একটি আজান ও বাইশ শহীদের গল্প-
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৪ আগস্ট, ২০১৬, ০৯:১৩:১৪ রাত
পৃথিবীর ভূ স্বর্গ কাশ্মীর। আর এই কাশ্মীর এমন একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে রেখেছে যে, ইসলামের ইতিহাসে এর কানো দ্বিতীয় উপমা খুঁজেও পাওয়া যাবে না। বাইশ মুসলিম যুবক এক এক করে জীবন দিয়ে হলেও তারা সকলে যোহরের নামাজের আজানটা শেষ করতে পেরেছিলেন। সে এক বিষ্ময়কর ইতিহাস!
ঘটনাটি ছিল ১৯৩১ সালের ১৩ই জুলাই। কাশ্মীরের ক্ষমতায় তখন কট্টর ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী রাজপুত 'ডোগরা' শাসকগোষ্ঠী। ১৮৪৫-৪৬ সময়ব্যাপী ইংরেজ-শীখ যুদ্ধের রেশ ধরে মহারাজ রঞ্জিত সিং এর কাছ থেকে গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গুলাব সিং এ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
শতকরা নব্বই জন মুসলিম জনসংখ্যা অধিষ্ঠিত এই ভূস্বর্গটিতে শাসকবর্গ বরাবরই চেষ্টা করে গেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আর্থসামাজিকও বৃদ্ধিবৃত্তিক দিক সহ জীবনের সকল দিকে পশ্চাৎপদ করে রাখার। ইংরেজ, শীখ ও রাজপুত সহ অন্যান্য সকল অমুসলিম জাতিগোষ্ঠীর অলিখিত ঐক্যমতে তারা এ ক্ষেত্রে সফল হয় নিদারুণভাবে।
এরকম পশ্চাৎপদ অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় যে দু'একজন শিক্ষিত হতে পেরেছিলেন, তাদের প্রায় কক্ই ছিলেন ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। পুরো সমাজের ঘরে ঘরে এদেরই উদ্যোগে মুসলিম জনগোষ্ঠীর আাগমি প্রজন্মকে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানটুকু অন্ততপক্ষে তারা দিয়ে চলেছিলেন।
আধুনিক শিক্ষায় মুসলমানদের আগমণের সকল পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল কুখ্যাত ডোগরা শাসকগোষ্ঠী। মুসলমানদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড দখলদার ইংরেজ ও তাদের সেবাদাস স্থানীয় হিন্দু এবং শীখ সমাজের কারণে অনেক আগেই ভেঙ্গে গেছে। ডোগরা রাজ্যসরকার তার সেনাবাহিনী দিয়ে জোর করে মুসলিম যুবকদের ধরে নিয়ে গিয়ে বনাঞ্চল পরিষ্কার করা সহ পাহাড় কাটা থেকে শুরু করে এরকম দুরুহ কাজগুলো করিয়ে নিতো বিনাশ্রমে। মুসলিম কৃষকদের উপরে অনায্য ভারী করের বোঝা, সরকার বিরোধি হিসেবে সন্দেহ হলে এবং গরু জবাই এর জন্য মৃত্যুদন্ড প্রদানের মাধ্যমে মুসলমানদের হত্যা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ও ব্রিটিশ ভারতে সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে কর্মরত Sir Walter Lawrence (১৮৫৭-১৯৪০) তাঁর ‘The India we served’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
সরকারের পক্ষ হতে কৃত এসব জুলুম অবিচারের প্রতিবাদ করলেই সরকারী নির্যাতন নেমে আসতো, দলে দলে ধরে নিয়ে গিয়ে কারাগারে ভরতো। এদের অনেকেরই পরবর্তিতে আর কোনো দিন কোনো রকম খবরই পাওয়া যায় নি!
