আপনি কি মানবতার কল্যাণকামী? তাহলে; লিখে যান-
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২১ মে, ২০১৩, ১১:৫৬:২১ সকাল
আজ হতে প্রায় ২১৩৩ বৎসর আগে, খৃষ্টপূর্ব ১২০ সালের কথা। এক ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজ গিয়েছে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর এডেন এ। যুগটা ছিল নৌ বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ। বড় বড় নৌকাই ছিল বাণিজ্য কিংবা যোগাযোগের একমাত্র সহজ মাধ্যম।
পূর্ব ভারতের চট্টগ্রাম, মালাবার, দক্ষিণাত্য সিংহল এবং আরও পূর্বের সুমাত্রা নৌবন্দর থেকে জাহাজে রসদ ভরে নিয়ে যাওয়া হতো এডেন এ। সেখানেই ছিল মোকাম। অপরদিকে ইউরোপীয় অঞ্চলসহ আফ্রিকার বিভিন্ন নৌবন্দর হতে সে দেশের বণিকরাও নিজেদের মালামাল নিয়ে আসতেন এডেনে। এখানেই তারা নিজ নিজ দেশের মালামাল খালাস করে ফিরতি পথে নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজনমত অন্যান্য মালামাল নিয়ে ফিরতেন নিজ দেশে।
এক ভারতীয় জাহাজ এডেন পৌছুনোর আগে ঝড়ের কবলে পড়ে সমুদ্রে পথ হারায় এবং ডুবে গিয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ার এক বাণিজ্য জাহাজ এডেন বন্দরে নিজেদের মাল খালাসের পরে চাহিদামত মালামাল কিনে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে। পথে সমুদ্রের মধ্যে এক হতভাগা নাবিককে ভেসে থাকতে দেখে তাকে নিজেদের জাহাজে তুলে নেয়। হতভাগা এ নাবিকটা ছিল ঝড়ে ডুবে যাওয়া ঐ ভারতীয় জাহাজের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি।
মিশরীয় নাবিকদের সেবা শুশ্র“ষায় ভারতীয় নাবিকটি ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। উক্ত হতভাগ্য নাবিকটা নিজের মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষাই জানত না। আর ওদিকে মিশরীয় জাহাজের নাবিক, সওদাগরদেরও কোন ধারনা নেই হতভাগ্য এ ব্যক্তি কোন দেশের বাসিন্দা, কিই বা তার পরিচয়, কোথা থেকে এসেছে, যাবেইবা কোথায়? তার সাথে কথা বলে যে তার সন্মন্ধ্যে জেনে নেবে, তারও কোন উপায় নেই কারণ কেউ কারো ভাষা জানে না, বোঝেও না।
আলেক্জান্দ্রিয়া পৌছে সবাই এক এক করে নিজেদের বাড়ী ঘরে যাবার উদ্যোগ নিরেও ভারতীয় এ নাবিকের গতি কি হবে, তা নিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন বিপদেই পড়লেন। পরে তিনি তৎকালিন মিশরের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবি, দার্শনিক ও লেখক সপ্তম টলেমি’র শরণাপন্ন হলে তিনি এই হতভাগ্য নাবিকের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন আর তার শিষ্যদের বলে দিলেন তাকে যেন তৎকালিন রাষ্ট্রভাষা গ্রীক শেখানো হয়।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উক্ত নাবিক সুস্থ হয়ে উঠে। দৈনন্দিন জীবন যাপনসহ মনের ভাব আদান প্রদান এবং বাঁচার তাগিদে সে খুব দ্রুতই গ্রীক ভাষায় প্রাথমিক কথাবার্তা চালিয়ে নেবার মত উপযুক্ত হয়ে উঠে কয়েকমাসের মধ্যে।
এরকম অবস্থায় একদিন টলেমি এই ভারতীয় নাবিককে ডেকে পাঠালেন এবং তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। তিনি তার দেশের অবস্থান সন্মন্ধ্যে জানতে চাইলে নাবিকটি টলেমিকে জানালেন, অনেক দূরে পুর্ব দিকে সমুদ্রপারের এক দেশে তার বাড়ী। তার দেশে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে বাতাস বয়, প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এর ফলে। আর শীতকালে ঠিক তার উল্টো দিক থেকে, অর্থাৎ উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে হীমশীতল বাতাস বয়ে যায়। টলেমির বুঝতে বাঁকি রইল না যে, এই নাবিক এমন একটা দেশ থেকে এসেছে, যার দক্ষিণে সাগর আর উত্তরে রয়েছে উঁচু উঁচু পাহাড়।
তার কাছ থেকেই আলেক্সান্দ্রিয়ার বড় বড় ব্যবসায়ীরা জানতে পারল যে, তারা এডেন বন্দর থেকে হাতির দাঁত দিয়ে তৈরী মহামূল্যবান যেসব অলংকার, সুক্ষ মসলিন আর নানা ধরনের মশলা তারা কেনে, তা এই নাবিকের দেশ থেকেই আসে। আরব বণিকদের কমিশন না দিয়েই এই নাবিকের দেশ থেকে নিজেরাই যদি সরাসরি মালামাল নিয়ে আসে, তা হলে তাদের লাভের পরিমাণ আরও অনেক বেশী হবে; এই সম্ভাবনা দেখেই তারা হতভাগ্য এই নাবিকের দেশে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়।
আর ওদিকে ভারতীয় নাবিকও এতদিন দেখে এসেছে তার দেশের বণিকরা এডেন বন্দর থেকে উন্নতমানের তুলা নিয়ে যায় ভারতের বিভিন্ন মোকামে। সেই তুলা আসলে আলেক্সান্দ্রিয়ারই উৎপাদিত পণ্য, আর দামও অনেক কম। তাই সে মিশরীয় বণিকদের প্রস্তাব দেয়, তারা যেন তাদের নৌকায় মিশরের তুলা নিয়ে নেয় সাথে করে।
এর পরে মাত্র দু’মাসের মাথায় ভারতীয় বন্দরে এসে নোঙ্গর করে মিশরীয় বাণিজ্য জাহাজ। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে ঐ ভারতীয় নাবিক। ইতিহাসে সেই প্রথম কোন মিশরীয় বাণিজ্য জাহাজ ভারতের কোন বন্দরে এলো। সেই প্রথম কোন মিশরীয় নাবিকের দল ভারতের কোন বন্দরে এসে নামল। সেই প্রথম কোন ভারতীয় তৎকালীন বিশ্বপরশক্তির ভাষা; ‘গ্রীক’ শিখল। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত মিশর থেকে সরাসরী ভারতের নৌ রুটের সন্ধান পেল ভারত ও মিশরবাসী, দুই পক্ষই।
দুই দেশেরই ব্যবসা বাণিজ্য শিক্ষা সংস্কৃতিতে এর বিশাল ও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। আমরা দুই হাজার একশত বৎসর পরে এসে এ ইতিহাস জানতে পারছি, তার একমাত্র কারণ হলো, সে যুগের বিখ্যাত ভূগোলবীদ ও দার্শনিক ‘Strabo’ তার ‘Geographa’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে এ ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
এই হলো লেখালেখির ফল। আপনি যদি লিখতে পারেন, তবে লিখে যান। আপনার মৃত্যুর শত শত, এমনকি হাজার বৎসর পরেও কেউ হয়ত আপনার লেখাটা পড়বে। লেখাটা যদি সত্য, সুন্দর আর মানবতার কল্যাণধর্মী হয়ে থাকে, তা হলে সে লেখার দ্বারা মানবতা আপনার অলক্ষ্যেই কল্যাণপ্রাপ্ত হতে থাকবে। আপনার নিয়তের উপর ভিত্তি করে আল্লাহপাকও আপনাকে আপনার মৃত্যুর পরেও দিতে থাকবেন প্রতিদান। অতএব; লিখে যান-
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন