'ঈদ' কি একবারও আসবে না এ জীবনে?
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০৯ আগস্ট, ২০১৩, ০৮:০২:৩৬ রাত
এরই মাঝে ঈদ এল। এক মাস কঠোর সিয়াম শেষে খুশী ঈদ। ঈদ এলেই আমার মন খারাপ হয়। এটা নতুন নয়, গত অন্তত কুড়িটি বৎসর ধরেই এ সমস্যা আমার। ঈদ আসে খুশীর জন্য, কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, আমি খুশী হতে পারি না। অথচ একটা সময় ছিল, ঈদের জন্য কত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি! কত প্লান করেছি ঈদকে নিয়ে। অপেক্ষায় থাকতাম কবে আসছে আমাদের মাঝে ঈদ?
এখনও তো কত লোকে ঈদের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। আমাদের অনেকের, বিশেষ করে, শিশু কিশোরদের তো ঘুমই হয় না ঈদের অপেক্ষায়? কিশোরী, তরুণীরা ছোটে মেহেদি জোগাড়ে। আর শিশুরা বাবা-মা’র কাছে নতুন কাপড়ের বায়না, ঈদের বখশিশ নেবার অংক মেলাতে! আমরা ছেলে বুড়ো সকলেই ভীড় করে তাকিয়ে থেকেছি আকাশ পানে, ঈদের চাঁদ, খুশীর চাঁদটাকে এক নজর দেখতে।
খুশীর চাঁদ আমাদের মাঝে ঈদ আনে। আমরা পরিবার-পরিজন, আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব নিয়ে মেতে উঠেছি ঈদের খুশীতে। সেই ঈদ-ই চলে এল, আবার তা চলেও যাবে। কারো মাঝে তা আবারও আসবে যথা সময়ে, যে ভাবে এসেছিল এর আগের বৎসর গুলোতেও।
কিন্তু ঈদ এলেই আমার মন খারাপ হয়। হয়ত নিজের ব্যর্থতা, দায়িত্বহীনতাটা আবার মনে পড়ে বলেই এমন হয়। লজ্জা পাই। নিজেকে ছোট মনে হয়, অপরাধী মনে হয়। অথচ এই অনুভূতিটাকে চাপা দিয়েই খুশী’র ভান করতে হয়। খুশী হতেই হয়!
ঈদ মানেই’তো খুশী। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় পার্বণ, আনন্দানুষ্ঠান। আবারও চলে এলো। আবারও সেদিন নতুন কাপড়ে, নতুন সাজে, আতর, সুগন্ধীর মিষ্টি গন্ধে পথ মাতিয়ে ছুটেবে সবাই ঈদগাহে। বাড়ির আশে পাশে মৌ মৌ করবে পোলাও, বিরিয়ানী, কোরমা, ফিরনী জর্দাসহ নানান রুচীকর খাবারের লোভনীয় গন্ধ। আবারও রাঁধুনীরা সেদিন ব্যস্ত হবেন রান্নায়। ধনাঢ্যরা ছুটবেন বাজারে, আধুনিক শপিংমলগুলোতে। অনেকের আবার এইসব শপিংমলগুলোতে পোষাবে না। তারা ছুটবেন ব্যংকক, কুয়ালালামপুর, দিল্লী, সিংগাপুর, দুবাই, লন্ডন’এ ঈদের বাজার করতে!
ইংল্যন্ড, আমেরিকা সিংগাপুর, মধ্যপ্রাচ্যের শেখ শাসিত আরব দেশের মত ধনী দেশগুলোর মত ঈদ আসবে বাংলাদেশের মত গরীব দেশগুলোতেও। যে সুদান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়ায় ক্ষুধা মানুষের নিত্য সঙ্গী, যে নাইজার-এ প্রতিদিন মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, সেই সব ‘শ্বশ্মান’এও ঈদ আসবে। আবার চলেও যাবে। যে ইরাক, যে আফগানিস্থানে নিত্যই মৃত্যু আর হত্যার উন্মাদনা, সেখানেও ঈদ আসবে! ঈদ মানেই তো খুশী। অতএব ‘ঈদ’ আসা মানেই ‘খুশী’ আসা!
সত্যিই কী তাই? সত্যিই কি ইরাক আর আফগানিস্থানে, যেখানে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় মুসলমান নারী, পুরুষ, শিশু, আবালবৃদ্ধবনীতার রক্তে রাজপথ ভাঁসছে, সেখানে ঈদ বা খুশী আসবে?
সত্যিই কি নাইজারের যে মা কোলের শিশুকে এক ফোটা দুধের অভাবে তীলে তীলে মরতে দেখেছেন, যে বাবা সদ্যমৃত সন্তানকে কবরে শুইয়ে এসেলেন অথচ তার বাড়ীর আঙিনায় এখনও লাশ ধোয়ানোর পানিটুকুও শুকোয়নি, তার বাড়ীতেও ‘ঈদ’ ‘খুশী’ আসবে কি ?
যেসব তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বিনা চিকিৎসায় তীলে তীলে মরছে, খড়পাতার বিছানায় শুয়ে বুকের গভীর থেকে টেনে তুলছে থোকা থোকা রক্ত, নি:শেষ করে দিচ্ছে তীল তীল করে জীবনীশক্তি, শুধুমাত্র একটু ঔষধের অভাবে, একজন ডাক্তারের অভাবে, তাদের জীবনেও কি ঈদ আসবে?
ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, বসনীয়া, কাশ্মীর আর মিন্দানাও এর মুসলমানদের জীবনেও কি ঈদ আসবে? নামবে কি খুশীর ঢল? সত্যিই কি মৃত্যু উপত্যকায় এক সীমাহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে এইসব হতভাগ্য মুসলমানরা ক’দিন পর আর দশজন মুসলমানের মতই ‘ঈদ’এর ‘খুশী’তে মেতে উঠবেন?
‘ঈদ’ ধর্মীয় উৎসব। এর বহুমাত্রিক প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে প্রাথমিকভাবে মুসলমানদের, এবং চুড়ান্ত বিচারে পুরো মানবসমাজের প্রতিটি সদস্যের মনোজগতে। এর একটি আদর্শিক দিক রয়েছে। রয়েছে নৈতিক শিক্ষা। ‘ঈদ’ সামাজিক উৎসবও বটে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব। কাজেই পুরো সমাজ, পুরো সমাজ ব্যবস্থা, সমাজের ছোট, বড়, ধনী, গরীব প্রত্যেকের উপরে এর প্রভাব এড়ানো যায় না। যাবার কথাও নয়।
এর প্রমাণ দেখতে পাই সেই প্রাথমিক যুগের মুসলিম সমাজের ঈদ অনুষ্ঠানের দিকে নজর দিলে। খোদ রাসুলুল্লাহ স: এঁর জীবনেই দেখেছি, তিনি ঈদের দিন ক্রন্দনরত এতিমকে কাছে টেনেছেন। নিজের পরিবারেই আশ্রয় দিয়ে তাঁকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পূনর্বাসিত করেছেন। একজন অখ্যাত, হতভাগা, পথশিশু এতিমকে তুলে এনে সৌভাগ্যবান বানিয়েছেন।
আমরা যারা আজ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে সেই মহান মানবসত্তা রাসুলুল্লাহ (সা কে পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের কথা বলি, তাঁর উম্মত হিসেবে তুলে ধরি, তারা মহান রাসুল (সা এঁর জীবন থেকে কোন শিক্ষাটুকু নিলাম? তিনি ঈদের দিনে, ঈদের খুশী যেভাবে একজন অনাথ এতিমের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন, আমরা ক’জনে তেমনটা করলাম? ক’জনে তেমনটা করব?
আমাদের দেশে ঈদের দিনেও কত এতিম, অনাথ, ভূখা-নাঙ্গা অভূক্ত পড়ে থাকছে রাস্তায়, ষ্টেশনের প্লাটফরমে, লঞ্চঘাটে, পার্কে, গাড়ির বারান্দায়। আমরা তো উল্টো এইসব ঠিকানাহীন শিশুদের মাড়িয়ে, দু’পা এ দলে ছুটেছি ‘ঈদ’ করতে!
আমাদের দিকে বুকভরা আশা নিয়ে এইসব শিশু, এতিম, অসহায় নারী-পুরুষরা তাকিয়ে আছে, আমাদের দৃষ্টিতে, আমাদের চেতনায় তা ধরা পড়ে না! কারণ আমরা খুব ব্যস্ত ছুটে যেতে, পাছে না আবার গাড়ী ফেল করি! পাছে না আবার জামাত ফেল করি!
সবাই তার নিজ নিজ পরিবার পরিজনদের কাছে ছোটেন। আমরাও ছুটেছি। সেটাই স্বাভাবিক, জীবনের স্বতস্বিদ্ধ দাবীও বটে। দোষের কিছুই নেই। কিন্তু ছোটার পথে সেইসব হতভাগাদের, যাদের পরিবার পরিজন নেই, যাদের আবাস নেই, ছুটে যাবার জায়গা নেই, তাদের অবজ্ঞা করেছি, ভ্র“ক্ষেপও করিনি, চোখ তুলেও চেয়ে দেখিনি! ভাগের সুযোগ আর রসদ থাকায় ঈদের আনন্দমূখর দিকটিকে গ্রহণ করেছি পূর্ণমাত্রায়।
অথচ তার বিপরিতে এর নৈতিক আর সামাজিক দিকটিকে অবজ্ঞা করেছি পুরোপুরিই। মানুষ, বিশেষ করে, একজন মুসলমান হিসেবে নিশ্চয়ই সেটা দ্বায়িত্বহীনতারই পরিচয় নয় কেবল, এটা পাপও বটে। এই পাপবোধই আমাকে কুরে কুরে খায়। নিজেকে যে অপরাধী মনে হয়, সেটা একারণেই। ঈদ এলেই মনে পড়ে যায়, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি, করছি না।
মনে পড়ে যায়, কত শিশু ঈদের দিনেও একটা ফোটা দুধের জন্য গলা ফাটিয়ে কাঁদবে, কত মা, কত বোন এক টুকরো কাপড়ের অভাবে ঘরের বাইরে বেরুতে পারবে না। কত বনী আদম আশে পাশেই না খেয়ে অভূক্ত থাকবে। তাদের কোন খোঁজ খবর না নেওয়াটা পাপ।
এই পাপের জন্য মুসলমান হিসেবে একদিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতেই হবে। কি জবাব দেব সেদিন? কোন মুখ নিয়ে সেদিন দাঁড়াব এই আমি, যে আমি ঈদের নামে আনন্দ-উল্লাসে মজেছি, ভোজনে, উচ্ছাসে মেতেছি। কিন্তু সমাজের এতিম অনাথদের দিকে তাকাইনি, কেবল ক’টা টাকা ‘ফেতরা’ দিয়েই দায় সেরেছি!
জবাব দিতেই হবে। যাঁর উম্মত হবার দাবীদার আমরা, সেই মহানবী রাসুলুল্লাহ (সা এঁর জীবনের ‘ঈদ’ থেকে আমাদের ‘ঈদ’ কেন ভিন্নতর হয়েছিল? সে প্রশ্নের। রাসুল (সা যদি রাস্তার এতিমকে বাড়ী নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারেন, তবে তাঁর উম্মত দাবীদার আমরা কেন তা পারলাম না?
রাসুল (সা খাবার পরে মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন বলে সেই মিষ্টি খাওয়াটাকে যদি আঁকড়ে ধরতে পারলাম, তবে যে রাসুল এতিমকে ধরে নিয়ে তার ভরণ পোষণের, পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করতেন, সেই সুন্নতটাকে আমরা কেন গ্রহণ করলাম না? ঈদের আনন্দকে গরীব দু:খীদের মাঝে ভাগাভাগী করে নেওয়াটাকে কেন সুন্নত হিসেবে পালন করলাম না? এর জবাব তাঁর উম্মত হবার দাবীদার প্রতিটি ব্যক্তিকেই দিতে হবে। এড়ানো যাবে না কোনমতেই, কোনভাবেই না।
যে রাসুল (সা নিজের খাবারকে তুলে দিতেন অভূক্তের হাতে, নিজে থাকতেন অভুক্ত! তাঁর উম্মত হয়েও কেন আমাদের নিজেদের ভূরিভোজনের সময় পাড়া পড়শী (অনেকের তো আবার নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন পর্যন্ত!) অভূক্ত থাকে, তারও জবাব দিতে হবে বৈকি।
দিতে হবে, কারণ, ঈদ এসেছিল এইসব অসঙ্গতিকে দুর করতে। আজ যখন আমরা ঘটা করে, সাড়ম্বরে ঈদ পালনে ব্যস্ত, তখন সেই ঈদের আর্থসামাজিক, মনস্তাত্বিক, নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা কেন সমাজে প্রতিফলিত হলো না? তার জবাব দেবার দায়ও আমাদেরই। এ থেকে কোনমতেই নিস্তার নেই।
ভাবনাগুলো প্রতি বৎসরেই মনে উদয় হয়। ঈদে সেটা আরও তীব্রতর হয়। কিন্তু জীবনের কি নির্মম পরিহাস, বাস্তবতার কি নিষ্ঠুর নিয়ম, সেই আমিও ঈদ আসলে ‘ঈদ’ পালন করি, করতে বাধ্য হই বুকের মধ্যে একরাশ চাপা ক্ষোভ, একরাশ ব্যর্থতা আর অপরাধবোধকে চেপে রেখে ঈদে ব্যস্ত হয়ে পড়ি!
(সুত্র: ‘টাইন নদীর ওপার থেকে’ বই এর ১৪-১৮ পৃষ্ঠা।)
বিষয়: বিবিধ
১৯৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন