Renaissance, Reformation এবং Revolution। পৃথিবী বদলাচ্ছে। ইসলামি আন্দোলনের নেতা কর্মীরা কতটা প্রস্তুত?
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৭ মে, ২০১৪, ০৮:৪৩:০৭ রাত
বিশ্বটা আমাদের ভাবনার চেয়েও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে চেনা জানা এই বিশ্বটায় একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটছে। সভ্যতার ভিত্তিমূলে পরিবর্তন ঘটছে এবং সে ঘটছে খুব দ্রুত।
বিগত প্রায় পাঁচশটি বৎসর যে সভ্যতা বিশ্বকে দাপটের সাথে শাসন ও প্রভাবিত করে আসছে, সেটা ‘পশ্চিমা সভ্যতা’। ইংরেজিতে ‘ওয়েস্ট’। মোট তিনটা বিষয়; Renaissance, Reformation এবং Revolution কে কেন্দ্র করেই এ সভ্যতা গড়ে ওঠেছে, । মোটামুটি ১৫০০ খৃষ্টাব্দ সময়কাল থেকে এই সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ। পাঁচশত বৎসরেরও বেশী বয়সি এ সভ্যতা আর কতদিন চলবে? প্রশ্ন সেটাই।
জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রেনেঁসার সূচনা হয়েছিল, বিজ্ঞান তাকে একটা শক্তিশালী গতিময়তা দিয়েছে। ফলে জ্ঞান আর বিজ্ঞানের যৌথ সম্মীলন আর একসাথে হাত ধরাধরি করে চলার প্রেক্ষিতে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে ধারণাতীত পরিবর্তন হয়েছে মনুষ্য সমাজে।
তবে সে পরিবর্তন থেকে মানুষ কেবল কল্যাণই পায়নি বরং দূর্ভাগ্যজনকভাবে অকল্যাণও পেয়েছে। এ জন্য দায়ীও সে নিজেই। এটাকেই আজ কাল কেউ কেউ ‘বিজ্ঞানের অভিশাপ’ বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। বস্তুত জ্ঞান আর বিজ্ঞানের অভাবনীয় সম্মীলনে কল্যাণের পাশাপাশি একটা বিপর্যয়ও সূুচিত হয়। সে বিপর্যয়গুলোর মধ্যে প্রধান দ’ুটি হলো এক: নাস্তিক্যবাদ ও দুই: বিবর্তনবাদ।
এই মৌলিক বিপর্যয়ই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বিচ্যুতির পথে। এখান থেকেই শুরু ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ‘যুক্তিবাদ’ ‘কমিউনিজম’ ‘জাতিয়তাবাদ’ ‘বস্তুবাদ’ তথাকথিত ‘নারীস্বাধীনতা’ বা ‘নারীমুক্তি’র চেতনা এবং একেবারে হাল আমলের ‘সাম্যবাদ’। এই তথাকথিত ‘সাম্যবাদ’ বিরাট ভূমিকা রেখেছে ফরাসি বিপ্লবের গোড়াপত্তনে, ভূমিকা রেখেছে বলশেভিক বিপ্লবের জন্মতেও।
আর এই ফরাসি বিপ্লব কিংবা বলশেভিক বিপ্লব কিভাবে গোটা বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে তা বিশ্ববাসী নিজেদের চোখে প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছেন।
এসে গেল ‘বিপ্লবে’র কথা! বিপ্লবের কথা বলতে গেলে অনেক ‘বিপ্লব’ যেমন ‘ফরাসি বিপ্লব’ ‘বলশেভিক বিপ্লব’ এরকম খ্যাত-অখ্যাত অনেক বিপ্লবের নামই নিতে হবে। আর ‘বিপ্লব’ একের পর এক ঘটেছে, এখনও ঘটছে। আজ আমাদের সামনে ঘটে চলেছে ‘আরববিপ্লব’।
এইসব বিপ্লব তথা ‘Revolution’এর উপরে ভিত্তি করে পুরো বিশ্বসমাজে একের পর এক ‘Reformation’ ঘটেছে বিগত কয়েকটি শতাব্দী ধরে। এই ‘Reformation’ ই কাল হয়েছে বিশ্বের জন্য। পুরো মানবসভ্যতার জন্য। তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মুসলিম বিশ্ব। আর বৃহত্তর অর্থে এক শোচনীয় পরিণতির মুখোমূখি হয়েছে পূরো বিশ্বই।
মুসলিম বিশ্ব এই শোচনীয় পরিণতিতে নিমজ্জিত হবার আগে থেকেই ধীরে ধীরে ‘ইউরোপ’ এর উৎপত্তি। কিছু বিচ্ছিন্ন রাজ্য, ছোট ছোট ও পরষ্পর বৈরী সামন্তরাজ্য ক্রমেই একটি আদর্শিক চেতনার উপরে ভিত্তি করে গণমানসে ঐক্যের একটা ধারণা তৈরী হতে থাকে। আদর্শটি হলো ‘খৃশ্চিয়ানিটি’ বা ‘খৃষ্টবাদ’।
আন্দালুসীয় মুসলিম শাসনের পতনধারার পাশাপাশি উঠে আসতে থাকে একটি Renaissance, ইউরোপীয় রেনেসা। একটি রেনেসার জন্য যে মৌলিক শর্তের প্রয়োজন, সেই মৌলিক শর্ত ‘বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা’টি ইউরোপ পেয়েছে মুসলিম বিশ্ব থেকে, মুসলিম বিশ্বের বাগদাদ, দামেস্ক আর আন্দালুস থেকে। (সভ্যতার গঠন ও বিকাশে অন্যতম মৌলিক উপাদান। )
১০৯৫ সালে শুরু হওয়া প্রায় দু’টি শতাব্দী ধরে চলা রক্তক্ষয়ী ক্রুসেডের ধারাবাহিকতায় ইউরোপের সামনে জ্ঞান বিজ্ঞানের দূয়ার খুলে যায়। আব্বাসীয়, উমাইয়া এবং ফাতেমী খলীফারা যখন ভোগ বিলাসে এবং ক্ষমতার দ্বন্দ ও পারষ্পরিক হানাহানীতে লিপ্ত, ঠিক তখনই ধীরে ধীরে ইউরোপে অনেকটা মুসলিম বিশ্বের অজান্তেই ঘটেছে ইউরোপীয় পূনর্জাগরণ, ইউরোপীয় রেনেসা।
খৃষ্টবিশ্বাসই মূলত আজ যাকে আমরা পশ্চিম ইউরোপীয় ভূখন্ড বলে চিনি, এই ভূখন্ডে বসবাসরত পরষ্পর বিচ্ছিন্ন, বৈরী ও বিরুদ্ধভাবাপন্ন বিরাট জনগোষ্ঠিকে একটি বৃহত্তর ঐক্যের বলয়ে নিয়ে আসে। এই ঐক্যই কালক্রমে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্ম দেয়। আমরা এটাকেই অভিহিত করেছি Reformation হিসেবে।
সপ্তম শতাব্দী থেকেই মূলত Reformation এর এ ধারাকে বেগবান দেখা যায়। সময়ের পরিক্রমায় খৃষ্টবাদী সন্যাসীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে পূরো ইউরোপব্যাপী যে সাং®কৃতিক আবহ তৈরী হয়, তা ছিল নিরেট খৃষ্টদর্শন ভিত্তিক। এই সাংস্কৃতিক আবহের চাবিকাঠি ছিল খৃষ্টমতাদর্শী সন্যাসীদের হাতে। একজন ইংরেজ গবেষকের কথায়;
For a thousand years monasticism was to loom large in the cultural history of Europe; at times it dominated it. It is virtually impossible to imagine European culture without the monks. (THE TRIUMPH OF THE WEST. J Roberts. pp85)
পূর্ব ইউরোপে রোমকে কেন্দ্র করে খৃষ্টবাদ তার বিস্তৃতি ঘটাবার প্রয়াস যখন করেছে, ঠিক সে সময়েই আরবে ইসলামের আবির্ভাব। ইসলাম আরব, আফ্রিকা ও এশিয়াব্যাপী সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার কয়েকশত বৎসর পরে মুসলিম জগতে সৃষ্ট জ্ঞান আর বিজ্ঞানের ঢেউ এসে লাগে ইউরোপিয়ান সমাজে। মুসলিম আন্দালুসিয়ায় রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবক্ষয়ের পথ ধরে তা চলে আসে ইউরোপের হাতে। সেই একই মনীষীর কথায়;
By the end of seventh century, Roman Christianity was the dominant form in western Europe and its great achievement in the Dark Ages would be to make a whole new world which was Christian throughout from the debris of the classical past and the cultural gifts brought by the barbarians. (THE TRIUMPH OF THE WEST. J Roberts. pp85)
দেখা যাচ্ছে, এটা স্বীকৃত সত্য যে, সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে এসে রোমের খৃষ্টবাদই পশ্চিম ইউরোপে নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছিল, সে ধারাই শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের আনিত গৌরবোজ্জল সংস্কৃতিক ধারা এবং সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের ধ্বংসস্তুপের উপরে নতুন এক বিশ্ব, যা বরাবরই খৃষ্টবাদী ছিল, গড়ার সূচনা করল।
সোজা কথা হলো, ইউরোপিয়ান সভ্যতা বলে যে সভ্যতাকে আমরা জানি, তা আর কিছুই নয়, ইসলামি জ্ঞান আর বিজ্ঞানের পরিমার্জিত রুপকে ধারন করেই গড়ে উঠেছে। তারই স্বীকৃতি লেখক দিচ্ছেন এখানে।
এভাবেই সমাজে Reformation হচ্ছে। মাত্র ক’বৎসর আগে কমিউনিজিমের মৃত্যু দেখলাম। আরব জাতীয়তাবাদের মৃত্যুও দেখেছি জামাল আব্দুন নাসের, হাফেজ আল আসাদ, সাদ্দাম হোসেন গংদের শোচনীয় পরিণতিতে। ইউরোপ আমেরিকাসহ পুরো বিশ্বজুড়ে দেখছি পূঁজিবাদের মৃত্যুঘন্টাও।
বিশ্বব্যাপী একই সংস্কৃতিক বলয় তৈরীর যে প্রচেষ্টা পশ্চিমা সভ্যতা গত ক‘দশক ধরে চালিয়েছে, নিজেদের সরকার ও বৈশ্বিক সব প্রতিষ্ঠানের (আইএম এফ, ইউনিসেফ, জাতিসংঘ ইত্যাদি) মাধ্যমে, তাও ব্যর্থ হয়েছে, তা বোঝা যায় সারা বিশ্বজুড়ে অকল্পনীয় গতিতে ইসলামি পূনর্জাগরণের দিকে দৃষ্টি দিলে।
প্রশ্ন হলো, আজ যে বিশ্বরাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চিত্র স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, একটা বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই। শুরুটা কেবল হয়েছে। শেষটা কেমন হবে? কারা শেষ পর্যন্ত এর ফসলটাকে ঘরে তুলবে? এ প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে এবং আপতিত পরিবর্তনে নেতৃত্ব নিজেদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে বা অনূকুলে নিতে ইসলাামি আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা কী আদৌ প্রস্তুত? তারা কী আদৌ সচেতন? প্রশ্নটাই আজ সেটাই।
বিষয়: বিবিধ
২০৬৮ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়েছে মুসলিমরা। কিন্তু মুসলিমদের আগমনই হয়েছে 'যুগের প্রবাহমান স্রোতকে তাদের আদর্শের (ইসলাম)দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।' বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি তার নিজস্ব গতিতে চলবে। যদি মুমিনরা সত্যিকারের মুসলিমে পরিণত হতে পারে তাহলে এই প্রযুক্তিও মুসলিমদের হাতেই পরিচালিত হবে। ইতিহাসই তার প্রমাণ। অতএব যে সব ভাইয়েরা ঈমাণ এবং আমলকে বাদ দিয়ে কিংবা কম গুরুত্ব দিয়ে শুধু মাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি গুরুুত্বারপ করতে চান তারা নিশ্চয় মহান আল্লাহর বাণী ''তোমরা ভয় কর না, চিন্তা করো তোমরাই বিজয়ী হবে যদি মুমিন হও।' উপলব্ধি করতে পারে নি।
1.Materialism
2.Indvidualism
3.Capitalism
4.Expantionism.
এগুলো একত্রে করলে যেটা দাঁড়ায়, তা হলো 'Mice'তথা ইঁদুর। এই ইঁদুরের কারণেই মুসলিম বিশ্বই কেবল নয়, বরং পুরো বিশ্বই তছনছ হয়ে গেছে। এতে কেবল মুসলমানরাই নয়, বরং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষই চরম ভোগান্তির শিকার হয়ে চলেছে।
‘‘সোজা কথা হলো, ইউরোপিয়ান সভ্যতা বলে যে সভ্যতাকে আমরা জানি, তা আর কিছুই নয়, ইসলামি জ্ঞান আর বিজ্ঞানের পরিমার্জিত রুপকে ধারন করেই গড়ে উঠেছে। তারই স্বীকৃতি লেখক দিচ্ছেন এখানে। ‘‘ আমরা মুসলমানরা এটা নিয়েই বেঁচে আছি। এর সাথে তুলনা করা চলে বাংলাদেশের আলীগ-বিএনপির অবস্থানকে। অতীতের স্মৃতি-রোমন্থন অবশ্যই সুখকর। কিন্তু আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। লেখকের শেষ কথা এটাই। এ জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ। আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে কি করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। একবিংশ শতাব্দী তুলনামূলক ভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে। অতীতে এত দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু আমরা কি এর সাথে তাল মিলিয়ে বদলাতে পারছি? না কি অতীতকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে তৃপ্তি পাচ্ছি? একশ বছর আগে, পাঁচশ বছর আগে যে চিন্তা ও কর্মকৌশল মানুষকে উদ্বেলিত করেছে সেগুলো এখন মৃতপ্রায়। একবিংশ শতকের প্রয়োজন তা পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু আমরা কি আমাদের চিন্তা ও কর্মকৌশলকে পূনর্মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত? প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনী এবং বিশ্লেষণী কৌশল কি আমরা রপ্ত করেছি?
মন্তব্য করতে লগইন করুন