গ্রানাডা টু পলাশী; চলুন একটু ঘুরে আসি।

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২০ মে, ২০১৩, ১১:৪১:৫৯ সকাল

৭১১ সালে তারেক বিন জিয়াদের সেই বিপ্লবী ঐতিহাসিক অভিযানের মাধ্যমে শুরু, আর ৭৫২ সালে খলীফা আব্দুর রহমানের হাত ধরে সমাপ্ত হওয়া স্পেন বিজয় পুরো বিশ্বের ইতিহাসকেই চিরদিনের মত বদলে দিয়েছিল।

৭৫৬ সালে (অধূনা স্পেন ও পর্তুগাল) যে আইবেরিয়েন পেনিনসুলা ভূখন্ডের একেবারে উত্তর এলাকায় ‘সান্তান্দার’ আর ‘ওবেদো’ ছাড়া আর কোন ভূখন্ডই ছিল না খৃষ্টানদের হাতে, সেই সেখান থেকেই তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ৯৪০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তারা উত্তর পুর্বের ‘বার্সিলোনা’ শহর থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিমের ‘পোর্টো’ পর্যন্ত দখল করে নেয়। কিন্তু মুসলমানরা তখন ফেকাহশাস্ত্রে মতদ্বৈততার কারণে একে অপরকে কাফের ফতওয়া দিয়ে বিবাদে লিপ্ত। কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। বরং এক মুসলিম গোষ্ঠি অপর মুসলিম গোষ্ঠিকে দমনের জন্য খৃষ্টানদের কাছ থেকে সহযোগীতাও নিয়েছে।

১০৮০ খৃষ্টাব্দে তারা যখন মধ্য স্পেন পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে, সেই তখনও মুসলমানরা একে অপরকে দমনেই ব্যস্ত। আর এর ফলশ্র“তিতে ১১৬০ এর মধ্যে আধুনিক পর্তুগালের রাজধানী লিসবন, স্পেনের টলেডো, সারাগোসা রাজ্যগুলো মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। এসময় পুরো স্পেন ছোট খাটো ২৩টি মুসলিম রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এসব মুসলিম রাজ্য খৃষ্টানদের সহযোগিতা নিয়ে পাশ্ববর্তি মুসলমানদের শায়েস্তা (!) করতে ব্যস্ত ছিল। চোখের সামনে একের পর এক স্বগোত্রীয় মুসলিম রাজ্যকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে হারাতে দেখেও তাদের বোধোদয় হয়নি!

১২১২ সালে যখন খৃষ্টানরা কর্ডোভার দোরগোড়ায় হাজির, সেই তখনও স্পেনের আলেম ও সাধারণ মুসলমানরা আজকের বাংলাদেশের মতই একে অপরের মধ্যে কে কতটা মজবুত ঈমানদার, সে বিতর্কে লিপ্ত।

আর এ সুযোগে কর্ডোভা, সেভিল, ভ্যালেন্সিয়ার মত মুসলিম রাজ্যগলো খৃষ্টানরা গিলে ফেললেও মুসলমানরা এক হয়ে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। খৃষ্টানরা তাদের মধ্যে সংস্কৃতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক জিইয়ে রাখে। এ লক্ষ্যে তারা মুসলিম সমাজে বেতনভূক্ত লেখক, বক্তা ও বুদ্ধিজীবি নিয়োগ দেয় সেই সমাজের মধ্য থেকেই।

মুসলিম সমাজের বিবেক বিক্রি করা এইসব তথাকথিত লেখক, বুদ্ধিজীবিরা খৃষ্টানদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ আর বিতর্ককে উপভোগ্যের আকারে চালু রেখেছিলেন। ঐ ভূখন্ডে ২৩টি মুসলিম রাজ্যের মধ্যে ততদিনে (১২৫০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ) এক এক করে উনিশটি রাজ্যই খৃষ্টানরা গিলে ফেলেছে, তার পরেও বাঁকি চারটি মুসলিম রাজ্য নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, একমাত্র সেইসব রাজ্যগুলির তথাকথিত সুশীল সমাজের কারণে। তারা নিজ নিজ এলাকার জনগণকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল মজহাবি বিতর্কে। ঠিক আজকের বাংলাদেশ যেন!

এর ফলে পরবর্তি ২৪২ বৎসরের মধ্যে বাঁকি চারটি রাজ্যও তাদের স্বাধীনতা হারায়। ১৪৯২ খৃষ্টাব্দে গ্রানাডার শেষ সুলতান আবু আব্দুল্লাহকে চোখের অশ্র“ ফেলতে ফেলতে স্বপরিবারে আল হামরা ছেড়ে আসতে হয়েছিল। মজহাবী বিতর্ক আর একে অপরকে ঈমানের পরীক্ষায় ধরশায়ী করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা সেদিন তাদের বাঁচাতে পারেনি। এর মুল্য যে কেবল তারাই দিয়েছেন, তা নয়। এর মুল্য দিতে হয়েছে তাদের পরবর্তি প্রজন্মকেও। আজও বিশ্বের মুসলমান স¤প্রদায় সেদিনে তাদের সেই নিস্পৃহতার মুল্য গুনে চলেছে!

সেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি নিকট অতিতে, আমাদের ভারতবর্ষের মাটিতে। সেক্ষেত্রেও নিস্পৃহ-নিষ্কর্মা গোষ্ঠি তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে নিজেদের অকর্মণ্যতার মুল্য পরিশোধ করেছিল। ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি। সুচতুর ইংরেজ বণীকরা এক এক করে ভারতবর্ষ দখল করে নিল চোখের সামনে। সব দেখেও তারা কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারল না। স্বাধীনতা তাদেরও হারাতে হয়েছিল। দীর্ঘ দুইটি শতাব্দী টানতে হলো পরাধীনতার গ্লানী।

১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা-বিহার হারাতে দেখেও ভারতবাসী কোন শিক্ষা নেয়নি। তারই ফলশ্র“তিতে ১৮৪৩ সালে সিন্ধু হারাতে হলো। এর পরেও তারা মগ্ন রইল নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদে। এ সুযোগে মাত্র একটি বৎসরের মধ্যেই ইংরেজরা ১৮৪৪ সালে গোয়ালিয়র দখল করল। তারপরেও ভারতবাসীর বোধোদয় হলো না! এর ফলও ভোগ করতে হলো ১৮৪৯ এ ভারতের ‘শষ্যভান্ডার’ পাঞ্জাব হারিয়ে। চেতনাহীন ভারতবাসীর নাকের ডগায় এর পরে এক এক করে ১৮৫২তে বার্মা এবং আফগানিস্থান, ১৮৫৩তে নাগপুর, আর ১৮৫৬তে অযোধ্যা বেদখল হলো! আর ১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহকে দিল্লি থেকে বার্মায় নির্বাসনে পাঠিয়ে ভারত বিজয়ের ষোলকলা পূর্ণ করল ইংরেজরা।

এরপরের ইতিহাস সবার জানা। আমাদের তরুণ প্রজন্ম কি গ্রানাডা থেকে পলাশীর বাঁকে বাঁকে লুকোনো গ্লানীময় এ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে?

বিষয়: বিবিধ

২৬৬১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

363869
২৮ মার্চ ২০১৬ রাত ০১:৩৭
বিভীষিকা লিখেছেন : ভালো লাগলো
২৮ মার্চ ২০১৬ দুপুর ০২:৩৭
301824
হককথা লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন বলে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File