সুলতান গাজী সালাহউদ্দীন ও তাঁর এক শিশু অতিথির গল্প

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২৩ জুন, ২০১৩, ০৪:৫২:৪২ বিকাল



সিরিয়ার বর্তমান রাজধানী দামেস্কের ৩১০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে আলেপ্পো শহরটি প্রাচীন সিরিয়ার রাজধানী। এই আলেপ্পো শহরের ভৌগলিক অবস্থান ভূসামরিক ও রাজনৈতিক বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই ঐতিহাসিক আমল থেকেই। হযরত ইসা আ: এর জন্মের দুই হাজার বৎসর পূর্বেও এ শহরটি নিয়ে বিবাদমান রাজাদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়ে ইউরোপীয় ক্রুসেডাররাও বার বার এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর হয়েছে সর্বপ্রথম। শহরটি খৃষ্টান ও মুসলমান উভয় বাহিনীর জন্যই এক দূর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

গাজী সালাহউদ্দীন তার সেনাবাহিনী নিয়ে এই শহরেরই প্রবেশমুখে খৃষ্টান ইউরোপীয় বাহিনীর এক দূর্গ অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। দূর্গের ভেতরে ইউরোপীয় বাহিনী পর্যাপ্ত খাদ্য শস্য ও রসদ নিয়ে বসে আছে। সালাহউদ্দীনও নাছোড় বান্দাহ, তিনি দূর্গ দখল না করে ছাড়বেন না। এভাবে মাসের পর মাস চলে গেল। খৃষ্টান সৈন্যদের রসদেও টান পড়তে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত তারা যুদ্ধ শুরু করলেও অচিরেই পরাজয় স্বীকার করে আত্বসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। সুলতান সালাহউদ্দীনও সকল নাগরিকের জান মালের নিরাপত্তা ঘোষণা করলেন।

এরকম নিরপাত্তা পেয়ে দূর্গের ভেতরে অবস্থানরত খৃষ্টান পরিবারের শিশু কিশোররা মাঝে মধ্যেই আসে মুসলিম সেনা শিবিরে ক্যাম্পে। মুসলিম সৈন্যদের আশে পাশে ঘুর ঘুর করে, উৎসাহী দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে ফিরে দেখে, খেলা করে, আবার ফিরে যায় নিজেদের দূর্গে।

একদিন বিকেলে এরকম একদল শিশু এসেছে মুসলিম শিবিরে। তাদের মধ্যে একটা ছোট্ট পরীর মত অত্যন্ত চটপটে শিশুও ছিল। সেও এসেছে সমবয়সী শিশুদের সাথে দল বেঁধে। সুলতান শিশুদের খুব ভালবাসতেন। তিনি এইসব শিশুদের হাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার, ফলমূল ও মিষ্টি তুলে দিতেন বিভিন্ন সময়।

আজও সেরকমটাই করছিলেন। শিশুর মত সরল মনের সুলতানের সাথে তারা সহজেই সপ্রতিভভাবে মিলে মিশে যেতে পারত। সুলতান কিছু একটা দিতে গেলে হয়ত শিশু সেটা না নিয়ে অন্য কোন একটা খাবার বা মিষ্টি দেখিয়ে দিলে সুলতানও হাসিমুখে শিশুটির হাতে তার কাংক্ষিত মিষ্টি বা ফলটি তুলে দিতেন।

আজও আগত শিশুরা প্রতিদিনের মতই মুসলিম শিবিরে ঘুরে ফিরে খেলে বেড়াচ্ছে। সুলতান সলাহউদ্দীন আজও আগত শিশুদের হাতে মিষ্টি জাতিয় খাবার তুলে দিচ্ছেন আর বসে বসে চারিদিকে চঞ্চলমতি শিশুদের ছুটাছুটি দেখছেন। হঠাৎ তার নজরে পড়ল পরীর মত সুন্দর চঞ্চলা ছোট্ট একটা মেয়ের প্রতি। তিনি তাকে কাছে ডেকে তার হাতে একটা মিষ্টি তুলে দিলে শিশুটি তা নিতে অস্বীকার করল।

সালাহউদ্দীন অবাক হলেন। তিনি শিশুটির কাছে জানতে চাইলেন, সে কি চায়? চপলা শিশুটি সকলকে অবাক করে দিয়ে তাঁবুর বাইরে অদূরে দৃশ্যমাণ দূর্গের দিকে অঙ্গুলি ইশারায় সুলতানকে জানিয়ে দিল; সে ঐ দূর্গটি ফেরত চায়।

সুলতান হতভম্ব। তিনি সন্দেহ নিরসনের জন্য ছোট্ট শিশুটিকে আবারও প্রশ্ন করলেন, সে কি চায়। এবারেও শিশুটিও কোনরকম জড়তা না রেখে সরাসরি ঐ দূর্গটিকেই দেখিয়ে দিল; সে ঐ দূর্গটি চায়।

তাঁবুর ভেতরে উপস্থিত সকলেই বিষ্মিত, হতবাক! সুলতানের চোখ মুখও বেশ সিরিয়াস। তিনিও কি যেন একটা চিন্তা করছেন। এই দূর্গটি দখলের জন্য তার সৈন্যরা গ্রীষ্মকালে মরুভূমির প্রচন্ড তাপকে অগ্রাহ্য করে, মাসের পর মাস দিবারাত্র জেগে জেগে পাহারা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তা তখল করেছেন, আর আজ এই শিশুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই দূর্গটিই কি না ফেরত চাইছে!

উপস্থিত সকলের বিষ্ময়কে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুলতান শিশুটিকে বললেন; ‘ ঠিক আছে যাও, ফিরিয়ে দিলাম, ওটা তোমাদেরই। ’

সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়ল! কিন্তু তারা কেউ কোন কথা বলার সাহস পেলো না। কারণ, তারা জানতেন, সালাহউদ্দীন আইউবি কেবল আবেগের বশে কোন স্বিদ্ধান্ত নেন না।

সুলতান তাঁর এক শিশু অতিথির চাওয়াকে ফিরিয়ে দিতে লজ্জবোধ করেছেন। কয়েক মাসের কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত দূর্গটি তিনি হাসতে হাসতে পরাজিতদের কাছেই ফিরিয়ে দিলেন। কেননা, তিনি তার একজন শিশু মেহমানের আব্দার ফিরিয়ে দিতে লজ্জবোধ করেছেন!

বিষয়: বিবিধ

১৮১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File