এরকমই এক বৈরী পরিবেশে মুসলমান সমাজের আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় দুই আলেম মেলৈভি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও খাজা গোলাম নবী সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এক উদ্যোগ নিলেন। তারা পুরো মুসলিম সমাজের মধ্যে , বিশেষ করে , মুসলিম যুব সমাজের মধ্যে একটা পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তুললেন 'Reading Room Party' নামে। নিরেট অরাজনৈতিক একটি সংগঠন, বই পড়া আর পড়ানো কর্মসূচী, একটা সামাজিক পাঠশালা কার্যক্রম! শ্রীনগর থেকে শেখ আব্দুল্লাহই মূলত এটি পরিচালনা করতেন।
কাশ্মীরের ক্ষমতায় তখন মহারাজা হরি সিংহ। তাঁর এক মন্ত্রী ছিলেন কোলকাতিার বাঙ্গালী খৃষ্টান Sir Albion Benerji। স্যার ব্যানার্জী মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতি মহারাজ হরি সিংহের বিদ্বেষ ও জুলুমের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। ১৯২৫-২৬ এর দিকে মহারাজার মুসলিম বিরোধী নীতির প্রতিবাদে স্যার ব্যানার্জী প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে তার মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করেন।
মহারাজার মন্ত্রী সভার এক অমুসলিম মন্ত্রীর এ রকম একটি পদক্ষেপ মুসলমানদের উজ্জীবিত করে দারুণভাবে। ইতোমধ্যেই 'Reading Room Party' এর মধ্য হতে মুসলিম যুবকদের একটা দল Reading Room Club নামে আলাদা একটা সংগঠন করে বেরিয়ে আসে। এই Reading Room Club এর সদস্যরা মহারাজা হরি সিংহের সকল অন্যায্য নীতির প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।
এভাবেই তারা ক্রমেই একটা রাজনৈতিক প্লাটফরম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং পুরো মুসলিম সমাজের কাছে এক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় যা মহারাজা হরি সিংহকে ভাবিয়ে তোলে। মাহরাজার মন্ত্রী সভার এক ইংরেজ সদস্য G.C.E. Wakefield মুসলিম যুবকদের পরামর্শ দেন তারা যেন তাদের অভিযোগগুলোকে লিখিতভাবে সরকারের নজরে আনেন।
Reading Room Club সদস্যরা কাশ্মীরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত এগারো সদস্য বিশিষ্ঠ একটি কমিটি গঠন করে যার নেতৃত্বে রইলেন শেষ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, চৌধুরি গোলাম আব্বাস এবং খাজা সা'দ উদ্দীনের মত লোকজন।
Reading Room Club ১৯৩১ সালের ২১ শে জুন শ্রীনগরের খানক্বাহ-এ মাওলা'য় এক জনসভার আয়োজন করে। উক্ত জনসভায় এক আব্দুল কাদের খান নামক এক পাঠান নেতা দীর্ঘদিন ধরে মহারাজা হরিসিংহের জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ ও মহারাজার পদত্যাগ দাবী করে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন এবং বলেন; মাহরাজা যদি জনগণের উপর তার জুলুম নির্যাতন বন্ধ না করে, তবে কাশ্মীরের জনগণ মহারাজার প্রাসাদ আক্রমণ করে তার প্রতিটি ইট খুলে আনবে!
মূলত এই ২১ শে জুনই ছিল কাশ্মীর জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণ! আনুষ্ঠানিক যাত্রা!! মহারাজা হরিসিংহের কাছে এ বক্তব্য ছিল সহ্যের বাইরে। অচিরেই আব্দুল কাদের খানকে গ্রেফতার করা হলো (২৫ শে জুন, ১৯৩১)। খুব দ্রুতই তার বিচারের ব্যবস্থাও করা হলো। মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় ১৩ই জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে আব্দুল কাদের বিচারের দিন ধার্য করা হলো।
কাশ্মীরের জনগণ সরকারের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ফেটে পড়লো। নির্ধারিত দিন, ১৩ই জুলাই সোমবার হাজার হাজার কাশ্মীরি জনগণ শ্রীনগর আদালত চত্বরে জমায়েত হলে ডোগরা রাজার পুলিম জসগণকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে লাঠি চার্জ শুরু করলে জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায় এবং থেমে থেমে তা প্রায় কয়েক ঘন্টা চলতে থাকে।
এরই মধ্যে জোহরের নামাজের সময় হলে উপস্থিত জনতার মধ্য হতে একজন দাঁড়িয়ে আজান দিতে শুরু করে। আজান শুরু হতে না হতেই মহারাজার পুলিশ উক্ত মুযাজ্জিনকে গুলি করে হত্যা করে। বেচারা আজানের প্রথম লাইনটাই শেষ করতে পারেনি, তা দেখে শহীদ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির পাশ হতে অন্য একজন দাঁড়িয়ে যান, যে শব্দ থেকে আজান থেমে গিয়েছিল তিনি ঠিক সেখান থেকেই আবার আজান শুরু করলেন।
আজানের মাত্র কয়েকটা শব্দ শেষ না করতেই এবারেও পুলিশ গুলি চালিয়ে উক্ত মুয়াজ্জিনকে শহীদ করে দেয়! পাশ থেকে আরও একজন মুসলমান দাঁড়িয়ে যান, তার আগের শহীদ যেখানে থেমে গিয়েছেন, তিনি সেখান থেকেই শুরু করেন আজান!
তার ক্ষেত্রেও সেই একই করুণ ঘটনার পূণারাবৃত্তি, তাকেও শহীদ করে দেয় পুলিশ! এভাবে এক এক করে বাইশ জন কাশ্মীরি মুসলমান শহীদ হয়ে যান একটা মাত্র আজান শেষ করতে!
কাশ্মীরের ইতিহাসের সেই কালো দিন, ইসলামের ইতিহাসে ত্যাগের সেই স্বর্ণোজ্জল দিন ১৩ই জুলাই এর ঐতিহাসিক চিহ্ন বহন কারে আজও দাঁড়িয়ে আছে শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্রে 'মা্জার এ শুহাদা'!
আর সেই ঘটনার পর থেকে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৮৫টি বৎসর, কিন্তু থামেনি স্বাধীনতার জন্য প্রাণ ও সম্পদ উৎসর্গ করে যাবার ধারা। আজও ভূস্বর্গ কাশ্মীরে ঝরে চলেছে স্বাধীনতাপিয়াসী মানুষের বুকের তাজা খূন!
বিষয়: বিবিধ
২৫৬৫ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
Please see
1-The Greater Kashmir; Engnr Hilal Ahmed War
2- Kashmir: Martyrs’ Day is Alive; By Sajjad Shaukat
3- The Nation, 14th July 2014 Edition.pp-4
Thanks
মন্তব্য করতে লগইন করুন