'ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি' - আল মাহমুদ
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২১ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৮:১৪:৩৪ রাত
কবি আল মাহমুদ রোগাগ্রস্থাবস্থায় বেশ কিছুদিন হাসপাতালে শয্যাশায়ী থাকলেও রাষ্ট্র যেমন তার প্রতি কোনরকম স্বাভাবিক ও সামান্যতম সৌজন্যতাবোধ দেখায় নি, তেমনি মেইনস্ট্রীম মিডিয়াও তাকে বয়কট করে চলেছে! যে মিডিয়া একটা দিনের জন্যও ভারতের পতিতাদের নিয়ে কলাম ছাপা হতে বিরত থাকে নি, সেই মিডিয়াই নিজ দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকে এভাবে অবজ্ঞা করে চলছে!
এ ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা বাংলাদেশীরা মরহুম কবি ফররুখের প্রতি কী নির্মম আচরণই না করেছি।
দরবেশ কবি ফররুখকে কী আমরা না খাইয়ে মারিনি? বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে তার চাকুরিটাকে কী আমরা কেড়ে নেই নি? তাকে কী ভিটে ছাড়া করি নি? বিনা চিকিৎসায় কী হত্যা করি নি কবির কিশোরী কণ্যাকে?
হ্যাঁ, করেছি, বাংলাদেশ, এ দেশের সরকার, সমাজ তা করেছে, আমরা বাংলাদেশীরা তা চেয়ে চেয়ে দেখেছি। টু শব্দটিও করি নি।
সেই দেশ, সেই সমাজ যখন চারটি দশক পরে এসে তার শ্রেষ্ঠ কবির প্রতি এ রকম একটি আচরণ করে, তখন আমরা আসলেই অবাক হই না।
আল মাহমুদ কেবল একজন কবিই নন, তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে। একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে এতটা অবহেলার শীকার, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে; একজন মুক্তিযোদ্ধা, যুগশ্রেষ্ঠ কবির প্রতি এরকম সীমাহীন ও লজ্জাকর অবহেলার কারণটাই বা কী? প্রশ্ন জাগে ; একজন মুক্তিযোদ্ধার 'মৃুক্তিযোদ্ধা' হবার যোগ্যতাটাই বা কী?
আসলে আল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছলনা করতে শেখেন নি,শেখেন নি মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে কোন ব্যবসা করতে। তা না হলে আজ তিনি দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে মিডিয়ার প্রথম পাতায় থাকতেন সর্বক্ষণ! টিভির রঙ্গিন পর্দায় দিন রাত চলতো তার বন্দনা, শাহবাগে জ্বলতো লক্ষ মোমবাতী, তীলক আঁকা হতো তার রোগ মুক্তি চেয়ে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী আমলা আর চাটুকাররা ভাঁজ না ভাঙ্গা পাঞ্জাবী গা'এ ছুটোছুটি করতেন হাসপাতালের কেবিনে! চেতনার ব্যাবসায়ীরা আল মাহমুদ-এর বন্দনায় মুখে ফেনা তুলে ফেলতেন!
কিন্তু বিশ্বাসের কবি আল মাহমুদ সে ছলনা শেখেন নি, চেতনার সে ব্যবসার কৌশলটাও রপ্ত করেন নি।
তার একটি কবিতার চরণ মনে পড়ছে; তিনি লিখেছেন;
'ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি' (সোনালী কাবিন)
বিশ্বাসী একজন কবি হয়েছেন বলেই তিনি আত্ম সম্মান বিক্রি করনে নি, করতেও পারেন নি। অনেক আগেই তিনি ঐ একই কবিতায় নির্দ্বিধায় লিখেছেন;
'আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারিদিকে চতুর ভ্রকুটি' (ঐ)
অসুস্থ এ কবি এই বৃদ্ধ বয়সে রোগশয্যায় শুয়ে সমাজ আর রাষ্ট্র এবং সতীর্থদের এ হেন অবহেলা, অবজ্ঞা দেখে হয়ত মনে মনে কষ্ট পাচ্ছেন, তবে বিশ্বাসীরা এ কষ্টের মাঝেও শান্তনা খুঁজে পান। নিজ বিশ্বাসের প্রতি অটল থাকার মত এক শান্তনা, যা স্বর্গীয়, সবার কপালে তা জোটে না। জুটেছিল দরবেশ কবি ফররুখের ললাটে, যিনি মরেছেন, কিন্তু নিজ আদর্শ আর বিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে আপোষ করেন নি, আত্মবিক্রয় করেন নি।
কবি আজ এই পরিণত বয়সে কোন স্বীকৃতি বা পুরস্কারের তোয়াক্কা করেন না। মৃত্যু পথযাত্রী কোন ব্যক্তিই সম্ভবত করেন না। তবে আমরা, যারা বেঁচে আছি এখনও এ সমাজে, তারা আহত হই, বিক্ষুব্ধ হই।
কারণটাও আল মাহমুদ অনেক আগেই তার এক কবিতায় (এপিটাফ- প্রতিবাদী রাখাল) বলেছেন;
'আমরা পৃথিবীবাসী শুধু দেখি রক্ত আর ক্লেদ-
বুঝিনা মৃত্যুর ভাষা, সত্য আর মিথ্যার প্রভেদ।'
'সোনালী কাবিন' 'কালের কলস' 'নোলক' 'লোক লোকান্তর' 'বখতিয়ারের ঘোড়া' 'উপমহাদেশ' এরকম আরও অনেক যুগান্তকারী রচনা যাঁর হাত হতে বের হয়ে এসেছে তার কাছে এ ভাষা, এ সাহিত্য আজন্ম ঋণী থাকবে।
এ ঋণ শোধ হবার নয় জানি, তারপরেও অন্তর থেকে প্রার্থনা করি, এ সমাজ থেকে বিভক্তির এই ক্লেদ দূর হোক।
বিষয়: বিবিধ
১৯৫২ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ তার কবিতা নিয়ে গবেষনা হয়। তার লিখা গল্প থেকে মুভি তৈরি হয় ভারতে। শুধু আমরাই এই জাতির শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে দুরে সরিয়ে রাখি।
ওদের অবহেলাই প্রিয় কবিকে তাঁর রবের কাছে সম্মানিত করবে ইনশাআল্লাহ
আল্লাহতায়ালা তাঁকে সুস্থতার সাথে দীর্ঘায়ূ করুন, আমীন
মন্তব্য করতে লগইন করুন