একটি মৌমাছি-একজন লেখক এবং একটি রোগাগ্রস্থ উম্মাহ সমাচার!
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০৬ মার্চ, ২০১৬, ০৩:২৯:৪৪ রাত
মধু খুব উপকারী খাদৗ এবং পানীয়। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিন নিজেই আল কুরআনে জানিয়ে দিয়েছেন মধুর মধ্যে মানুষের জন্য রোগ উপশমকারী উপাদান রয়েছে। তাঁর নির্দেশ পালনে মৌমাছিরা হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করে ফুলের রস আহরণ করে নিয়ে আসে নিজেদের মৌচাকে, মধু বানায়। মাত্র এক পাউন্ড মধু আহরণের জন্য মৌমাছিকে পঞ্চান্ন হাজার মাইল উড়তে ও কুড়ি লক্ষ ফুলের রস আহরণ করতে হয়।
আপনি যদি মানবতার জন্য কল্যাণকামী একজন ভালো লেখক হতে চান, তবে আপনাকেও একটা মৌমাছির দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে পরিশ্রমী হয়ে উঠতে হবে। একটা ভালো লেখা তৈরী করতে আপনাকেও হাজার হাজার বই ঘাঁটতে হবে, মৌমাছির মত উড়ে উড়ে গিয়ে বসতে হবে বই এর এক পাতা থেকে আর এক পাতায়! পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা তথ্য, উপাত্তকে তুলে আনতে হবে ঠিক যেমনটা মৌমাছি ফুলের বুক হতে তুলে আনে তার রসটুকু!
একজন লেখককে হতে হবে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। তার থাকতে হবে তৃতীয় নয়ন। সাধারণ মানুষ তাদের দুটি চোখ দিয়ে যা দেখেন, সেই একই জিনিসের মধ্যে একজন লেখক নিজের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন তার চেয়েও বেশী কিছু, ভিন্ন কিছু।
প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক J. M Roberts তার The Triumph of the West, মওলানা মওদুদী তাঁর 'খেলাফত ওয়া মুলুকিয়াত' নাসিম হিজাজী তাঁর 'আখেরী চাটান', মরিয়াম জামিলাহ তাঁর Western Civilization, মরহুম ড: ইসমাইল রাজী আল ফারুকী তাঁর অমর সৃষ্টি The Cultural Atlas of Islam নামক বিষ্ময়কর কিতাবটিতে, Karen Armstrong তার The Bible The Biography নামক গ্রন্থ এবং আরও বহু ইতিহাসখ্যাত লেখকগণ তাদের লেখনীতে সে প্রমাণ রেখেছেন
একটা মৌমাছির থাকে পাঁচটি চোখ। এই পাঁচটি চোখ দিয়ে সে দেখে, আর চারটি পাখা প্রতি মিনিটে ১২০০০ বার ঝাপ্টিয়ে ঘন্টায় ১২ হতে ১৫ মাইল বেগে উড়ে উড়ে সে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ফুলে গিয়ে বসে, মধু আহরণের জন্য।
আপনি যদি একজন ভালো লেখক হতে চান, তবে আপনাকেও মৌমাছির মত একটা ছোট্ট প্রাণীর এই অসাধfরণ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের গাণিতিক সমীকরণটাকে সামনে রাখতে হবে। যেমনটা রেখেছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক Edward Gibbon তার লেখা মাষ্টারপিস The Decline and Fall of the Roman Empire এ , ১৭৬৬ হতে ১৭৮৮ সাল জুড়ে লেখা ৭১টি অধ্যায় বিশিষ্ঠ ১০৭৬ পৃষ্ঠার এই বিশাল গ্রন্থটি রচনার আড়াই শত বছর পরে এসেও ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দী রয়ে গেছে এখনও!
এর একমাত্র কারণ তিনি বইটি লিখেছেন দূর্লভ সব তথ্যপ্রমাণ সহকারে, লক্ষাধিক তথ্যসুত্র টেনে এনেছেন বইটা লিখতে। লিখেছেন সমকালীণ যুগ বিবেচনায় মোটামুটি নিরপেক্ষতা বজায় রেখে। নিজে একজন খৃষ্টান হয়েও অত্যন্ত কঠোরভাবে তিনি খৃষ্টবাদের সাথে সাথে খৃষ্টান ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনাও করেছেন। এতে করে তার জীবদ্দশাতে যেমনি, তেমনি তার মৃত্যুর পরেও খৃষ্টবাদে বিশ্বাসী অনেক নামী দামী ব্যক্তি তার উপরে খেপেছেন, কিন্তু তারপরেও তার সেই সমালোচনাকারীরা পর্যন্ত একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য যে, তাঁর সেই বইটির কোন তুলনা নাই।
আপনাকেও লিখতে হবে। লিখতে হবে এরকম কঠোর পরিশ্রমী হয়ে। এডওয়ার্ড গীবন তার সারাজীবনে ঐ একটি বই ছাড়া আর একটি লাইনও যদি না লিখতেন, তাতেও তার আজকের এই পরিচিতি আর জনপ্রিয়তা পেতে কোনরকম বেগ পেতে হতো না।
একটি (নারী) মৌমাছি তার সারা জীবনের প্রচেষ্টায় এক চা চামচের বারো ভাগের এক ভাগ মাত্র মধু তৈরী করতে পারে। সামান্য পরিমাণের এই মধুটুকু তৈরীতেই তার জীবন পার! এতেই তার জীবনের স্বার্থকতা, মহান রবের হুকুম পালন বলে কথা ! একই ভাবেই আপনাকেও আপনার রবের হুকুম পালনে, সত্য আর সুন্দরের বাণী প্রচারের লক্ষ্যে লিখতে হবে। সারা জীবনের প্রচেষ্টায় আপনি যদি একটি মাত্র রচনাও লিখে যেতে পারেন, হয়তো সেটাই আপনাকেও ইতিহাসে অমর করে রাখবে।
আমাদের সামনে রয়েছে সেরকমই এক অনন্য উদাহারণ। মুসলিম পন্ডিত ইবনে খালদুন তাঁর চুয়াত্তর বৎসর জীবনের মধ্যে মাত্র চারটি বৎসরের শ্রমে লিখেছিলেন এক অমর গ্রন্থ 'আল মুকাদ্দামা' । বইটি রচনার প্রায় সাত শত বৎসর পেরিয়ে গেলেও আজও তা পাঠকের কাছে এক বিষ্ময়! এরকম বিষ্ময় জন্ম দিয়ে গেছেন ইবনে সীনা'ও। হাজার বৎসর আগেই লিখেছেন চিকিৎসা শাস্ত্রের এমনসব বই, যা এই ডিজিটাল যুগে আজও বিজ্ঞানীদের হতবাক করে দেয়। ইবনে সীনার মৃত্যুর পরে হাজার বৎসর পেরিয়ে গেলেও আজও আর একটা 'কানুন' রচিত হয় নি এ বিশ্বে!
আফসোস, আজ আমাদের লেখকরা ব্যস্ত কেবল রগরগে প্রেমের উপন্যাস আর কল্পকাহিনী লিখতে! কল্পকাহিনী আর রগরগে উপন্যাস দিয়ে কী জাতির মনোজগতে পরিবর্তন হয়?হয় কী আত্মার রোগ নিরাময়?
মধু যেমন দেহের রোগ দূর করে, তেমনি একটা বই দূর করতে পারে মনের রোগ, আত্মার কলুষতা। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর চরম অজ্ঞতায় জর্জরিত, রোগাক্রান্ত একটি জাতিকে এ বাস্তবতাটা বুঝে উঠতে হবে সর্বাগ্রে, তবেই কেবল আমরা মুক্তির আশা করতে পারি, কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কী বুঝবো এ বাস্তবতা?
বিষয়: বিবিধ
২২০৩ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লেখকের সাথে সহমত, ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লিখাটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন