ইসলামি ছাত্র শিবির; এক নব্য রাজাকারের আর্তনাদ!!
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৯ অক্টোবর, ২০১৩, ০৮:৪১:১০ রাত
চোখের সামনে সব কিছুই বদলে যাচ্ছে। সমাজ বদলে যাচ্ছে, চেনা জানা পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে মানুষগুলোও। বদলে যাচ্ছে মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনার জগৎ, ভালো মন্দের মাপকাঠী, বদলে যচ্ছে শত্রু মিত্রের চিরায়াত ধারনা। সবকিছু বদলে যাচ্ছে দ্রুত, খুবই দ্রুত, অকল্পনীয় দ্রুত গতীতে বদলে গেল বাংলাদেশ!
একদিন যে সমাজে নীতি ছিল, নৈতিকতা ছিল, ছিল মুল্যবোধ, ছিল ভালকে ‘ভাল’ আর মন্দকে ‘মন্দ’ বলা এবং তা মানার মত নৈতিক সাহস, মাত্র চারটি দশকেই তা যেন সব হারিয়ে গেল! এখন আর ভালকে ভাল, মন্দকে মন্দ বলা যায় না, যদি না সেই বলার পেছনে নিজের বা নিজেদের কোন স্বার্থ থাকে।
ছোটকালে পাড়া গাঁ’র পন্ডিত মশাইরা, যাদের বি এ, বি এড ডিগ্রী কিংবা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের চোখ ধাঁধাঁনো সার্টিফিকেট, কিছুই ছিল না, শিখিয়েছিলেন ‘সদা সত্য কথা বলিবে, কখনও মিথ্যা বলিবে না’।
আজ এত বড় বড় ডিগ্রীধারীরা কেউ আর সেই কথাগুলো শেখান না। কেউ বলেন না ‘যে কোন অবস্থায় গুরুজনকে মান্য করিবে’। কেউ না। গুরুজন? সে ব্যাটারা আবার কে? তার সাথে আমার বা আমাদের কি সম্পর্ক? আমাকে নিয়ে তার বা তাঁকে নিয়ে আমারই বা মাথা ব্যথা কিসের?
প্রায় চল্লিশ বৎসর আগের এক সন্ধায়, আব্বা বাসায় না থাকার সুবাদে বাড়ীর সামনের রাস্তায় খেলছিলাম, মাগরিবের নামাজ পড়ে নিজ বাসা অভিমূখে গমণরত আব্বার বয়সি এক মুরুব্বী তা দেখে থেমে নাম, বাসার নম্বর, বাবার নাম জেনে নিয়ে কানটা আচ্ছা করে মলে এক ধমকে বাসায় পাঠিয়েছিলেন! বলেছিলেন; এখনই গিয়ে পড়তে বসবে! কেবল তাই নয়, যতক্ষণ না বাসার ভেতরে ঢুকেছি, ততক্ষণ তিনি ঐ রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাসার ভেতরে ঢুকেছি, নিশ্চিত হয়েই তিনি নিজের পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
অথচ তিনি ছিলেন কেবল একই কলোনীর বাসিন্দা, একজন মুরুব্বী মাত্র। তার হাতে কান মলা খেয়ে, স্বাধের খেলা ছেড়ে আসাতে মনে হয়নি যে, আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন তিনি। তিনি আমার উপরে অনাধিকার চর্চা করেছেন, তেমনটা ভাবিও নি কখনই। আম্মাকে দেখেছি যারপরনাই খুশী হতে সে দৃশ্য দেখে!
জানি না, আজকের কোন মা অপরের হাতে তার সন্তানের কান মলা ও বকুনি খেতে দেখে খুশী হবেন কি না। জানি না, আজ সেরকম কোন অপরিচিত মুরুব্বী পাড়ার কোন কিশোরকে কান মলা দিয়ে পড়ার টেবিলে যেতে বলার সাহস পাবেন কি না।
আজ দিন বদলেছে, বদলেছে স্বাধীনতা আর অধিকারের সঙ্গা এবং পরিধিও! নাগরিক দায়িত্ববোধের সংগা আর সীমা আজকের বি এ, বি এড’রা ভাল বলতে পারবেন, সে সংগার সীমা আর পরিধি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কর্ণধাররাই ভাল বলতে পারবেন! আমরা অজ্ঞ, মূর্খ, সে সবের কি বুঝি?
হোম ওয়ার্ক আর হাতের লেখা ভালো করার ছলে, খাতা ভরে একই কথা বার বার লিখতে দিয়ে শিখিয়েছিলেন ‘পরের ধন আত্বস্বাৎ করিবে না।’ সততাই চরিত্রের ভূষণ’ ‘জ্ঞানই শক্তি’ ‘চরিত্র অমূল্য সম্পদ’ এসব নীতি কথা।
আজ আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়। ওসব সেকেলে পদ্ধতি আজ অচল! অচল বলেই বোধ করি, এখন এসব নীতিকথা যারা বলেন, তারাও অচল, সমাজে তাদের কোন দাম নেই। প্রয়োজনও নেই!
আর সেই কারণেই কি না জানি না, আমাদের নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে, যুবক যুবতীরা কেউ এসব নীতিকথার ধারও ধারেন না। সত্য কথা বলা, নিরেট বোকামি ছাড়া আর কি?
গুরুজনকে মান্য করা? সে তো আমার মানবাধিকারের জঘণ্যরকম অপমান! আমার স্বাধীনতার প্রতি চরম অবজ্ঞা!
আমরা যে স্বাধীন! আমরা স্বাধীন বলেই না আমাদের যুবকেরা, তরুণে’রা দিন রাত, যখন তখন হাতে গাঁজা বা ফেন্সিডিল আর মদের বোতল নিয়ে ঘুরতে পারে। নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম! আমরা কিছুই বলতে পারি না। কারণ, সেটা তাদের ব্যক্তিগত জীবন! সেখানে বাধা দেবার কোন অধিকারই আমাদের নেই, সেটা অনাধিকার চর্চা!
আমরা স্বাধীন বলেই না, আমাদের মা বোনে’রা মানবতাবাদী না হয়ে ‘নারীবাদী’ হতে পেরেছেন। তারাও বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতার স্বাদ নিতে চান পুরোপুরি! তারা চলনে স্বাধীন, বলনে স্বাধীন। তারা আচারে আচরণেও স্বাধীন! স্বাধীন, চিন্তা আর চেতনাতেও! লজ্জা এখন আর ভূষণ নয়, বরং নারী নির্যাতনের হাতিয়ার! তাই দিন বদলের দিনে বদলে গেছে শোষণ, শাসন আর ভূষণের সংগাও!
এখন তসলিমা, প্রভা আর কানিজ আলমাস’রা লজ্জা ছুঁড়ে ফেলে দিলে হয় বরিত, সেলিব্রিটি! লজ্জা ধরে রেখে আমার মা-বোন পরাধীন হয়ে আছেন এখনও! এখনও স্বাধীন হতে পারেন নি! তাই তাদের যখন তখন কারান্তরে যেতে হয়!
লজ্জা বিসর্জন দিয়ে জিন্স আর টপ পরতে, ওড়না হিজাব ছাড়তে পারেন নি বলেই তারা স্বাধীনতার স্বাদ পান নি!
স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে বাঁধনরা, পেয়েছে তসলিমা, পেয়েছে আজকের রুমানা, আর ফারজানা’রা। তারাই আমাদের আগামি প্রজন্মের রোল মডেল!
এই ‘স্বাধীনতা’র কথা বলেই চারিপাশ বদলেছে। সব কেমন অচেনা, অজানা লাগে আমাদের মত ‘ব্যাক ডেটেডদের’ কাছে! আমরা যে লুটে পুটে খাবার মহোৎসব দেখে, দেশটাকে ভাগাড়ে পরিণত করার মহোৎসব দেখে রাত দিন তাড়িত হই, এ আমাদের পশ্চাৎপরতা, সেকেলে চিন্তা চেতনার ফল, আর কিছুই নয়! ওদের প্রগতির প্রতিক্রিয়ায় হিংসা আর পশ্চাৎপরতার কারণে আমরা ‘প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি’। দিন বদলের দিনে আমাদের কোন ঠাঁই নেই এই সমাজ, এই দেশে!
স্বাধীকার আর প্রগতির জন্যই স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা যেহেতু পাশাপাশি চলতে পারে না, তাই আমরা অচল! আমরা স্বাধীনতাবিরোধি! এদেশে আমাদের কথা বলার কোন অধিকার নেই! দেশটাকে করদ রাজ্য বানানো হোক, কোন কথা বলতে পারব না। বললেই আমরা স্বাধীনতা বিরোধি, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি, রাজাকারের বংশধর!
কেউ যদি রাতারাতি পদ্মা সেতুর বাজেট খেয়েও ফেলে, তাতে আমাদের কি? আমাদের কোন কথাই বলার অধিকার নেই। কেউ যদি আমার দেশের বুক চীরে রাক্ষুসে রাবনের পথ বানায়, তাতে আমার কি? আমি কোন কথা বলতে পারব না। কারণ, আমি রাজাকার না হলেও তার বংশধর!
কেউ যদি আমার সোনার বাংলার প্রাণশক্তি সকল নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে দেশটাকে মরুভূমি বানায়, তাতেও আমার কোন কথা বলার অধিকার নেই। কারণ, আমি ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল রাজাকারের চেলা! কেউ যদি আমার বোন ফেলানী’কে মেরে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে, কেউ যদি আমার মা, আমার বোনকে বাজারে ওঠায়, তার পরেও আমি কোন কথা বলতে পারব না! আমার কোন অধিকারই নেই কথা বলার! আমি যে প্রতিক্রিয়াশীল রাজাকারের বংশধর!
স্বাধীন দেশে আমার বাক স্বাধীনতা নেই! কারণ, আমি মানতে পারি না। মানাতে পারি না নিজেকে ঐ বদলে যাওয়ার দর্শনের সাথে! ‘বদলে যাওয়া’ কিংবা ‘বদলে দেবার’ চটকদার শ্লোগাণের সাথে সাথে নীতি বদলাতে পারিনি। নৈতিকতা বদলাতে পারিনি। পারিনি বদলাতে নিজেকেও!
আমি যে এখনও বুকের গহীনে আঁকড়ে ধরে আছি আমার প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলার সেই শ্বাশত রুপটাকে, যার পরতে পরতে মিশে আছে শাহজালাল, শাহপরানের স্মৃতী, মিশে আছে ফকির মজনু শাহ কিংবা বারো আউলিয়ার দর্শন, মিশে আছে শহীদ তিতুমীরের শাহাদাতের তামান্না। মিশে আছে বখতিয়ারের মুক্তির পয়গাম!
তাই আমি অপাংক্তেয়, পরিত্যাজ্য একজন! আমার কোন অধিকার নেই! প্রতিবাদের অধিকার নেই, প্রতিরোধের অধিকারও নেই। সুযোগও নেই চিৎকার করে বলার ‘ও আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’! আমি রাজাকারের বংশধর, বাংলাকে ভালবাসার কোন সুযোগ আমার নেই!
আমরা যে স্বাধীন! স্বাধীনতার যাদুকরি ছোঁয়ায় পূরোনো সেকেলে সব কিছুই আজ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়! নীতি ক্ষয়ে যায়, নৈতিকতা ক্ষয়ে যায়। ভালবাসা দয়া-মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতি এসবের চিরায়ত ধারণাগুলো সব ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। ক্ষয়ে যায় দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহিতার ধারনাও!
স্বাধীনতার এই চমকপ্রদ ছোঁয়ায় ঘরে বাইরে সবখানেই কেবল রক্তক্ষরণ! তরতাজা যুবকের বুকের রক্ত থেকে শুরু করে ব্যাংকের ডলার, পদ্মা-তিস্তার পানি থেকে ব্যবসা বাণিজ্য আর শেয়ার মার্কেটের কলমানি, সবখানেই কেবলই ক্ষয়! চিন্তা-চেতনায় ক্ষয়, মন-মননেও ক্ষয়।
জনান্তিই কেবল জানেন, আর আমিও জানি, মিরপুর কিংবা রায়েরবাজারে, পদ্মা-মেঘনা, সূরমা-যমুনার অববাহিকায়, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূখন্ডে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ শহীদের উত্তরসূরী কোটি কোটি নব্য রাজাকার আজও সেজদায় পড়ে আল্লাহু আকবার জপে চলার পাশাপাশি সদাই অন্তরে হেঁকে চলেছেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’
বিষয়: বিবিধ
১৮৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন