মধ্যযুগ': হুজুগ ও বাস্তবতা: ইতিহাসের পাতা থেকে। (একান্ত বাধ্য হয়েই রিপোষ্ট)
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২৭ জুন, ২০১৩, ০৪:১৫:৩২ রাত
‘মধ্যযুগীয়’ বলে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের হেয় করার প্রচেষ্টা মাঝে মাঝেই দেখা যায় আমাদের তথাকথিত ‘‘প্রগতীশীল মহল’ বলে পরিচিত একটি মহল থেকে। পর্দা করে চলা নাকি ‘মধ্যযুগীয়’। ইসলাম চর্চা করাটাও ‘মধ্যযুগীয়’! মাথায় টুপি ধারণ করা, সুন্নতি লেবাস বলে পরিচিত পোষাক পরলে, নারী পুরুষের অবাধ ও যথেচ্ছ মেলা মেশার বিরোধিতা করলে, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড থাকার ধারনার বিরোধিতা করলে ‘মধ্যযুগীয়’ আখ্যা পেতে হয়।
এইতো সেদিন হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক তের দফা দাবী উত্থাপিত হয়েছিল। সেখানে নারী পুরুষের অবাধ মেলা-মেশার নামে অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা বন্ধসহ ইসলামি কৃষ্টি ও কালচারকে সমুন্নত করার ব্যাপারে কিছু দাবী দাওয়া ছিল। দাবীগুলো প্রকাশ পাওয়া মাত্র সারা দেশের ‘প্রগতিশীল’ বলে পরিচিত বাম-রাম-নাস্তিক মহলটি ত্বারস্বরে চিৎকার করে উঠে, হেফাজতের দাবী মেনে নিলে দেশ নাকি ‘মধ্যযুগে’ ফেরত যাবে।
মাঝে মাঝেই বিভিন্ন বাম রাজনীতিবিদ আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের বলতে শুনি, আলেম ওলামারা, জামাত শিবিরের লোকেরা নাকি দেশকে ‘মধ্যযুগে’ ফিরত নিতে চায়!
সমস্যা হলো ‘মধ্যযুগ’ কাকে বলে? সে বিষয়টাই এই সব আঁতেলরা জানে না। ‘মধ্যযুগ’ বলতে কোন যুগকে বোঝানো হয়, সে যুগে বিশ্বের কোন দেশ কি পর্যায়ে ছিল, সে ব্যাপারে এদের বিন্দুমাত্র ধারনা না থাকলেও তারা তোতাপাখীর মত ঐ একই গান গিয়ে চলেছে! অথচ ‘মধ্যযুগ’ মুসলমানদের জন্য ছিল স্বর্ণযুগ!!
বস্তুত ৪৭৬ খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৪৫০ খৃষ্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত এই প্রায় এক হাজার বৎসর সময়কালই হলো মধ্যযুগ। এই মধ্যযুগকে আবার Early Middle age, High Middle Age এবং Late Middle Age মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
এই যে প্রায় এক হাজার বৎসর (সঠিকভাবে বললে বলতে হয় ৯৭৪ বৎসর।) এ সময়কালটা বিশ্ব ইতিহাসে দুটো কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমটা হলো, এই সময়কালেই বিশ্বের সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনাটি ঘটে, রাসুলুল্লাহ সা: নবুওয়াত পান এবং আল কুরআন নাজিল হয়। আর এরই হাত ধরে স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে সকলশ্রেণীর মানুষের সামনে মুক্তির দুয়ার খুলে যায়। আর এরই উপরে ভিত্তি করে মদীনার ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার বিস্তার ঘটে, এবং তার অতি উচ্চ একটা স্তর আমরা দেখতে পাই আন্দালুসে, যা স্থায়ী হয়েছিল ১৪৯২ সাল পর্যন্ত।
দ্বিতীয় যে কারণ, সেটা হলো, এই সময়কালেই বিশ্বে প্রথমবারের মত ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের উত্থান ঘটে। খৃষ্টধর্মকে পুঁজি করে 'হলি রোমান এ্যম্পায়ার' জুড়ে এ সন্ত্রাসের বিস্তারও ঘটে দ্রুত। এ সময়কালে ইসলামি বিশ্বের বাইরে, পুর্বে বা পশ্চিমের বিশাল এলাকায় অজ্ঞতা আর শোষণের মাত্রায় এক ভিন্নতা আসে, অধ:পতন ও বর্বরতার আরও এক ধাপ নীচে তারা নেমে যায়।
আজ আমরা যে ভূখন্ডকে ইউরোপ বলে জানি, সেই ইউরোপে খৃষ্টানরা প্যাগান ধর্মাবলম্বীদের দলে দলে হত্যা করেছে, খৃষ্টবাদের নামে ইনকুইজিশন কোর্টের মাধ্যমে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। ক্যাথলিক খৃষ্টানরা 'এ্যরিয়ান' খৃষ্টানদের কচুকাটা করেছে। চার্চের পাদ্রীরা ধর্মের নামে সাধারণ জনগণকে শোষণ করেছে। ‘পিটারস পেনী’ নামে পোপের জন্য চাঁদাবাজী করেছে, কিন্তু সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে কোন কাজই তারা করে নি।
এর বিপরিতে ঐ একই সময়ে ইসলাম যে অঞ্চলে গেছে, সে অঞ্চলেই মানুষের মুক্তি ঘটেছে, তাদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে। শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়েছে।
এরকম বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই ১০০০ খৃষ্টাব্দ সময়কালে দুই জনপদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রের তুলনামূলক বিচারে। ১০০০ খৃষ্টাব্দে কর্ডোভার জনসংখা ছিল দশলক্ষেরও বেশী, সেখানে ৩০০০ মসজিদ ৮০০ স্কুল ছিল। আরও ছিল ৩০০ হাম্মামখানা।
সেই একই সময়কালে ইউরোপে পঞ্চাশ হাজারের বেশী জনসংখ্যাধ্যুষিত কোন শহরের অস্তিত্বই ছিল না! হাম্মামখানার কথাতো কল্পনাও করতে পারত না তারা! জনগণের জন্য কোন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না।
১০০০ খৃষ্টাব্দে ইউরোপ যখন স্যাঁতস্যঁতে কাদা-পানিতে গিজিগিজি করছে, তখন আন্দালুসের অলি-গলিতে পাকা সড়ক! ইউরোপ যখন ঘণ আঁধারে নিমজ্জিত, আন্দালুসের রাস্তায় রাস্তায় তখন পথচারীদের জন্য সড়ক আলোকিত করে জ্বলছে বাতি!! ইউরোপে সবচেয়ে বড় পাঠাগারও যখন মাত্র ছয়শতের মত বই নিয়েই কোন মতে দাঁড়িয়ে আছে, তখন আন্দালুসের পাবলিক লাইব্রেরীটা অর্ধমিলিয়ন তথা পাঁচ লক্ষাধিক বই’এ ঠাসা!
এই ছিল তথাকথিত মধ্যযুগে মুসলিম ও ইউরোপীয় সমাজের তুলনামুলক চিত্র। আমার জানতে ইচ্ছা করে, আমাদের ‘সবজান্তা’ তথাকথিত প্রগতিশীল নেতা-নেত্রী ও সুশীল সমাজের আঁতেলরা ‘মধ্যযুগ’ বলতে ঠিক কোন চিত্রটিকে বুঝিয়ে থাকেন! না, তারা না বুঝেই কেবল আঁতেল সাজার জন্য ‘মধ্যযুগ’ ‘মধ্যযুগ’ বলে খেঁকশিয়ালের মত ‘হুক্কাহুয়া’ রব তোলেন!
কোন সন্দেহ নেই যে, হুজুগপ্রবণ বাঙ্গালী জাতিকে বিভ্রান্ত করতেই তারা এই অপপ্রচার ছড়াতে তৎপর হন। এদের এ অপচেষ্টাকে রুখতেই হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন