মহাবীর খালেদ, মুসলিম নারী খাওলা এবং আমাদের তরুণ প্রজন্ম
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২৮ মে, ২০১৩, ০৯:৩৪:৫৩ রাত
দামেস্কের উপকন্ঠে মুসলিম সৈন্যরা রোমক বাহিনীকে অবরোধ করে রেখেছে। রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সৈন্যরাও সকল প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত। মহাবীর খালেদ সাইফুল্লাহ রা: এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীকে যে কোন মুল্যে রুখে দিতে প্রস্তুত। ৬৩৪ সালের ২০শে আগষ্ট। খালিদ রা: এই অবরোধ আরোপ করেন। এক নাগাড়ে তিনটি সপ্তাহেরও বেশী পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে মাঝে মধ্যে রোমান বাহিনীর কয়েকজন প্রখ্যাত জেনারেল মুসলিম বাহিনীর সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিজেদের প্রাণ হারিয়েছে, তাদের দুই জেনারেল Kulus এবং Azazeer হযরত খালেদ রা: এর সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতে বন্দী হন। মল্লযুদ্ধের আড়ালে দামেস্কের রোমান গ্যারিসন কমান্ডার তার প্রায় আশি হাজার সৈন্যের সাথে আসলে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছ থেকে আরও সৈন্য ও রসদ চেয়ে পাঠান মাত্র কুড়ি হাজার মুসলিম সৈন্যের সাথে লড়তে।
সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ ভোরে ফজরের নামাজ শেষে গুপ্তচর মারফত হজরত খালেদ রা: খবর পেয়ে যান, সম্রাট হেরাক্লিয়াস কনস্টান্টিনেপল থেকে আরও বারো হাজার ঘোড়সওয়ার সৈন্য ও প্রচুর রসদবাহী একটা বহর পাঠিয়েছেন এবং তারা ছুটে আসছে দামেস্কের দিকে। হজরত খালেদ রা: অগ্রসরমান এই সৈন্যবাহিনীকে দামেস্ক পৌছুবার আগেই রুখে দেবার জন্য হজরত জাররার রা: এর নেতৃত্বে পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি দলকে পাঠালেন দ্রুততার সাথে এগিয়ে গিয়ে ঐ সৈন্যদলকে রুখে দিতে, যেন তারা কোনমতেই দামেস্ক পর্যন্ত পৌছুতে না পারে।
মুসলিম সৈন্যদলটি উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের সীমান্তে রোমান বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে তাদের গতিরোধ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। মুসলিম বাহিনীর প্রতিটি সৈন্যই প্রাণপণে রুখে দেবার জন্য জানবাজী রেখে লড়ে যায়। জনবল, রসদ ও অস্ত্রের সংখায় অনেক বেশী সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে রোমান বাহিনীও যে কোন মুল্যে মুসলিম সৈন্যদের বাধা এড়িয়ে দামেস্ক পৌছুতে বদ্ধপরিকর। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হজরত জাররার রা: আহত হয়ে রোমান বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তারপরেও সেকেন্ড ইন কমান্ড হযরত রাফে রা: এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী রোমান সৈন্যদের বাধা দিয়ে যেতে থাকেন, আর তিনি এক দূতকে হজরত খালেদ রা: কে অবহিত করে বার্তা পাঠান।
খালেদ রা: খবর পেয়ে দোটানায় পড়লেন। বিগত তিন সপ্তাহেরও বেশী অবরোধের ফলে যুদ্ধ এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌছুছে যে, যে কোন সময় পূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত পারে। এ সময় কোনমতেই অবরোধস্থলে মূল বাহিনী থেকে তাঁর পক্ষে কোন সৈন্য পাঠানো সম্ভব নয়। সারাদিন তিনি ভীষণ চিন্তিত থাকলেও তাঁর প্রাত্যহিক আচরণে তার কোন প্রতিফলন দেখা গেল না। স্বাভাবিকই রইলেন এবং কিছু ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে শেষ পর্যন্ত তিনি আক্রান্ত মুসলিম বাহিনীর সাহায্যে নিজেই যাবার স্বিদ্ধান্ত নিলেন। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে মাঝ রাতের একটু পরেই গুটিকতক সৈন্য নিয়ে দ্রুতগতীতে ঘোড়া ছুটিয়ে একটু বেলা হলে ঘটনাস্থলে হাজির হলেন। তখনও মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল।
কালবিলম্ব না করেই হজরত খালেদ যুদ্ধের নেতৃত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় সৈন্য সাঁজালেন। মাথায় পাগড়ী, পুরো মুখমন্ডল কালো কাপড়ে ঢাঁকা মুসলিম বাহিনীর এক ঘোড়সওয়ার সৈনিকের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। এই সৈন্য নিজের জীবনের কোন পরওয়া না করেই শত্রু সৈন্যের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, দু’একজন রোমান সৈন্যকে হত্যা করে আবার চোখের পলকে কোনমতে নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরে আসছে। হজরত খালেদ তার নিকটবর্তী হবার চেষ্টা করতেই সৈন্যটি ত্বরিৎ আবার রোমান বাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়ে।
যুদ্ধ করতে করতে খালেদ রা: কখনও কখনও উক্ত সৈন্যের পাশাপাশি হলেই তিনি তাকে প্রশ্ন করছেন; ‘হে সৈনিক তুমি কে, তোমার নাম পরিচয় বলো, আল্লাহর কসম, তোমার বীরত্বে আমরা মুগ্ধ।’ কিন্তু মুসলিম সৈন্যটির মুখে কোন কথা নেই। তার চোখ দু’টিই দেখা যায় মাত্র, সে কোন জবাব না দিয়েই ময়দানের অন্যপ্রান্তে ছুটে চলে যায়, অন্য কোন কাফের সৈন্যের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করার পরে একবার হজরত খালেদ রা: তার পথ আগলে ধরলেন এবং সেই একই প্রশ্ন করলেন। কিন্তু তিনি যে জবাব পেলেন, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। নিজেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে নিতে নিতে সৈনিকটা কথা বলে উঠল। তার কন্ঠস্বর শুনে হজরত খালেদ রা: চমকে উঠে পেছনে সরে গেলেন, এ যে নারী কন্ঠস্বর!
ততক্ষণে সৈনিকটি বলে চলেছেন ‘আমি খাওলা, জাররার রা: এর বোন। আমার ভাইকে কাফেররা ধরে নিয়ে গেছে, আমি আমার ভাইকে মুক্ত করেই ছাড়ব, আর তারা যদি আমার ভাইকে হত্যা করে থাকে, তবে ভাই হত্যার প্রতিশোধ নেব’
বলা বাহুল্য, হজরত খালেদ রা: এর নেতৃত্বে এর কিছুক্ষণ পরে সেদিনই মুসলমানরা উক্তযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন এবং রোমান সৈন্যদের হাত থেকে আহতাবস্থায় হজরত জাররার রা:কে উদ্ধারও করা হয়েছিল।
ইসলাম প্রচার, তার বিস্তার ও রক্ষায় মুসলিম নারীদের অবদান অসামান্য। আর ইসলাম নারীকে ঘরে আবদ্ধ করেনি, বরং তার স্বাধীনতা ও মানবিক অবস্থান নিশ্চিত করেছে। আজকের প্রজন্ম সে কথা কতটা জানে? সেটাই প্রশ্ন।
বিষয়: বিবিধ
২৭৯৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন