হতভাগা নবাব সীরাজুদ্দৌলা, আজ তার মৃত্যূবার্ষিকী; আসুন তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০২ জুলাই, ২০১৩, ০৪:২০:৩৩ রাত
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ সম্রাট নবাব সিরাজুদ্দৌলা। বাঙ্গালী মুসলমান গণমানসে সমুজ্জল একটি নাম। বিহারের নবাব আলীবর্দীর নাতী, আমেনা বেগমের নাড়ী ছেঁড়া ধন এই স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক নবাবের আজ ২রা জুলাই তাঁর ২৫৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
আজ হতে ২৫৬ বৎসর আগে পলাশীর প্রান্তরে দু:খজনক বিপর্যয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় পুরো ভারতই একসময় তার স্বাধীনতা হারায় ইংরেজদের কাছে, সে ইতিহাস আজ আর কারো অজানা নয়।
নবাব সিরাজের জীবন ও কর্ম নিয়ে পোষ্ট লিখতে বসিনি, বসেছি তার জীবন ও সমাজ থেকে কি শিক্ষা আমরা নিতে পারি, সে কথাটা বলতে। সিরাজ বারবার তার সভাসদদের ডাক দিয়েছেন, বলেছেন, ভেদাভেদ ভুলে দেশ বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। বলেছেন, বাংলার প্রতিটি সন্তানেরই এগিয়ে আসা উচিৎ হানাদারদের প্রতিরোধে। বলেছেন, স্বাধীণতা রক্ষায় সবাই যেন ঐক্যবদ্ধ হয়।
কেউ তার ডাকে সাড়া দেয়নি, তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্থ ও আস্থাভজানরাই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বিশ্বাসঘাতকতা কেবল তার সাথেই নয়, বিশ্বাসঘাতকতা কেেরছ নিজ দেশ ও সমাজের সাথে।
ইংরেজ তস্কর লর্ড ক্লাইভ ইংল্যন্ডে ফিরে যতদিন বেঁচেছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ঘোর কাটেনি যেন! সতীর্থ আ্ত্বীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের কাছে বিষ্ময়মাখা কন্ঠে বলতেন; নবাব সিরাজের মরদেহ দেখতে আসা সতীর্থ বাঙ্গালীরা আর কিছু নয়, সবাই যদি একটা করে ঢিলও ছুঁড়ত, তা হলে আমাদের বাঁচার কোন পথ খোলা ছিল না!
মুর্শিদাবাদের লক্ষ লক্ষ লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের নবাবদের লাশ দেখেছে, সিরাজের মা আমেনা বেগমের আহাজারী শুনেছে, নবাবপতœী লুৎফা বেগমের চোখ থেকে দর দর করে অশ্র“ ঝরতে দেখেছে। এতিম শিশু কন্যা জোহরার বিলাপ শুনেছে, কিন্তু তার পরেও তারা রা করে নি। কী অবাক বিষ্ময়কর ঘটনা!
আজ হতে ২৫৬ বৎসর আগে এরকমই এক ২রা জুলাই রাতে, লর্ড ক্লাইভ পেয়াদা মারফত যখন জানতে পারলেন যে, মীর জাফরপুত্র মীরন ও তার সতীর্থরা মিলে নবাব সিরাজকে হত্যা করেছে! লর্ড ক্লাইভের পথের কাঁটা দূর হয়েছে, তখনও তিনি খুশী হতে পারেন নি, বরং আতংকে শীহরীত হয়েছিলেন এটা ভেবে যে, না জানি, ভোর পর্যন্ত বেঁচে তিনি থাকতে পারবেন কি না, হয়তবা মুর্শিদাবাদের বিক্ষুব্ধ জনতা নবাব হারানোর ক্ষোভে দল বেঁধে ইংরেজ ছাউনীর উপরে হামলে পড়ে রাতেই তাদের দফা রফা করে ছাড়ে!
বিছানাতেও যাননি লর্ড ক্লাইভ। সারারাত ধরে তিনি ঘরের মধ্যে পায়চারী করেছেন। ভেবেছেন, ভোরের আলো না জানি তার জন্য কি বার্তা, কি পরিণতি বয়ে নিয়ে আসে! এভাবেই এক সময় ভোর হয়ে আসে। প্রতিদিনের মতই লর্ড ক্লাইভ শুনতে পেলেন, তার সেনাছাউনীর নিকটবর্তি রাস্তা দিয়ে চাষী মনের সুখে গান গাইতে গাইতে গরু আর লাঙ্গল নিয়ে জমি চাষে মাঠে যাচ্ছে! মুর্শিদাবাদে প্রতিদিন যেভাবে রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়, সেদিনও সেভাবেই ভোর হয়েছে! কোন পরিবর্তন নেই!
সারা রাত নির্ঘূম কাটালেও লর্ড ক্লাইভ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে গেলেন, এটা ভেবে যে, যে দেশের গণমানুষ নিজ দেশের ব্যাপারে এতটা নির্লিপ্ত হতে পারে, সে দেশে আমার মত ক্লাইভের কোন ভয় নেই, এখানে আমার নিরাপত্তার কোন ঘাটতি হবে না!
আসলেই হয়নি। ঘাতক, তস্কর, লুটেরা ক্লাইভ বরং বরীত হয়েছেন বীর হিসেবে! পাঁচটাকা মাইনের কেরানী হয়েছেন পুরো ভারতের ভাগ্যবিধাতা! আত্বহননের এরকম মহোৎসব কেবলমাত্র হতভাগা এ বাংলার ইতিহাসেই দেখা মেলে! বিশ্বের আর কোথাও নয়! সত্যিই কি বিচিত্র এ দেশ!!
পলাশীর এই ট্রাজেডি আমাদেরকে শিখিয়ে গেছে; দেশ, জাতী ও সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রে নিস্পৃহ থাকলে অতি চড়া মূল্য দিতে হয়। জীবনের অন্যান্য যে কোন দিক নিয়েই বৈরাগ্যবাদ অবলম্বনে নিস্পৃহ থাকা যাক না কেন, দেশ ও সমাজ এবং দেশবাসীর সামগ্রিক ভাল মন্দ নিয়ে নিস্পৃহ থাকার কোন সুযোগই নেই!
আরও শিখিয়েছে, সমাজবাসীর কোন একটি অংশের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে নেই। গৃহিনীর উপরে রাগ করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলে গৃহিনীই কেবল ঘরছাড়া হয় না, গৃহস্থকেও বাস্তুহারা হতে হয়!
আসুন, এ বাস্তবতাকে আমরা সবাই নিজ নিজ উপলব্ধী দিয়ে হৃদয়ংগম করি। আর সেই সাথে, প্রত্যেকে নামাজ শেষে অন্তত একটাবারের জন্য হলেও হতভাগা সীরাজ, আর তার মা, তার স্ত্রী, তার মজলুম পরিবারবর্গ ও আত্বাহুতি দেওয়া সৈনিকদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
বিষয়: বিবিধ
১৮০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন