সুরা ফাতিহা: সাত, সতোরো আর সাত শ‘র কারিশমা বনাম বিপন্ন মুসলমান
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৩:১২:৪২ রাত
আল কুরআনের সর্বপ্রথম সুরা, সুরা ফাতিহা। মহাগ্রন্থের মুখপত্র, উপক্রমণিকা। প্রিয় রাসুল সা: নিজেই এ সুরাটিকে বিভিন্ন অভিধায়, যেমন; ‘উম্মুল কুরআন’ ‘উম্মুল কিত্বাব’ অভিহিত করেছেন। তিনি এ সুরাটিকে কুরআনের ভিত্তিমূল হিসেবে অভিহিত করেছেন, বলেছেন; ‘আসাসুল কুরআন’ ইংরেজিতে বললে বলতে হয় 'Foundation of the Quran'।
সুরা ফাতিহা ছাড়া সালাতই হয় না। প্রতি ওয়াক্তের সালাত-এর অনিবার্য অনুষঙ্গ হলো সুরা ফাতেহা। আর স্বয়ং আল্লাহ পাক নিজেই এই সুরাটিকে ইংগিত করে আল কুরআনের সুরা হিজর-এ বলেছেন;
‘আমি আপনাকে সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কুরআন দিয়েছি।’ (হিজর-৮৭)
এটি একটা দোওয়া, সেটা আমরা জানি। আল্লাহর মহত্ব, তাঁর বড়ত্ব, তাঁর বিশালত্ব স্বীকার করার পরে আমরা আল্লাহর কাছে জীবনে চলার পথ ও পাথেয় প্রার্থনা করি। চলার দিক নির্দেশনা চাই।
আমাদের সে প্রার্থনার জবাব হিসেবে আল্লাহপাক আমাদের সামনে পুরো কুরআনই দিয়েছেন। বলেছেন; ‘এই সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই।’ (বাক্বারা ২) ‘এই কুরআন এমন পথ প্রদর্শন করে যা সর্বাধিক সরল (সুরা আল ইসরা-৯)’
এরকম স্পষ্ট ঘোষণার পরও কিন্তু আমাদের সমাজে মুসলমানদের মনে সন্দেহ রয়ে গেছে! সন্দেহই যদি রয়ে না যাবে, তা হলে তারা গোমরাহ হবে কেন? কেনই বা তারা জীবনযুদ্ধের প্রতিটি পদে পদে বিভ্রান্ত হবে? কেনই বা তারা আকাশ থেকে পাতাল অবধি, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত ছুটে বেড়াবে পথনির্দেশনা চেয়ে? বিভ্রান্তই যদি না হবে, তা হলে কেনই বা তারা ওয়াশিংটন থেকে মস্কো কিংবা জেনেভা থেকে লন্ডন দিন রাত ছুটোছুটি করবে পঞ্চবার্ষিকি কর্মপরিকল্পনা, মেলিনিয়াম গোল নিয়ে?
আসল কথা হলো, মুসলিম উম্মাহর সিংহভাগই আজ পথহারা, দিশাহারা, দিকভ্রান্ত, দিক নিদের্শনাহীন আর হতাশায় নিমজ্জিত।
অথচ এদের তো এমন অবস্থায় নিপতিত হবার কথা ছিলো না! মানব জীবনের সকল জটিলতার যুক্তিগ্রাহ্য, অকাট্য ও নির্ভূল জবাব তাদের কাছে ছিলো, এখনও বিদ্যমান। আল কুরআন জীবন ও সমাজের সকল প্রশ্নের জবাব নিয়ে তাদের হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে, যে আল কুরআন সন্মন্ধ্যে মহান আল্লাহর ঘোষণা;
‘আমি আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি, এটি এমন যে, তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ (সুরা আন নাহল- ৮৯)’
কোনো ধরনের কায়-ক্লেশ ব্যতিরেকেই এসব জবাব, এসব নির্দেশনা তাদের হাতের কাছে, হাতের নাগালের মধ্যে। বিশ্বে এমন কোনো গ্রন্থ নেই, যার একজন হাফেজ পাওয়া যাবে তার নিজ ভাষায়, ভিন্ন ভাষীদের মধ্যে তো দূরের কথা। অথচ এই কুরআনের দুই কোটি হাফেজ রয়েছে বিশ্বে, যার মধ্যে বেশীরভাগই ভিন্নভাষী। এই মুসলমানরা সযত্নে কুরআন হেফজ করে, তেলওয়াত করে, পড়ে আর পড়ায়। রাত জেগে জেগে কুরআন খতম করে। কী আশ্চর্জ, তারপরেও তারা পথ খোঁজে! তারপরেও তারা পথহারা!! তারপরেও তারা হতাশায় ডুবে থাকে!! হতোদ্যম হয়!!!
কত বড় হতভাগা হলে এমনটা হয়? কত বড় অবুঝ হলেই বা এমন হতে পারে? আসলেই, আজকের মুসলমানরা নিজেদের যত বড় জ্ঞানীই মনে করুক না কেন, নিজেদেরকে যত বড় উন্নত আদর্শের ধারক বলেই মনে করুক না কেন, তাদের অধিকাংশই নির্বোধ। এরকম নির্বোধদের জন্য মহান প্রভূর আবেগময়ী প্রশ্ন;
‘আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, এতে তোমাদের জন্য উপদেশ রয়েছে, তোমরা কী বোঝ না? (সুরা আল আম্বিয়া-১০)’
আসলেই তারা বোঝে না, বোঝে না বলেই তার আজ কুরআন ছেড়ে দিকে দিকে পথের অন্বেষায় ছুটে মরে। বোঝে না বলেই তারা আজ বিশ্বের সবচেয়ে হতদরিদ্র, সবচেয়ে নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত আর নির্যাতিত জাতি। অথচ নিয়তির কী পরিহাস দেখুন, কুরআন কিন্তু এ জন্য নাযিল হয়নি যে, এর পাঠক, এর বাহক আর অনূগামীরা নিষ্পেষিত, জর্জরিত, লাঞ্ছিত হবে বিশ্বে। স্বয়ং আল্লাহরই কথা এটা;
‘আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করিনি’ (সুরা ত্ব হা-২)
কুরআন তো নাযিল হয়েছিলো যেন প্রিয় রাসুল নিষ্পেষিত, নীপিড়িত মানুষকে সকল প্রকার অভাব, অনটন, অবিচার-জুলুম-নিষ্পেষণ আর শোষণ থেকে মানুষকে মুক্তি দেবেন। নাযিল হয়েছিল এ জন্য যে, তিনি এই কুরআনকে ভিত্তি করে মানব সম্প্রদায়কে অজ্ঞানতার আঁধার থেকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করবেন। সেটাই ছিল কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য। স্বয়ং আল্লাহরই কথা সেটা;
‘আলিফ-লাম-রা; এটি এমন একটা গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি-যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন, পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য রবের নির্দেশে, তারই পথের দিকে।’ (সুরা ইব্রাহিম-১)
ইতিহাস স্বাক্ষী, স্বাক্ষী এ বিশ্ব মানবতা, তিনি সা: সে কাজটি ঠিক ঠিক আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে পশ্চাদপর একটি জাতিকে একমাত্র কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে, একমাত্র কুরআনের নির্দেশনায় পরিচালতি করে সারা বিশ্বের শাসক শ্রেণীতে উন্নিত করেছিলেন। তিনি সা: এই কুরআনকে ভিত্তি করে মানব ইতিহাসকে চীরদিনের জন্য বদলে দিয়ে গেছেন।
আর আজ? আজ সেই কুরআনেরই পাঠক, সেই কুরআনেরই ধারক আর বাহকরা, প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর অনূগামী উম্মত হবার দাবীদাররা দ্বারে দ্বারে ঠোকর খেয়ে বেড়ায়, উ™£ান্ত, বিভ্রান্ত আর বিপর্যস্থাবস্থায়! পুুরো বিশ্ব ভেড়ার পালের মত তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় পুর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে! কী লজ্জা! কী লজ্জা!!
শ্রদ্ধেয় পাঠক, এ থেকে উত্তরণের পথটা কী? পথ একটাই। আর সেটা হলো, ফিরে চলুন আল কুরআনের কাছে। আল কুরআনের কাছে ফিরে যাবার আগে, সবার আগে খোলা মন নিয়ে আশ্রয় নিন সুরা ফািতেহার কাছে।
হ্যাঁ, সুরা ফাতেহার কাছে। সাতটি আয়াত সম্বলিত সুরা ফাতেহা, যা প্রতিটি মুসলমান দিনের মধ্যে অন্তত সতোরোবার সালাতে দাঁড়িয়ে তেলওয়াত করে, আল্লাহর কাছে পথনির্দেশ চায় এই সুরার মাধ্যমে, বলে; 'আমাদের সোজা সরল পথ দেখাও হে আল্লাহ'।
সেই সুরা ফাতিহার কাছে ফিরে আসুন। ভালো করে হৃদয় দিয়ে একবার সুরা ফাতিহাটা পড়ে নিন, বুঝে নিন। আর আল্লাহর কাছে প্রতিদিন সতোরোবার সুরা ফাতিহার মাধ্যমে উপস্থাপিত দরখাস্তের প্রত্যুত্তরে আল্লাহ পাক আপনার কাছে মেলে ধরেছেন আল কুরআন।
আল কুরআন, যার প্রথম নির্দেশটি ছিলো; ‘পড়ো, তোমার রবের নামে’ । সেখান থেকেই শুরু করুন। জ্ঞানের নিরলস চর্চা করুন, নিরবিচ্ছিন্ন চর্চা করুন। আপনার জন্য দেয়া হয়েছে এ কুরআন। আপনার মনে উদিত প্রশ্নের জবাব আপনি কুরআন থেকে বুঝে নিন।
ইবনে ত্বাবারি আজ হতে এগারো শত বসর পূর্বে কুরআন থেকে কী বুঝেছেন, ইবনে কাসির আজ হতে সাতশত বসর আগে কুরআন থেকে কী বুঝেছিলেন, সাড়ে সাতশত বসর আগে ইবনে তাইমিয়া এই কুরআন থেকে কী বুঝেছিলেন, সে প্রশ্ন নয়, আজ আপনি আপনার যুগে, সমকালীন এই যুগে কী বুঝছেন, আপনাকে কুরআন আজকের এই দিনে কী নির্দেশনা দিচ্ছে সমকালীন সমস্যার? সেটা দেখুন। তার মানে হলো, আপনি জ্ঞান চর্চা করুন।
কুরআন বুঝুন। কুরআন বোঝা আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় ফাজায়েলে ওজিফা, ফাজায়েলে জিকির কিংবা ছয় উসুল বোঝার চেয়েও আরবি ভাষার কুরআন বোঝা সহজ। আমার কথা নয় এটি, স্বয়ং আল্লাহরই ঘোষণা;
‘আমি এই কুরআনকে বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছি, আছে কী কেউ এ থেকে শিক্ষা নেবে?’ সুরা আল ক্বামার- ১৭,২২,৩২, ৪০)
সেই কুরআনের কাছেই ফিরে আসুন। এই কুরআন দিয়েই বিশ্বকে দেখুন। দেখুন আপনার ভেতর- বাহির, আপনার চারিপাশ। কুরআন দিয়ে নিজেকে চিনুন। রক্ত গরম করা ওয়াজ নসিহত, কিংবা জ্বালাময়ী ভাষণের বদলে এই কুরআন দিয়ে চিনুন আপনার ওস্তাদ আর পীর বুজুর্গকে!
সাত আয়াতের সুরা ফাতিহার মাধ্যমে দিনে সতোরো বার আল্লাহর কাছে পথের দিশা চেয়ে জবাবে পাওয়া কুরআনে আল্লাহপাক ঐ সাতটি আয়াতের একশতগুন বেশী তথা সাত শতবার বলেছেন ইলম চর্চার কথা। হ্যাঁ, ইলম চর্চা করুন। জ্ঞান চর্চা করুন।
শ্রদ্ধেয় পাঠক, বিশ্বাস করুন, আপনি যদি এই সাতটি আয়াত দিনে সতোরোবার আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে তেলওয়াত করা আর আল্লাহ রাব্বুল আ‘লামিন কর্তৃক সাতশত বার ইলম এর উল্লেখ করার বিষয়; এসবের গূঢ় রহস্যটা বুঝতে পারেন, তবে দেখবেন আপনার সামনে এক ভিন্ন জগত খুলে গেছে। বিষয়টা একটু গভীরভাবে ভেবে দেখবেন কী?
বিষয়: বিবিধ
৩০১৬ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 7228
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
মহান আল্লাহ আমাদর সবাইকে হেদায়েত দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে নেক কামিয়াবী দান করুন, আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন