয়ে নিজেকে নবাব ঘোষণা করবেন, বিনিময়ে কোম্পানী বাহাদুর শাহ জাফরের পরিবর্তে তার বিদ্রোহী পুত্রকে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

এর পরের ইতিহাস বড়ই নির্মম, ১৮৫৭ এর সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ কবার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম একটা কারণ ছিল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নিজ সন্তান কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতা।

এই বিশ্বাসঘাতক সন্তানের সাথে ইংরেজ কোম্পানী চুক্তি করেছিল বটে, কিন্তু ব্যর্থ বিদ্রোহের পরে হুমাউনের সমাধী সৌধে আত্মগোপন করা নবাবকে ২০ শে সেপ্টেম্বর যখন ধরে আনা হয়, তখন তার সাথে সেই বিশ্বাসঘাতক পুত্রও ছিল। আর পরদিন ২১ সে সেপ্টেম্বর কর্নেল হডসন নবাবের সামনেই সবার আগে এই বিশ্বাসঘাতক সন্তানকে গুলি করে হত্যা করে এ কথা প্রমাণ করে যে, বিশ্বাসঘাতককে কেউই বিশ্বাস করে না, এমনকি তার প্রভূ, যাদের জন্য সে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তারাও না। রাণী জিনাত মহল যে সন্তানকে নবাব বানানোর জন্য এত ষড়যন্ত্র করলেন সেই মির্জা জওয়ান বখতকেও বাবার সামনেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয়!

আরও একটা ঘটনা, সেই ১৪৯১ খৃষ্টাব্দে গ্রানাডার সুলতান মুলয় হাসান যখন ফার্ডিনান্ডের সাথে যুদ্ধরত, তখন তার প্রথম স্ত্রীর ঘরের সন্তান আবু আব্দুল্লাহও পিতার সাথে ক্ষমতার দ্বন্দে লিপ্ত ছিল। এক যুদ্ধে আবু আব্দুল্লাহ ফার্ডিনান্ডের খৃষ্টান বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সেখানে তিনি গোপন চুক্তির মাধ্যমে নিজের মুক্তি নিশ্চিত করেন। চুক্তি অনুযায়ী, ফার্ডিনান্ড আবু আব্দুল্লাহকে মুক্তি দেবে, আবু আব্দুল্লাহ ফিরে গিয়ে গ্রানাডায় নিজ পিতা সুলতান মুলয় হাসানের সাথে যোগ দেবে এবং সেখান থেকে তার পিতা ফার্ডিনান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কখন কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সে তথ্য খৃষ্টান বাহিনীকে জানিয়ে দেবে!

নিজ পিতা ও নিজ জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সাময়িক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারলেও আবু আব্দুল্লাহকে কিন্তু অচিরেই তার মুল্য পরিশোধ করতে হয়েছে! ১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী গ্রানাডার পতনের পরে আবু আব্দুল্লাহকে তার খৃষ্টান প্রভু ফার্ডিনান্ড দেশ ছাড়া করেছে। আল হামরা ছেড়ে আসার সময় আবু আব্দুল্লাহ পেছন ফিরে প্রাসাদের দিকে চেয়ে যখন কাঁদছিলেন, তার বৃদ্ধ মা আয়েশা তখন ছেলের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন; 'পুরুষের মত যে রাজ্য রক্ষা করতে পারোনি, নারীর মত আজ সেই রাজ্যের জন্য অশ্রু ঝরাচ্ছো!' এটাই নিয়তি। বিশ্বাসঘাতকদের নিয়তি।

ইতিহাসের করুণ এ ঘটনাগুলো বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হলো, আমরা যেন ভুলে না যাই যে, সংসারে সকল সদস্যদের প্রতি ইনসাফপূর্ণ আচরণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যদি সাম্য, সুবিচার, সৌহার্দ প্রতিষ্ঠা না থাকে, তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক যদি ইনসাফ ও আদেলের উপরে প্রতিষ্ঠিত না থাকে, তবে সে পরিবারের ধ্বংস অনিবার্য। এ বাস্তব সত্যটা কেবলমাত্র পরিবারের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় বরং তা রাষ্ট্র ও সমাজের বেলাতেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

অতএব, নিজ নিজ পরিবারে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করুন। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করুন, নিরাপদ থাকবেন ইনশাআল্লাহ।

বিষয়: বিবিধ

১৩৯৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383333
১২ জুন ২০১৭ রাত ১২:০৮
মনসুর আহামেদ লিখেছেন :
ভালো লাগলো , অনেক ধন্যবাদ
383345
১৩ জুন ২০১৭ দুপুর ০১:৪৯
আব্দুল গাফফার লিখেছেন : জাজাকাল্লাহু খায়রান তথ্য সমৃদ্ধ ইতিহাসের উদাহরণ টেনে সুন্দর বিষয়টি তুলে ধরার জন্য।
383351
১৩ জুন ২০১৭ রাত ০৮:৫৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ শিক্ষনিয় পোস্টটির জন্য। তবে বাহাদুর শাহ জাফর সম্রাট ছিলেন নবাব নন।
১৪ জুন ২০১৭ রাত ০১:১৭
316530
হককথা লিখেছেন : ধন্যবাদ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সকল দলিল দস্তাবেজ, এমনকি, বড়লাটের এর বার্ষিক রিপোর্টে বাহাদুর শাহ জাফর ও তার পরিবারের যে মাসিক খরচ স্টাইপেন্ড দেয়া হতো, তার ভাউচারগুলোতেও তাকে নবাব হিসেবেই অভিহিত করা হয়েছে। এ গুলো এখনও ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত, যে কেউ দেখতে পারে। আপনি যে সম্রাট বলছেন, সম্ভবত আমাদের বাংলাভাষীরাই কেবল এই অভিধা ব্যবহার করি। বাহাদুর মাহ জাফরকে অর্থ ঋণ দিয়েছিলেন যে সব হিন্দু মাড়ওয়ারীগণ, তাদের ঋণচুক্তি পত্রেও তারা তাকে দিল্লির নবাব হিসেবে অভিহিত করেছে। এমনকি বাহাদুর শাহর যে বিচার কার্য চলে দীর্ঘ ছয় দিন ধরে, ইংরেজ বিশেষ কোর্টের সকল দলিল পত্রেও তাকে নবাব হিসেবেই অভিহিত করা হয়েছে। আমিও সে কারণেই তাকে নবাব হিসেবে অভিহিত করেছি। মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File