আট ছবিতে মুসলিম আন্দালুসের সাতশত বৎসর ও আমাদের শিক্ষা

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০২ জুন, ২০১৩, ০৭:৫৪:৩৩ সন্ধ্যা



উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে পরিচালিত আব্বাসীয়দের সফল বিদ্রোহ থেকে বাঁচতে কোনভাবে কেবলমাত্র নিজের প্রাণটুকু নিয়ে স্বস্ত্রীক পালালেন আব্দুর রহমান (আব্দুর রহমান ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান), সেই ৭৫১ সালে।

পথিমধ্যে তার ভাই ইয়াহহিয়া ধরা পড়ে নিজের মস্তক হারালেও তিনি অনেক কষ্ট সয়ে, মিশর, তিউনিশিয়া, মরক্কো এবং সবশেষে সাগর পেরিয়ে পৌছুলেন আন্দালুস; আজকের স্পেনে। সেটা সেই ৭৫৫ সালের ঘটনা। এর চল্লিশ বৎসর আগে তারেক বিন জিয়াদের মাধ্যমে স্পেনে মুসলিম শাসন চালু হলেও মুসলমানরা তখনও আরব ও অনারব আফ্রিকীয়দের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দে জড়িয়ে রয়েছে, তেমনি স্থানীয় খৃষ্টানরাও তখনও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল।

একদিকে উবাইদুল্লাহ ইবনে উসমান, আব্দুল্লাহ ইবনে খালিদ ও অপরদিকে আমির ইউসুফ আল ফিহরী, এই তিনপক্ষের যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত মুসলিম স্পেন যখন টলটলায়মান, ঠিক তখনই উমাইয়া শাসনের প্রতি পূর্ব থেকেই সহানুভূতিশীল সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ইবনে উসমান মরক্কোতে অবস্থানরত আব্দুর রহমানের কাছে সাহায্য চেয়ে দূত পাঠান। আব্দুর রহমানও এমন একটা মোক্ষম সময়ের জন্যই অপেক্ষমান ছিলেন। তিনি কাল বিলম্ব না করেই মাত্র ৩০০ সৈন্য নিয়ে মালাগার পূর্বপ্রান্তে নামলেন ৭৫৫ খৃষ্টাব্দে।

সেই শুরু, তারেক বিন জিয়াদ যে মিশনের শুরু করেছিলেন, তারই সমাপ্তি টানতে, স্পেনের এই বিশাল ভূখন্ডে ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে সুসংহত করতে নেমে পড়লেন আব্দুর রহমান। ৭৭৯ সালের মধ্যে তিনি স্পেনের অবিসংবাদিত আমীর! এর পরে যা ঘটেছে, তা কেবলমাত্র কল্পকথাতেই মানায়। এককালের অনূর্বর শুকনো ভূখন্ড স্পেন, কোন এক যাদুর বলে হয়ে উঠল পুরো বিশ্বের শস্য ভান্ডার যেন! শিক্ষা, সাহিত্য, গবেষণা, সংস্কৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক কর্মকান্ডে অবিষ্মরণীয়!



৭৯০ খৃষ্টাব্দের আল আন্দালুস (মুসলিম স্পেন)

কিন্তু তাতেও ঠেকানো যায় নি। এমারত হয়েছিল বটে, খেলাফত হয়নি। আর হয়নি বলেই মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য প্রতিষ্ঠার বদলে শিয়া-সুন্নী, আরব-অনারব, বংশ-গোত্র ভিত্তিক সংকীর্ণ জাতিয়তাবাদী মানসিকতা আগাগোড়াই চালু ছিল। আর ক্ষমতাসীনদের হীন স্বার্থে সে দ্বন্দ মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠতে সময় লাগেনি। তার ফলও মুসলমানরা ভুগেছে। মুসলমানদের অনৈক্যের সুযোগে খৃষ্টানরা এগিয়েছে। মুসলমানদের এক গ্রুপকে খেলিয়েছে অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে।



৯৪০ সালের আন্দালুস তথা মুসলিম স্পেন। লক্ষণীয়; উত্তরের বিরাট এলাকা মুসলিম হাতছাড়া হয়ে গেছে।

আমির তৃতিয় আব্দুর রহমান আন্তরিকতা দিয়ে এ ধারা ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন, তিনি অনেকটাই সফল হলেও পতনের ধারা ঠেকানো যায় নি। তার পরবর্তি শাসকদের মধ্যে ফাতেমী শীয়া ও উমাইয়া সুন্নী’র গোষ্ঠিগত দ্বন্দে মুসলমানদের ঐক্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে লাভবান হয় খৃষ্টান বন্ধুরা। তারা ততদিনে কোন কোন মুসলিম গোষ্ঠির বন্ধুরুপে আবির্ভূত হয়েছে। তারা কোন কোন মুসলিম গোষ্ঠিকে অন্য মুসলিম গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সহযোগীতাও করেছে! এর ফল হয়েছে এই যে, মুসলিম স্পেনের হাত থেকে আরও কিছু জায়গা খৃষ্টানদের হাতে গেছে, এতটুকুই মাত্র।



১০৮০ সালের আন্দালুস(সবুজ অংশটি মুসলমান এলাকা)

কিন্তু তাতেও দ্বন্দে লিপ্ত মুসলমানদের ঘুম ভাঙ্গেনি! ক্ষমতাপ্রাপ্তি বলে কথা! আরব-অনারব, আফ্রিকার বার্বার, সিরিয়ার উমাইয়া ও মিশরের ফাতেমীদের মধ্যে দ্বন্দ চলতেই থাকে। এই দ্বন্দে কোন কোন মুসলিম গ্রুপের জানের দোস্ত হয়ে এগিয়ে আসে খৃষ্টানরা সাহায্য সহযোগীতা নিয়ে! বিনিময়ে তাদের রাজ্য জয়ের ধারাও এগুতে থাকে সমান তালে!



১১৬০ এর দিকে মুসলিম আন্দালুস। অর্ধেকেরও বেশী এলাকা ততদিনে মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। (সবুজ অংশটি মুসলিম শাসনাধীনে )

আসলে যার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও তার কাছে জবাবদীহিতার স্থলে ক্ষমতার মোহ, ক্ষুদ্র গোষ্ঠিপ্রীতি একবার জায়গা করে নেয়, তার বা তাদের পতন ঠেকাবে কে? মালিকি, না শাফেয়ী, হাম্বলী না হানাফি, কোন মজহাবটি উত্তম? এমন অমূলক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যখন মুসলমানরা ব্যস্ত, খৃষ্টান বন্ধুরা(!) তখন মুসলমান জনগণের জন্য, মুসলিম স্কলারদের জন্য এরকম মাজহাবী বিতর্কের সুবিধার্থে দয়াপরবশ হয়ে বিতর্ক মঞ্চ তৈরী করে দিয়েছে, প্রতিপক্ষকে বিতর্কে ঘায়েল করায় তোহফা পাঠিয়েছে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরুপ! আর এরকম বিতর্কে মগ্ন থাকতে থাকতেই টলেডো’র মত শহরও হাতছাড়া হয়ে গেছে মুসলমানদের! নীচের ছবিটি তারই প্রমাণ।



১২১২ খৃষ্টাব্দে মুসলিম স্পেন। তিন চতুর্থাংশ এলাকাই ততদিনে মুসলমানদের হাত ছাড়া।

খৃষ্টানরা যত শক্তি সঞ্চয় করেছে, ততই মুসলমানদের পতনের ধারা দ্রুততর হতে থাকে। ১২১২ সাল থেকে ১২৬৫, মাত্র চারটি দশকের মধ্যেই অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছে যে, দক্ষিণের এক গ্রানাডা ছাড়া আর কোন এলাকাই মুসলমানদের হাতে রইল না।



১২৬৫ সালের মুসলিম স্পেন। স্পেনের নব্বই ভাগই তখন খৃষ্টানদের হাতে, দক্ষিণে একমাত্র গ্রানাডায় তখনও মুসলমানরা কোনমতে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ইতিহাস থেকে যদি কোন জাতি শিক্ষা না নেয়, তা হলে ইতিহাস তাদের উপরে চরম প্রতিশোধ নেয়। তারই প্রমাণ আমরা দেখতে পাই মুসলিম আন্দালুসে। সেটা গ্রানাডার অধিবাসীরাও বুঝেছিলেন, তবে তা অনেক দেরীতে। ততদিনে ইতিহাস তার প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছে। নীচের চিত্রটি তারই প্রমাণ;



১৪৯২ এর স্পেন। মুসলিম শুন্য স্পেন।

সাত শতাধিক বৎসর শাসন করেও মুসলিমরা স্ববংশে বিতাড়িত হয়েছে কেবলমাত্র নিজেদের মধ্যে অনৈক্য আর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দের কারণে। যে তার্কিক, স্কলার, রাজনীতিবিদদের বন্ধুত্বে বরণ করে নিয়ে তাদের দিয়েই মুসলিম সমাজে মাজহাবী বিতর্ক জিইয়ে রেখেছিল খৃষ্টানরা, সেই তাদেরকেই সবার আগে হত্যা করেছে তারা ক্ষমতা হাতে পাবার পরে। শিয়া কিংবা সুন্নী, হাম্বলী কিংবা মালেকি, আরব কিংবা অনারব, কোন বাছ বিচারই করেনি! তাদের কাছে একটা মাত্র পরিচিতিই মূখ্য ছিল; মুসলমান। মুসলমান হলেই তাদের পোড়াও, ইনকুইজিশন কিংবা ‘রিকংকেস্তা’র আগুনে।

চোখের সামনে এমন জ্বাজল্যমাণ উদাহারণ থাকতেও যদি কেউ অন্ধ হতে চায়, তবে তাকে, বিশেষ করে, বাংলাদেশের মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, অন্ধ হলেও প্রলয় কিন্তু বন্ধ থাকবে না।

বিষয়: বিবিধ

৪০৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File