আমাদের কলমগুলো অনলবর্ষী হয়ে উঠুক
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৬ জুন, ২০১৩, ০১:১৪:১০ দুপুর
সক্রেটিস কলম ধরেছিলেন বলেই তাকে হেমলক পান করতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্লেটো’র বিখ্যাত গ্রন্থ রিপাবলিক, বইটা লেখার পর দু’হাজার বৎসর পার হয়ে গেছে, কিন্তু ঐ বইটা বিশ্বে যে পরিবর্তনের সূচনা করে গেছে, তা আজও চালু আছে একইভাবে, এতটুকুও নড়চড় হয়নি।
তৎকালীন বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার গ্রীক সমাজের দুই দিকপাল, এরিষ্টটল এবং আলেকজান্ডার, দু’জনই বিশ্ব ইতিহাসখ্যাত। এরিষ্টেটল আলেকজান্ডারের চেয়ে বয়সে ২৮ বৎসরের বড় এবং তার শিক্ষক ছিলেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর এক বৎসর পরে তিনি মারা যান। বাইশ বৎসরের যুবক আলেকজান্ডার তলোয়ার হাতে সারা বিশ্ব চষে দেশের পর দেশ জয় করেছেন। দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রে তার প্রভাব পড়েছে। সে প্রভাব কয়েক শতাব্দী স্থায়ী হলেও পরবর্তি রাজা রাজড়ার যুদ্ধ-সংঘাতে তার রেশ কেটে গেছে অনেকটাই।
ঐ একই সময়ে এরিষ্টেটল হাতে নিয়েছিলেন কলম। এরিষ্টেটলের চিন্তাধারা ও দর্শনকে ভিত্তি করে প্রথমে গ্রীক ও পরে রোমান সাম্রাজ্যে যে বৃদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সুত্রপাত ঘটে, তার সাথে আন্দালুসীয় মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের চিন্তা ভাবনার সংযোগের ফলে আন্দালুসেরই ইউরোপীয় ছাত্র রজার বেকন জন্ম দেন ইউরোপীয় রেনেসা’র। গ্রীসের এ্যারষ্টেটল, আন্দালুসের মুসলিম দার্শনিকগণ আর ইউরোপের রজার বেকন, সবার অস্ত্র ছিল একই: কলম।
গ্রীক সমাজের তিনজন দার্শনিক, প্রথমে সক্রেটিস, তার ৪১ বৎসর পরে এসে প্লেটো এবং তারও ৪৪ বৎসর পরে এরিষ্টটল, প্রত্যেকেই কলম তুলে নিয়েছিলেন হাতে। তাদের কলম থেকে যা বেরিয়ে এসেছে, তা পুরো বিশ্বকে প্রভাবিত করে চলেছে আজও। দান্তে, রজার বেকন বা হেগেল যার কথাই বলুন না কেন, তারা সবাই ঐ ত্রিরত্নেরই উত্তরসূরী মাত্র। এমনকি আজকের ‘এডওয়ার্ড ডি বেনো’ও তাদের প্রভাব কাটাতে পারেন নি। আজও তাদের দর্শন আর চিন্তাধরাকে ভিত্তি করেই চলছে এ বিশ্ব।
এই ত্রিরত্নের যে দর্শন, তার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস করেছে একমাত্র ইসলাম। ইসলামই এদের দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ইবনে সীনা, গাজ্জালী, জালালুদ্দীন রুমী, আল বেরুনী, ফারাবী আর ইবনে খালদুনের মত ব্যক্তিত্বরা আর কিছু নয়, হাতে তুলেছিলেন একটামাত্র অস্ত্র: কলম!
‘হানাফী’ মতাবলম্বী বলে নিজেদের পরিচিত করার মাধ্যমে আমরা যে মহান ব্যক্তির অনুসারী হবার দাবীদার, সেই ইমাম আবু হানিফা’র সাথে খলীফা আল মানুসরের সংঘাত ছিল, কিন্তু কেন? কারণটা আর কিছুই নয়, আর্থিক দিক বিবেচনায় রিক্তহস্ত আবু হানিফার কলম থেকে যা বেরুত, তা টলিয়ে দিয়েছিল স্বৈরাচার আল মানসুরের তখত!
রিক্ত ইমাম আবু হানিফাকে মোকাবেলার কোন ক্ষমতাই ছিল না প্রবল ক্ষমতাধর আব্বাসীয় সম্রাট আল মানসুরের! জেলের অন্ধকারে বিষের জ্বালা সয়ে মরেও তিনি আজও বেঁচে আছেন কোটি কোটি মুসলমানের অন্তরে, কেবলমাত্র তার ঐ কলমের কল্যাণেই! ক্রমাগত কুড়ি দিন ধরে তাঁর জানাজার নামাজ চলতে থাকে, প্রতি জানাজায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী মানুষ শরীক হতেন। অথচ ঘাতক আল মানসুরের জানাজায় কতজন এসেছিল? কতবার জানাজা হয়েছিল তার? স্মরণই বা করে ক’জন?
আড়াই হাজার বৎসরব্যাপী চলে আসা ইরানের শক্তিশালী পাহলভী রাজবংশের শাসনের বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও চমকপ্রদ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন কিভাবে? নিজে নিরন্তর জ্ঞান চর্চা করেছেন, আর হাতে তুলেছেন কলম।
তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছে ‘কাশফ আল আসরার’ এবং ‘বেলায়েতে ফকীহ’র মত জগদ্বিখ্যাত বইগুলো। তাঁর ‘বেলায়েতে ফকীহ’ বইটা’ই পরবর্তিতে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ নামে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এই একটি বই’ই বদলে দিয়েছে ইরানসহ পূরো বিশ্বের চেহারা। আজও আমরা সে পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগুচ্ছি এবং ঘটমান পরিবর্তনের একেবারে প্রাথমিক স্তরেই রয়েছি।
মানুষকে বদলে দিতে পারে কলম, বদলে দিতে পারে সমাজ আর বিশ্বকেও। আমরা যারা নিজেদের পরিবর্তন চাই, পরিবর্তন চাই আমাদের সমাজের, সমাজবাসীর ভাগ্যের, তারা কেন নিশ্চুপ বসে থাকব? মহান আল্লাহ স্বয়ং যে কলমের কসম কেটেছেন (আল কুরআন, সুরা ৬৮), আমি, আপনি সেই কলম কেন হাতে তুলে নেব না?
আসুন, কলমই হোক আমার-আপনার, আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ওদের বুলেটের বিপরিতে গর্জে উঠুক, অনলবর্ষী অগ্নিঝরা হোক আমাদের কলমগুলো।
বিষয়: বিবিধ
১৯৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন