ভারতের ‘কান্ডারা ও আজকের মুসলমান!!
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০৩ জুলাই, ২০১৩, ১২:০৬:১০ দুপুর
খুব বেশী দিন নয়, আজ থেকে দেড়শত বৎসর আগে ব্রিটিশ ভারতের একটা ঘটনা। উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের একটা গ্রাম; নাম ‘কান্ডারা’। হিন্দু, মুসলমান প্রায় একই সমান সংখ্যক জনঅধ্যূষিত গ্রাম। আর্থিক অবস্থা; শোচনীয়। বেশীর ভাগই ছিল মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ ছিল, আবার তারা একত্রে বসবাসও করত, চিরাচরিত নিয়মেই।
এ গ্রামেই হঠাৎ সংঘাতের সূত্রপাত হলো। একখন্ড পরিত্যক্ত জমি ছিল গ্রামে। জমিটিতে হিন্দু স¤প্রদায় মন্দির বানাতে উদ্যোগী হলে মুসলমান‘রা তার বিরোধিতা করে। তাদের দাবী, এটা মুসলমানদের জমি, এখানে মন্দির বানানো চলবে না, বরং তারা সেখানে মসজিদ বানানোর ঘোষণা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুরা এর ঘোরতর প্রতিবাদ করে। মুসলমানরাও দাবীতে অনড়! অনিবার্য সংঘাতের মুখে বিষয়টি শেষপর্যন্ত আদালতে গড়ালে তা বিরাট প্রেস্টিজ ইস্যুতে পরিণত হয় উভয় গ্র“পের জন্যই। প্রত্যেক গ্র“পই তাদের সাধ্যমত দলীল-প্রমাণ, স্বাক্ষী সাবুদ জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু সেখানেও বিড়ম্বনা। এমন কোন দলীল প্রমাণ নেই সরকারি সেরেস্তায়, যার ভিত্তিতে এটা প্রমাণ করা যায় যে, জমিটা কোন বিশেষ কোন গোষ্ঠির। আদালত শেষ পর্যন্ত গ্রামের বয়স্ক, বিশ্বাসযোগ্য দু‘একজন লোককে আদালতে সমন করার কিংবা হিন্দু ও মুসলমান অর্থাৎ মামলার বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষ যেসব লোককে তাদের মামলার পক্ষে সাক্ষী হিসেবে মেনেছে, তাদের উপরেই নির্ভর করতে বাধ্য হয়।
এখানে মজার ব্যপার হলো, মামলার একটি পক্ষ হিন্দু সম্প্রদায় তাদের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে উক্ত গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদের বৃদ্ধ ইমামকে সাক্ষী হিসেবে মানেন। হিন্দু হলেও তাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল, এই মুসলমান বৃদ্ধ আর যাই হোক না কেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেন না। মিথ্যা কথা বলবেন না, তাঁকে দিয়ে ন্যায় বিচারের পরিপন্থি কোন কাজ করানো যাবে না। জাত, বেজাত বিচার না করে একমাত্র সত্যের পক্ষেই তার সাক্ষ্য দেবেন, কোন ভয় ভীতির পরওয়াও করবেন না।
বিচারক বৃদ্ধ ইমামকে আদালতে হাজির হতে সমন জারী করে। কিন্তু সেই বৃদ্ধ ইমাম আদালতে হাজির হতে অস্বীকার করেন এই বলে যে, তিনি তাঁর দেশকে ধ্বংস করে দেয়া কোন কাফের, ইংরেজের মূখ দেখবেন না বলে পণ করেছেন, যেহেতু উক্ত আদালতের বিচারক একজন বিধর্মী ইংরেজ, তাই তিনি আদালতে যাবেন না সাক্ষ্য দিতে।
বিচারক ইমাম সাহেবের এই উক্তি শুনে বিব্রত ও ক্রোধান্বিত হলেও মামলার স্বার্থেই বললেন; যদি ইমাম সাহেব সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন, তবে তাঁর পণ রক্ষার্থে বিচারক উক্ত সময়ে এজলাসের বাইরে নিজ কক্ষে অবস্থান করবেন এবং আদালতে উকিল পেশকাররাই তাঁর সাক্ষ্য রেকর্ড করবেন। এই ব্যবস্থায় ইমাম সাহেব নির্দিষ্ট দিনে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হলেন।
ইমাম সাহেব সাক্ষী দিতে যাবেন এই খবরে হিন্দু ও মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যেই এক দারুণ উত্তেজনা দেখা দিল। হিন্দু স¤প্রদায় খূশী, কারণ, তাদের বিশ্বাস ইমাম সাহেব আদালতে সত্য কথাই বলবেন। আর যদি তিনি সত্য কথা বলেন তবে তা প্রকৃত অর্থে হিন্দুদের পক্ষেই যাবে, কারণ, উক্ত জমিটা হিন্দুদেরই সম্পত্তি।
আর মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেবার কারণ, যদিও কোন কোন মুসলমান ভেবেছিলেন ইমাম সাহেব আদালতে সত্য কথাটাই বলবেন, যেটা প্রকৃত অর্থে মুসলমানদের বিপক্ষেই যাবে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান ভেবেছিলেন এবং বিশ্বাস করেছিলেন, আর যাই হোক না কেন, হিন্দু মুসলমান দ্বন্দে ইমাম সাহেব তার নিজ জাতির বিরুদ্ধে কোন সাক্ষ্য দেবেন না। কারণ, এখানে মুসলমান স¤প্রদায়ের মান, সম্মান, ইজ্জতের প্রশ্ন জড়িত। যে ভূমিখন্ড নিয়ে এত উত্তেজনা, এত মামলা, মোকাদ্দমা সেখানে তো আল্লাহর ঘর মসজিদই হবে! অতএব মসজিদের একজন ইমাম হিসেবে তিনি কী করে তার নিজ জাতির বিরুদ্ধে, কি করে প্রস্তাবিত মসজিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন ?
এরকম একটা টান টান উত্তেজনার মধ্যেই বৃদ্ধ ইমাম সাহেব আদালতে হাজির হলেন এবং গোরা ইংরেজের সাময়িক অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্যও দিলেন, তা আদালতে রেকর্ডও হলো। ইমাম সাহেব বলিষ্ঠতার সাথে আদালতকে জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর জ্ঞান ও বিশ্বাস মতে উক্ত ভূমিখন্ডটা গ্রামের মুসলমান জনগোষ্টির নয়, এর প্রকৃত মালিক হলো হিন্দু স¤প্রদায়। মাত্র কয়েক মিনিটের সাক্ষ্য প্রদান শেষে তিনি বেরিয়ে এলেন।
বেরিয়ে এলেন বটে। কিন্তু আদালতের সিঁড়ি বেয়ে দু’কদমর নামতে পারলেন না। তাঁকে ঘিরে ধরল আক্রমণোদ্যত এক বিশাল মুসলিম জনতা। হেরে যাওয়া মুসলিম পক্ষ সকল আক্রোশ আর ক্ষোভ নিয়ে ইমাম সাহেবের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি কেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন? তিনি কেন তাঁর নিজের জাতভাইদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন? তাঁর কারণেই তো আজ মুসলমানদের এই পরাজয়! কিছু পাষন্ড ইমাম সাহেবের মাথার টুপি, মুখের দাঁড়ি ধরে টান দিল। ‘গাদ্দার’ ‘হিন্দুদের পেইড এজেন্ট’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিতও করল!
বেচারা ইমাম সাহেব তার সকল শক্তি সঞ্চয় করে উত্তেজিত জনতাকে বোঝাতে তৎপর হলেন, সকল শক্তিটুকু গলায় জড় করে বললেন ‘হে ভাই সকল, আমি কোন অন্যায় করিনি, একজন মুসলমান হিসেবে কেবলমাত্র আল্লাহর নির্দেশকে বাস্তবায়ন করেছি। মনে রেখো, আমরা মুসলমান, আল্লাহপাক নির্দেশ করেছেন তার পাক কালামে এভাবে ‘ ...... তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম, পূর্বে এবং এই আল কুরআনেও। যেন রাসূল তোমাদের উপের সাক্ষী হন, আর তোমরাও সাক্ষ্যদাতা হও মানবগোষ্ঠির জন্য’ (সুরা হাজ্জ -৭৮)
কে শোনে কার কথা! উত্তেজিত জনতা সম্মানিত ইমাম সাহেবের উপরে এক এক করে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকল। আর ইমাম সাহেব সকল আক্রমণ বিনা বাক্য ব্যয়ে সহ্য করেও বলে চলেছেন ‘হে ভাই সকল, তোমরা কথা শোন, বোঝার চেষ্টা কর, স্মরণ করো, মহান আল্লাহর নির্দেশ প্রতিটি মুসলমানের প্রতি, ‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী গোষ্ঠি বানিয়েছি যেন তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষ্যদাতা হও, আর রাসূল হন তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা’ ( বাকারাহ - ১৪৩)
রক্তাক্ত ইমাম সাহেব বলে চলেছেন, ‘ভাই সকল আমি তোমাদের ক্ষোভ বুঝি, কিন্তু মিথ্যার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। বিশেষ করে, একজন মুসলমান হিসেবে এটার ধারে কাছেও আমি যেতে পারি না, তোমাদেরকেও যেতে দিতে পারি না। মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে অপরের জমি বাগিয়ে সেখানে মসজিদ বানানোর কথা কোন মুসলমান চিন্তাও করতে পারে না। মনের রেখো, আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে ফেলনা, আর জেনে শুনে সত্য গোপন করো না’।
কিন্তু হায়, ততক্ষণে ইমাম সাহেবের করূণ দশা। আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত! উত্তেজিত মুসলিম জনতা ইমাম সাহেবের কোন কথাই শুনতে প্রস্তুত নয় যেন! এমন সময়ে অদূরে দাঁড়ানো হিন্দু স¤প্রদায়, যারা আজকের মামলায় নিজেদের পক্ষে রায় পেয়েছেন, পেয়েছেন জমির মালিকানাটুকুও, তারাই এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ তাঁরা দল বেধে মুসলিম জনগোষ্ঠির এই গর্হিত আচরণ দেখছিলেন।
ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করে তাঁরা নিজেদের গ্রামে নিয়ে প্রাথমিক পরিচর্যা করলেন। সেখানেই তাদের নেতৃস্থানীয় একজনের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে ইমাম সাহেবের কাছে নিবেদন করলেন আদালত থেকে পাওয়া জমির মালিকানার কাগজপত্র। বললেন; হুজুর, আমরা আপনার মহানূভবতায়, সততায় মুগ্ধ। আপনার উপরে আক্রমণকারী ঐ জনগোষ্ঠির মত নয় বরং আমরা ‘আপনার মত’ই মুসলমান হতে চাই। এই জমি গ্রহণ করুন, এখানে আপনি মসজিদ বানান। আর আমাদেরকে, আমাদের সন্তানদেরকে আপনার মত করে তৈরী করুন। আমরা আপনার ধর্মে দীক্ষিত হতে চাই!
ইমাম সাহেবের উপরে আক্রমণকারী সেই ক্রোধোম্নত্ত মুসলিম জনগোষ্ঠি ি অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে দেখল, পুরো গ্রামের কয়েক শত হিন্দু জনগোষ্ঠি ইমাম সাহেবের সামনে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল!
বিষ্ময়ে হতবাক এই মুসলমান(!) জনগোষ্ঠির মুখে কোন কথা নেই! যে জমিটা করায়ত্ত করতে তারা শত ছল চাতুরীর কোন কমতিই করেনি, সেই জমিই কেবল আজ গ্রামের হিন্দু স¤প্রদায় স্বেচ্ছায় ইমাম সাহেবের হাতে তুলে দিল, তাই নয়, বরং তারা সকলেই স্বেচ্ছায় বাপ দাদার ধর্ম বিসর্জন দিয়ে মুসলমান হয়ে গেল!
এরকমই হয়। কারণ, ইসলাম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মনোনিত ধর্ম। বিশ্বের সকল মানুষের জন্য, সর্বকালের জন্য নির্ধারিত ধর্ম। কেয়ামত পর্যর্ন্ত টিকে থাকবে। বিশ্বের কোন না কোন মানব গোষ্ঠি এই ধর্মের মশালটিকে হাতে করে এগিয়ে যাবে। তারাই পরিচিত হবে মুসলমান হিসেবে।
কেউ যদি এ কাজে অবহেলা করে, তবে তাকে এই মশাল বাহকের মর্যাদা আর অবস্থান হতে সরিয়ে দিয়ে, তাদের স্থলে আল্লাহ পাক এমন একটা দলকে নিয়ে আসবেন, যাঁরা এই ইসলামকে এগিয়ে নিতে, মানব স¤প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করতে এগিয়ে আসবে। এ ব্যাপারে তারা এতটাই নিবেদিত প্রাণ হবে যে, কোন শক্তিরই তারা পরওয়া করবে না , ভ্র“ক্ষেপও করবে না।
পুরো বিশ্বের মালিক তো আল্লাহ স্বয়ং। তাঁর বিশ্বে কি কোন কিছুর অভাব আছে? ছয়শত কোটি বিশ্ববাসীর দেড়শত কোটিকে তিনি মুসলমান বানিয়েছেন। তারা যদি তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে, তবে কি তিনি তাদের বসনিয়া, চেচনিয়া, ফিলিস্তিন আর কাশ্মীরের আজাবে নির্মূল করে তদস্থলে ক্যাট স্টিভান্স’দের ‘ইউসুফ ইসলাম’ বানিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন না? পারেন কিনা, তার জবাব জানতে হলে আল কুরআনে সুরা মায়েদার ৫৪ নম্বর আয়াতটি দেখে নিতে পারেন ভালো করে। উত্তরটা সেখানেই আছে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন