ইসলামি চরিত্র গঠনের ১১ টি মৌলিক উপাদান ও মাহেন্দ্রক্ষণ রামাদ্বান। আসুন প্রস্তুতি নেই-
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২৫ জুন, ২০১৪, ০১:৪২:২৫ রাত
রামাদ্বান এসে গেছে। একজন মুসলমানের জন্য তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ আত্বিক ও মানসিক পবিত্রতা অর্জনের। ইসলামি চরিত্র গঠন, অন্তরে আল্লাহভীতি তৈরী ও পরবর্তি একটি বসর সময়কালে তা লালন করার মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হিসেবে গড়ে তোলার এ এক সুবর্ণ সুযোগ।
একজন মুসলমানের যে মৌলিক চালিকাশক্তি; আল্লাহভীতি বা ত্বাক্কওয়া তা অর্জনের মাস এটি। এই ত্বাক্কওয়া ছাড়া একজন মুসলমানের পক্ষে ইসলামি চরিত্র গড়ে তোলা সম্ভবপর নয়। তাই আমরা আলোচনা করবো ইসলামি চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান কী? তার সাথে রোজার সম্পর্ক কী, সে বিষয়ে।
ইসলামি চরিত্র কাকে বলে?
ইসলামি চরিত্র হলো সেই চরিত্র;
এক- যে চরিত্র আল কুরআনে বর্ণিত মৌলিক মানবীয় গুণাবলী ও তার শিক্ষাকে ধারণ করে রাখে। এবং
দুই- যে চরিত্রের মাধ্যমে প্রিয় রাসুল সা: এর জীবনাদর্শ ও কর্মপদ্ধতী ফুটে উঠে।
সেই চরিত্রই উত্তম চরিত্র (রাসুল সা: এর অনকুরণে তৈরী) । (خُلُقٍ عَظِيمٍ /68:4)
আল কুরআনের আলোকে ইসলামি চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান হলো ১১ টি। অতি সংক্ষেপে সে গুলো হলো;
১. Ethics (নীতি-নৈতিকতা) আল কুরআনে এ সংক্রান্ত অন্তত ১৯টি আয়াত রয়েছে; যেমন-
لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
(২: ১৭৭)
ভাবার্থ: সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই মুত্তাক্বি। (আরও দেখুন-১৭: ২২-৩৭, ২৬: ৮৮-৮৯)
২. Humility (বিনম্রতা): আল কুরআনে এ সংক্রান্ত অন্তত ৬টি আয়াত রয়েছে, যেমন- قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ (২৩: ১-২)
ভাবার্থ: মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র। (আরও দেখুন;৬:৪২-৪৩, ৭:৫৫-৫৬, ১৭: ৩৭)
৩. Integrity (অখন্ড সততা): আল কুরআনের অন্তত ২টি আয়াত দেখুন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُون
كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (৬১:২-৩)
মুমিনগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক।
৪. A sense of Responsibility (দায়িত্বসচেতনতা): আল কুরআনে এ সংক্রান্ত অন্তত ১১টি আয়াত রয়েছে-
وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَٰذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا (১৮: ৪৯)
আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না। (আরও দেখুন- ৯:৭১, ১৬: ৯৩, ১৭: ১০, ৩৬, ২১: ২৩,২৩: ৬০-৬২,৩৭: ২৪,৫০: ১৮)
৫. Respect to Rule of Law (আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ)- আল কুরআনে এ সংক্রান্ত অন্তত ৪ টি আয়াত রয়েছে-
َا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا ৪:৫৯
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। (আরও দেখুন; ৫:৬৪, ৭০: ৪০-৪১)
৬. Respect to Rights of Others (মানবাধিকারের প্রতি সম্মান)- আল কুরআনে মানবাধিকার সংক্রান্ত অন্তত ৫০টি বা ততোধিক নির্দেশিকা মোট ৫৭টি স্থানে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- ২: ৪২, ৮৫, ১৯৫, ২৬৯, ২৫৬, ২১২, ৩:৭১,৭৯, ১৬৩, ৪: ৩,১৯, ৩২, ৩৬, ১০০,১৪৮, ৫: ৩২, ৯০, ৬:৪১, ১০৯, ১৩২, ১৫২, ১৭: ২৯, ৩২, ৩৫, ৩৬, ৭০, ২০: ১১৮, ১১৯, ২২: ৪০, ২৪: ২, ২৭, ৯৫: ৪, ৩৩: ৪, ৩৫, ৫৩,৩৭: ৩৯, ৩৯:৭০, ৪৬: ১৯, ৪৭: ৪, ৪৯: ৬, ১০, ১১, ১৩, ৫৩: ৩৯, ৪১, ৭০: ২৪, ৭৬: ১৩, ১৪, ১৫, ৮৩: ১
৭. Strive to save and investment. (উপার্জন, সঞ্চয় ও আত্বনির্ভরশীলতা)- আল কুরআনে এ সংক্রান্ত অন্তত ৪টি আয়াত রয়েছে
فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَأَنفِقُوا خَيْرًا لِّأَنفُسِكُمْ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ৬৪:১৬
ভাবার্থ: অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর, শুন, আনুগত্য কর এবং ব্যয় কর। এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। যারা মনের কার্পন্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।
(আরও দেখুন; ৫৩:৩৯, ১০২:১-২)
৮. Hard work (পরিশ্রমী)- পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা ছাড়া মানুষের পক্ষে কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়।وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى ثُمَّ يُجْزَاهُ الْجَزَاءَ الْأَوْفَىٰ
(৫৩ :৩৯-৪১) এবং মানুষ তাই পায়, যা সে করে, তার কর্ম শীঘ্রই দেখা হবে। অতঃপর তাকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে।
(আরও দেখুন; ৯৯: ৬-৮। 'কাজ' 'পরিশ্রম' ও 'প্রচেষ্টা' বোঝাতে কুরআনে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে; আ'মল-৩৬০ ও ফা'আল বা ফে'এল ১০৯ বার)
৯. Will of Super action (কর্মোদ্দীপনা)- (আল কুরআনে এ সংক্রান্ত অন্তত ৯৬ টি আয়াত রয়েছে) লক্ষ্য অর্জন ও কর্মসম্পাদনে অটলতা, দৃড়তা সন্মন্ধ্যে আল কুরআন-
كَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ
(৩:১৪৬) আর বহু নবী ছিলেন, যাঁদের সঙ্গী-সাথীরা তাঁদের অনুবর্তী হয়ে জেহাদ করেছে; আল্লাহর পথে-তাদের কিছু কষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু আল্লাহর রাহে তারা হেরেও যায়নি, ক্লান্তও হয়নি এবং দমেও যায়নি। আর যারা সবর করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন
(আরও দেখুন- আল্লাহতে আস্থা -২: ১৯৫ ২২২, ৩: ৭৬, ১৫৯
ন্যায় বিচার ও সমতা - ৫:৮, ধৈর্য বা সবর- আল কুরআনে ৯০ বার উল্লেখিত হয়েছে।)
১০. Punctuality (সময়োনুবর্তীতা)- َالْعَصْرِ إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
ভাবার্থ- কসম সময়ের, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।
(আরও দেখুন - ৬৩:১০)
১১. Taqwa (আল্লাহভীরূতা)- আর 'ইসলামি চরিত্র' গঠনের সর্বশেষ ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একাদশতম উপাদানটি হলো; 'ত্বাক্কওয়া' إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (৪৯:১৩)
ভাবার্থ- নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু।
এই ত্বাক্কওয়া শব্দটি বিভিন্নভাবে আল কুরআনে মোট ২৫২ বার উল্লেখিত হয়েছে।
এই ত্বাক্কওয়া'ই মনুষ্য জীবনের সকল গুণাবলী তৈরী, নিয়ন্ত্রণ ও কর্মকান্ডকে পরিচালিত করে।
ত্বাক্কওয়া তৈরীর একমাত্র পন্থা রামাদ্বান। আর সে কারণেই প্রতিটি সুস্থ ও প্রাপ্তবয়ষ্ক মুসলমানের উপরে রোজা ফরজ করা হয়েছে।
সেই 'ত্বাক্কওয়া' অর্জনের মাস মহিমান্বিত রামাদ্বান!
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (সুরা বাক্বারা:১৮৩)
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা 'ত্বাক্কওয়া' অর্জন করতে পার।
হে আল্লাহ, এই মহিমান্বিত রামাদ্বানে আমাদের ভেতরে আপনার ভয়; ত্বাক্কওয়া জাগিয়ে দিন। হে আল্লাহ আমাদের চরিত্রকে আপনি এই ত্বাক্কওয়ার ভিত্তিতেই প্রকৃত ইসলামি চরিত্র হিসেবে তৈরী করে দিন ও তা অটুট রাখুন। আমিন !
বিষয়: বিবিধ
২১২২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রমাদান কারীম!
মন্তব্য করতে লগইন করুন