দশ বৎসর বয়সী বিশ্বখ্যাত শিক্ষক, জীবনের শুরুটা হয়েছিল যেভাবে-- (ইতিহাসের পাতা থেকে)
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২০ জুলাই, ২০১৩, ০৯:৪৬:১২ রাত
আজ হতে অনেক বৎসর আগে, সেই ৭১০ সালের কথা। বাগদাদে এক লোকের আবির্ভাব হলো, যে নিজেকে নাস্তিক বলে প্রচার করতে থাকে। সে সাথে লোকটি ইসলাম মুসলমানদের নিয়ে নিত্যই ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে যেতে থাকে। তার দাবী; মুসলমানরা সব বোকা, না বুঝেই তারা আল্লাহ নামের এমন একজনের ইবাদত করে চলেছে, যার কোন অস্তিত্বই নেই। সে এ ব্যপারে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দেয় বাগদাদের রাজপথে, কেউ পারলে তার সাথে বিতর্কে আসুক, প্রমাণ করে দিক যে, আল্লাহ নামে সত্যিই কেউ একজন আছে!
প্রথম প্রথম বাগদাদবাসী লোকটিকে উপেক্ষা করে চললেও ক্রমেই তার উৎপাত বেড়ে যেতে থাকে। কারো পক্ষ হতেই কোন বাদ প্রতিবাদের মুখোমুখি না হওয়াতে এবং কেউই তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করাতে লোকটিও হামবড়া ভাব নিয়ে পথে ঘাটে মুসলমান মনীষীদের নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্বক কথাবার্তা বলে বেড়াতে লাগল।
একদিন বাগদাদের রাজপথে বৎসর দশেক বয়সের ছোট্ট এক বালকের সাথে লোকটার দেখা হয়ে গেল। উক্ত লোকটি রাস্তার পাশে কিছু লোকের সাথে আল্লাহ অস্তিত্ব নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করছিল, সেটাই উক্ত বালকের কানে গেল। কেউ কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে বালকটিই এগিয়ে এলো, বলে উঠল, আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব।
ক্ষুদে এক বালকের কথা শুনে ও তার দিকে তাকিয়ে লোকটি যেমন বিরক্ত হলো, তেমনি তার কৌতুহলও বাড়ল। সে ছোট্ট ছেলেটির দিকে চেয়ে বলে উঠল, তুমি আমার চ্যালেঞ্জ নেবে? আমি আজ কতদিন তিনটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে পুরো বাগদাদের মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বেড়াচ্ছি, কেউ সাহস করে আমার চ্যালেঞ্জটা নিতে এগিয়ে আসল না, আর তুমি এই পিঁচকে ছোঁড়া আমার চ্যালেঞ্জ নেবে? তুমিই দেবে আমার তিন প্রশ্নের উত্তর?
এর পরে লোকটি আশে পাশে উপস্থিত লোকজনের দিকে ফিরে অনেকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল, শেষ পর্যন্ত এই পুঁচকে ছেলেটাকেই তোমরা পেলে আমার সাথে বিতর্কে নামাতে? তোমাদের মধ্যে কি আর কারো সাহস হলো না আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার? বলেই লোকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতেই থাকল।
বালক ছেলেটি কোনমতেই দমবার পাত্র ছিল না। তার মনে ক্ষোভ, লোকটা আল্লাহকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছে, মুসলমানদের নিয়ে উপহাস করে বেড়াচ্ছে, তাকে কোনমতেই ছাড় দেয়া যাবে না। সেও অনড় থেকে বলে উঠল; আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর আমিই দেব। কবে আপনি আমার সাথে বিতর্কে নামবেন বলুন!
বালকের এমন দু:সাহস দেখে আশে পাশের লোকজন মজা দেখার জন্য হোক আর সিরিয়াসলিই হোক, সবাই জেঁকে ধরল লোকটিকে; হ্যাঁ, আমাদের এই ছোট্ট ছেলেটিই তোমর সাথে বিতর্ক করবে, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবে, তুমি পারলে ওর সাথে তর্কযুদ্ধে নামো।
সে মতই খুব শীঘ্রই একদিন লোকজন জড়ো হলো শহরে ছোট্ট এক টিলার পাশে এক ময়দানে। লোকটি টিলার উপরে উঠে তার চিরায়ত দম্ভভরে দাঁড়াল এবং উপস্থিত সকলের সামনেই বাচ্চা ছেলেটার দিকে চেয়ে তার প্রথম প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল; তোমার আল্লাহ এ মহুর্তে কি করছে?
ছেলেটা এক দন্ড ভেবে নিয়ে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল; আপনি নীচে নেমে আসুন, আমি টিলার উপরে উঠব জবাব দিতে।
লোকটা অনেকটা বিরক্তিভরেই ছেলেটার কাছে জানতে চাইল; কি? আমাকে নীচে নামতে হবে?
'হ্যাঁ, আপনি আপনার প্রশ্ন করেছেন। আমি এখন ঐ স্থানে দাঁড়িয়ে তার জবাব দেব, আপনি নামুন।' ছেলেটির বলিষ্ঠ জবাব।
লোকটি নেমে এলে বাচ্চা ছেলেটি বিসমিল্লাহ বলে টিলার উপরে উঠে দাঁড়াল। সারা ময়দান জুড়ে উপস্থিত লোকজন অধীর আগ্রহে তার দিকে চেয়ে আছে জবাবটা শোনার জন্যে। অপেক্ষায় আছে নাস্তিক সেই লোকটিও।
বাচ্চা ছেলেটা আকাশের দিকে একবার চেয়ে বলে উঠল; হায় আল্লাহ, তুমি আমাকে সাহায্য করো, আমি এই অবিশ্বাসীর প্রশ্নের জবাব দেব। এর পরে লোকটির দিকে চেয়ে বলে উঠল;
আমার আল্লাহ এই মহুর্তে কি করছেন, তা আপনি নিজেই দেখলেন। তিনি একজন অবিশ্বাসী কাফেরকে উচ্চস্থান থেকে নামিয়ে একজন বিশ্বাসী মুসলমানকে উপরে তুললেন!
ছোট বাচ্চাটির মুখে এমন প্রতুৎমন্ন জবাব শুনে উপস্থিত সকলেই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। নাস্তিকের মুখে কোন কথা না ফুটলেও অন্যান্য সকলেই ত্বাকবীর ধ্বনি ‘আল্লাহু আকবর’ হেঁকে উঠল!
নাস্তিক লোকটি হতবিহ্বল হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তার দ্বিতীয় প্রশ্নটি করে বসল, বলল; আল্লাহর পূর্বে কে ছিল? কি ছিল?
ছেলেটা একদন্ড ভেবে নিয়ে বলে উঠল আপনি দয়া করে দশ থেকে উল্টো দিকে গুণতে থাকুন।
নাস্তিক লোকটি বিতর্কে যেহেতু নেমেছে, তাই ছোট্ট ছেলেটির এই অদ্ভূত নির্দেশ পালন করতে গিয়ে দশ থেকে গুণতে থাকল উল্টো দিকে; দশ- নয়- আট- সাত-; এভাবে গুণতে গুণতে সে শূন্য পর্যন্ত এসে থেমে গেল। বালকটি তাকে বলে উঠল, থামলেন কেন? শূন্যের আগে কি তা-ও বলুন!
লোকটি বলে উঠল, শূন্যের আগে কিছু নেই।
ছেলেটি বলে উঠল; আমার আল্লাহও ঠিক এমনই। তাঁর আগে কিছুই নেই, কিছুই ছিল না, তিনি চিরন্তন। তিনিই শুরু।
উপস্থিত লোকজন আরও একবার সমস্বরে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে উঠল ওদিকে নাস্তিক লোকটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে! বিষ্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেছে। তার আত্মবিশ্বাসেও চীড় ধরেছে মাত্র দশ বৎসর বয়সী এক ছেলের কাছে এভাবে প্রকাশ্যে নাস্তানাবূদ হয়ে।
কিন্তু তার পরেও সে তার তৃতীয় প্রশ্নটি করল, যদিও তার গলায় আগের সেই জোর আর নেই!
আল্লাহ কোনদিকে মুখ করে আছে?
নাস্তিকের প্রশ্নটি শুনে ছেলেটা এক দন্ড কী যেন ভাবল। এর পরে বলে উঠল কেউ কী আমাকে একটা মোমবাতি দিতে পারেন আপনারা? উৎসাহি লোকজনের ভেতর থেকে একজন দৌড়ে একটা মোমবাতি নিয়ে এলে ছেলেটা সেই নাস্তিককে মোমবাতিটা জ্বালাতে বলল।
নাস্তিক লোকটা মোমবাতি জ্বালানোর আগেই কেউ একজন তার পাশ থেকে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিল। ছেলেটা সেই মোমবাতির আগুনের দিকে নাস্তিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে প্রশ্ন করল:
বলুন তো আলোর মুখ কোন দিকে?
লোকটি কিছুক্ষণ মোমবাতির দিকে চেয়ে রইল! কী জবাব দেবে সে? আলোর কী কোন মুখ থাকে? অনেক চেষ্টা করে যেন সে একটা উত্তর জোগাড় করে নিল, বলে উঠল;
আলোর কী কোন নির্দিষ্ট দিকে মুখ থাকে? সবদিকেই তার মুখ।
এবারে ছেলেটাও বুক চিতিয়ে বলে উঠল;
আমার আল্লাহর নুরও সব দিকেই ঘিরে আছে, তিনি সর্ব্যব্যাপি,সবখানে, সমসময়। তাঁর নির্দিষ্ট কোন দিক নেই। তিনি একই সাথে সবদিকে আছেন।
উপস্থিত জনতা সমস্বরে আবারও আল্লাহু আকবর হেঁকে উঠল।
মাত্র দশ বৎসর বয়সী একটা ছেলের হাতে পর্যুদস্থ হয়ে জ্ঞানী হিসেবে তার এতদিনের অহংকার ও দম্ভ যেন চূর্ণ হয়ে গেছে! নাস্তিক লোকটি বিষ্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে অধোবদনে নিশ্চুপ বসে রইল।
এই লোকটি সেদিনই দশ বৎসর বয়সী এই শিশুর শীষ্যত্ব বরণ করে তার ছাত্র হিসেবে নিজেকে সমর্পণ করল।
সূধী পাঠক, এই বালকটিই পরবর্তিতে মুসলিম বিশ্বের গর্ব ইমাম আবু হানিফা হিসেবে ইতিহাসে আত্বপ্রকাশ করেন। তাঁর জীবনে তিনি ছেচল্লিশ হাজার মুহাদ্দিস ও আলেম তৈরী করেছেন। আর এই ছেচল্লিশ হাজার ছাত্রের মধ্যে প্রথম ছাত্রটিই ছিল এক নাস্তিক, যে তাঁর সান্নিধ্যে এসে হেদায়েতের সন্ধান পায়। আর উস্তাদের বয়সও ছিল মাত্র দশ!!
বিষয়: বিবিধ
১৮৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন