'রাণী, মানুষ খুনের দায়ে তোমাকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিচ্ছি।’ - অশ্রুসিক্ত নয়নে রাণী নুরজাহানকে বাদশাহ জাহাঙ্গীর। (ইতিহাসের পাতা থেকে)
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৮ আগস্ট, ২০১৩, ১০:০০:২৩ রাত
বাদশাহ জাহাঙ্গীর। প্রতাপশালী বাদশাহ আকবরের সন্তান। বাদশাহ আকবর ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে কেমন আচরণ করেছে, তা বিশ্ববাসী জানেন!
তার এইসব ইসলাম বিরোধি কর্মকান্ড ও পরিকল্পনা ভারতীয় মুসলমানরা রুখে দিয়েছেন, নিজেদের জান, মাল বিলিয়ে, শত নির্যাতন সয়েও! মুসলমানদের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র: )। যাঁর আল্লাহ্ভীতি আর সাহস ছিল রুপকথার মত! সারা ভারতে হিন্দু-মুসলমান সকলেরই অতি শ্রদ্ধার পাত্র। তার সিংহাসন, সৈন্য বাহিনী বা প্রশাসন ছিল না, নিতান্তই ফকির মানুষ। অথচ তার একটি মাত্র ইশারায় ভারতের কোটি কোটি হিন্দু, মুসলমান নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল।
আকবরের পর তার পুত্র জাহাঙ্গীর ক্ষমতায় বসেন যিনি পিতার সাথে এই ফকিরের সংঘাতের কথা খুব ভালো করেই জানতেন। তিনিও এই ফকিরকে শায়েস্তা (!) করতে তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। এবারেও একইভাবে জাহাঙ্গীরের সৈন্যবাহিনীসহ সভাসদরা বিদ্রোহ করে। সম্রাট বাধ্য হয়ে তাঁকে মুক্তি দেন, তদূপরি তিনি নিজেই তাঁর মুরীদ হয়ে স্বীদ্ধান্ত নেন, এখন থেকে তিনি একজন প্রকৃত মুসলমানের ন্যায় দেশ শাসন করবেন। একজন প্রকৃত মুসলমানের মত জীবন কাটাবেন! ঘটনাটি এর পরে।
রাণী নুরজাহান। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী। খাস্ বাঁদী পরিবেষ্ঠিতাবস্থায় অন্দরমহলে বসে বনজ ও ভেষজ অনুষঙ্গের সাথে কস্তুরীর মিশ্রণে তৈরী সৌন্দর্যবর্ধক লোশন গায়ে মাখছিলেন। বাঁদী তার পাশেই নির্দেশ পালনার্থে তৈরী। হঠাৎ এক অপরিচিত যুবক একেবারে অন্দরমহলে, তারই দিকে হা করে তাকিয়ে! অর্ধবসনা রাণী রাগে, ক্ষোভে, অপমানে উঠতেও পারেন না! কারণ পুরো শরীর বিবস্ত্র হয়ে পড়ার উপক্রম! অথচ ব্যাটা অসভ্য আগন্তক রাণীর ক্ষোভ আর লজ্জাকে উপেক্ষা করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে তাঁর সৌন্দর্য দেখছে!
রাণী নুরজাহান এতটাই সুন্দরী ছিলেন যে, জাহাঙ্গীর তার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাঁকে নুরজাহান বা ‘ জগতের আলো’ উপাধি দিয়েছিলেন! আর তারই প্রতি এই বেয়াদবী! রাণী তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাশেই পড়ে থাকা বন্দুকটি তুলে আগন্তক’কে লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলেন গুলি! আর ঐ এক গুলিতেই ছেলেটি মারাও গেল। সারা রাজবাড়ী জুড়ে হৈ চৈ।
জাহাঙ্গীর বিশ্রামে। তার নির্দেশে রাজবাড়ীর ফটকে সর্বসাধারণের জন্য টানিয়ে রাখা ঘন্টায় টান পড়ল এমন সময়। একজন সাধারণ প্রজা জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়! পেয়াদা মারফত তাকে ডাকিয়ে আনা হলো। বিচারপ্রার্থী একজন হিন্দু প্রজা, তার অভিযোগ, মস্তিষ্কবিকৃত তার সন্তানকে রাজবাড়ীর ভেতরেই কেউ গুলি করে মেরেছে। তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান। তাৎক্ষণিকভাবেই তদন্তে জানা গেল, স্বয়ং রাণী-ই অনাধিকার প্রবেশের দায়ে ছেলেটিকে গুলি করে মেরেছেন। নিহত ঐ যুবকটিই বৃদ্ধ হিন্দু প্রজার সন্তান।
ঘটনা জেনে জাহাঙ্গীরের হতবিহ্বল! আর সেই বৃদ্ধও কোনমতে পালানোর পথ খুঁজতে ব্যস্ত। স্বয়ং রাণীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ যাবে, জানলে কি সে আসত বিচার চাইতে? এখন বিচার তো দুরের কথা, নিজের জীবন নিয়েই টানাটানি!
জাহাঙ্গীর ঘোষণা করলেন; তিনি হত্যাকান্ডের বিচার করবেন। রাণীকে তলব করা হলে সম্রাটের প্রশ্নের জবাবে তিনি আদ্যোপান্তই জানালেন, হত্যার ঘটনাকে অস্বীকার করলেন না। তবে তিনি জানতেন না, ছেলেটি মস্তিষ্কবিকৃত। রাণীই ছেলেটিকে হত্যা করেছেন, তা প্রমাণিত। জাহাঙ্গীর চুপচাপ অনেকক্ষণ ভাবার পরে রায় ঘোষণা করলেন;
‘রাণী, তুমি জানতে বন্দুকে গুলি ভর্তি, এবং জেনে বুঝেই গুলি করেছ, মস্তিস্ক বিকৃত হলেও তাকে খুন করতে পার না। কিন্তু হায়, তুমি খুনী। রাণী তোমাকে মানুষ খুনের দায়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিচ্ছি।’
রাণী নুরজাহান ক‘দিন ধরেই জাহাঙ্গীরের চরিত্রে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন। আজ এই রায় যে সেই পরিবর্তনেরই বাস্তব প্রকাশ, তা বুঝতে পেরে তার অন্তর কেঁপে উঠল আসন্ন মৃত্যুভয়ে, চোখের সামনে ভেঁসে উঠল ফাঁসির দড়ি! কেঁপে উঠলেন সভাসদরাও। রাণীর মৃত্যুদন্ড! এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন বিচারপ্রার্থী বৃদ্ধ! নিহত যুবকের পিতা, জাহাঙ্গীরের হিন্দু প্রজা।
নুরজাহান প্রাণের মায়ায় এগিয়ে এলেন। করজোড়ে জাহাঙ্গীরের কাছে তার প্রাণভিক্ষার আবেদন জানাতে ‘মহারাজ, একবার আমার ভালোবাসার কথা, আপনার জন্য আমার ত্যাগ, আর প্রেমের কথা স্মরণ করুন! আমাকে দয়াকরে প্রাণ ভিক্ষা দিন। রাণীর গলা আড়ষ্ঠ, কম্পমান। ঠিকমত কথা বেরুচ্ছে না! চোখে ঝরে চলেছে অশ্র“ ধারা। জাহাঙ্গীর নুরজাহানের কথায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্র“ লুকোতে লুকোতে জবাব দিলেন;
‘রাণী, ভেবো না আমি তোমাকে ভালোবাসি না, বা তোমার ভালোবাসার কথা ভুলে গেছি! রাণী, একদিকে বার বার তোমার ভালোবাসার কথা মনে করছি, আর একদিকে মনে করেছি মহান আল্লাহর নির্দেশ! প্রতিবারেই আমার মনে আল্লাহ্র ভালোবাসাই প্রবল হয়ে উঠছে। তার নির্দেশ অমান্য করতে পারব না।’
জাহাঙ্গীরের গলা ধরে এলো! রাণীর চোখে চোখ রাখতেও যেন সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও মূখ খুললেন;
‘রাণী, হত্যার অপরাধে তোমাকে মৃত্যুদন্ড নিতেই হবে। এখানে আমার করার কিছুই নেই। হ্যাঁ, আমি তোমাকে আজও সেই আগের মতই ভালোবাসি। তোমার অবর্তমানে আমার জীবন মরূভূমি হয়ে যাবে, সে দু:খটুকুও সইব কিন্তু কিছুতেই ন্যায়বিচারের পথ হতে সরে আসতে পারব না!’
জাহাঙ্গীর এবারে আর নিজেকে সামাল দিতে পারলেন না। তিনি রাণীর আসন্ন বিয়োগ ব্যাথায় বাকরুদ্ধ। এতক্ষণ রাজসভার এক কোণে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা সেই বৃদ্ধ নাটকীয় এসব দৃশ্য দেখছিলেন। নিজের চোখ, কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনিও কাঁদছেন। এবারে এগিয়ে এলেন, বললেন;
‘মহারাজ, মাফ করবেন। আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একি দেখলাম! বিচারক নিজ স্ত্রী’কে মৃত্যুদন্ডাদেশ শোনাবার সাথে সাথে একথাটিও বলে দেয় ‘তোমাকে আগের মতই ভালোবাসি, তোমার অবর্তমানে আমার জীবন মরুভূমি হয়ে যাবে, সে দু:খও আমি সইব কিন্তু অবিচার করতে পারব না!’
মহারাজ আমার কলিজার টুকরো, সে তো মরেই গেছে, আর কোনদিনও ফিরে পাব না! কিন্তু মহারাজ আমি এমন ন্যায়বিচারক বাদশাহ, এমন রাণীর জীবনকে মরুভূমি হতে দিতে পারি না। মহারাজ, আমি রাণীকে ক্ষমা করে দিলাম! দয়া করে আপনিও তাকে ক্ষমা করে দিন, মহারাজ তার প্রাণ ভিক্ষা দিন। ধন্য এমন ধর্ম, যেখানে আসামি আর বিচারক একই সাথে গলা ধরাধরি করে কাঁদে!’
দু:খের বিষয় হলো, জাহাঙ্গীর বেশী দিন তার এই অবস্থানকে ধরে রাখতে পারেন নি। তবে যে স্বল্পকাল তিনি ইসলামের নিষ্ঠাবান অনুসারী ছিলেন, তারই মাঝে ঘটেছিল এই চিত্তাকর্ষক ঘটনাটি!
(সুত্র: টাইন নদীর ওপার থেকে, পৃষ্ঠা- ৪৪-৪৭)
বিষয়: বিবিধ
২৫০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন