ইতিহাস কেবল তারাই গড়ে, যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়।
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০৯ মে, ২০১৩, ১১:২২:০৮ সকাল
ইয়ারমুকের যুদ্ধের কথা বলছি। যুদ্ধটা ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণী যুদ্ধ ছিল। আজও বিশ্বের সমরবিশেষজ্ঞরা এ যুদ্ধটিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, আর বিষ্মিত হন। যুদ্ধটি ৬৩৬ খৃষ্টাব্দের ১৫ই আগষ্ট থেকে ২০ শে আগষ্ট পর্যন্ত মোট ৬ দিন ধরে সংঘটিত হয়েছিল।
হযরত আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ ও পরবর্তিতে হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে তিরিশ হাজারের কিছু বেশী মুসলিম সৈন্য মোকাবেলা করে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সাড়ে তিন লক্ষ প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সৈন্যকে। বর্তমান জর্ডান ও সিরিয়া সীমান্তে ইয়ারমুক নদীর তীর ও তৎসংলগ্ন উপত্যাকায় যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে অসম এ যুদ্ধে ইসলামি সৈন্যবাহিনীই জয়লাভ করেছিল আল্লাহর অশেষ রহমতে। এ জয়ের ফলেই ইসলাম বাইনজান্টাইন সাম্রাজ্যের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়।
ছয়দিন ধরে চলা যুদ্ধের শুরুটা ছিল বড়ই চিত্তাকর্ষক এবং হৃদয়গ্রাহী। যুদ্ধের প্রথম দিন ভোরে মুসলিম সৈন্যরা ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন। একদল নামাজে দাঁড়ালে অন্য দল সেনাছাউনি প্রহরায় দাঁড়িয়ে থাকে। নামাজ শেষকারী দল এসে ছাউনি প্রহরার দায়িত্বে দাঁড়ালে এবারে দ্বিতীয় দলটি গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ দাঁড়ানোতে কে যে সাধারণ সৈন্য, আর কে পদস্থ অফিসার, জেনারেল, তা বোঝার কোন উপায়ই ছিল না। দূরে দাঁড়ানো রোমান সৈন্যবাহিনীর কেউ কেউ তা লক্ষ্য করেছে। এভাবে পুরো মুসলিম সৈন্যবাহিনীর নামাজ শেষ হলে দ্রুততার সাথে তারা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে সুশৃংখলভাবে দাঁড়িয়ে যায়।
সেকালের প্রথানুযায়ী মুল যুদ্ধ শুরুর আগে উভয়পক্ষের দু’একজন বীর এগিয়ে এসে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। এরই ধারাবিহকতায় রোমান বাহিনীর একজন জেনারেল, জর্জ, আরবীতে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ‘জারজাহ’ হিসেবে, এগিয়ে এলেন ময়দানে। মুল রোমান বাহিনীর মধ্য থেকে এগিয়ে খানিকটা দুরে এসে সারীবদ্ধভাবে দাঁড়ানো মুসলিম বাহিনী হতে কিছুটা দূরে নিজ ঘোড়ার উপরেই রইলেন আর হযরত খালিদ রা: এর নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলেন।
হযরত খালিদ রা: সহ মুসলিম সৈন্যবাহিনী ধারনা করলেন যে রোমান জেনারেল খালিদ রা:কে একক যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। তাই তিনিও ঘোড়ার পিঠে দ্রুত এসে জেনারেল জর্জের সামনে দাঁড়ালেন। রোমান জেনারেল হযরত খালিদ রা: দিকে তাকিয়ে বার বার তার আপাদমস্তক দেখতে থাকলেন, আক্রমণের কোন চেষ্টাই করলেন না। খালিদ র: যেমনি, তেমনি পুরো মুসলিম সৈন্য বাহিনীও রোমান জেনারেলের এমন আচরণ দেখে কিছুটা অবাক হলেও পুরো মাঠ জুড়ে পিন পতন নিস্তব্ধতা। টান টান উত্তেজনা সবার মধ্যেই, কখন দু’জেনারেলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, সেটা দেখার জন্য।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে জেনারেল জর্জ খালিদ রা: এঁর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন;
- আমার কিছু বিষয় জানার দরকার ছিল আপনার কাছে। আপনি দাস নন একজন স্বাধীন ব্যক্তি, একজন স্বাধীন ব্যক্তি কখনও সত্য বলতে পিছ পা হন না। আপনি একজন মহৎ ব্যক্তি, মহান ব্যক্তিরা কখনও প্রতারণা করেন না। আমাকে সত্য করে বলুন তো, সত্যিই কি আপনাদের নবীর কাছে বেহেশত থেকে ইশ্বর কোন তরবারী পাঠিয়েছেন, সেই তরবারী কি আপনাদের নবী আপনাকে দিয়েছেন, যার বদৌলতে আপনি এতটা বীরত্ব প্রদর্শন করেন, কেউই আপনাকে পরাজিত করতে পারে না। আপনাকে ডাকাও হয় ‘সাইফুল্লাহ’ বা আল্লাহর তরবারী বলে?
- ‘না, এটা সত্য নয়।’ হযরত খালেদ রা: এঁর সংক্ষিপ্ত ও সোজা সাপ্টা উত্তর।
- তা হলে ্আপানকে ‘সাইফুল্লাহ’ বা আল্লাহর তরবারী হিসেবে ডাকার কারণটা কি? রোমান জেনারেল জানতে চাইলেন।
হযরত খালেদ রা: অতি সংক্ষেপে মুত্বা’আ যুদ্ধের কথা শোনালেন রোমান জেনারেলকে, এও বললেন যে, সে যুদ্ধের পরে আল্লাহর প্রিয় হাবিব, রাসুলুল্লাহ সা: তাকে সাইফুল্লাহ উপাধী দিয়েছেন।
রোমান জেনারেল মন দিয়ে তা শুনে এবারে খালিদ রা: এর উদ্দেশ্যে বললেন;
-আমার উদ্দেশ্যে আপনার কোন বক্তব্য থাকলে বলুন।
হযরত খালেদ রা: রোমান জেনারেলকে বললেন; ‘আমি আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছি ইসলাম গ্রহণের জন্য, এ স্বাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, মুহাম্দ সা: আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রাসুল, আর তিনি আল্লাহর কাছ থেকে যা এনেছেন, সেই অহীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের।’
- আমি যদি তা না মানি! রোমান জেনারেল হযরত খালেদ রা: এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন।
- ‘আপনি তা স্বীকার না করলে ইসলামি সরকারকে জিজিয়া ট্যক্সি দেবেন, বিনিময়ে আমরা আপনার সকল ধরনের নিরাপত্তা প্রদান করব।’ হযরত খালেদ রা: এর সোজা সাপ্টা জবাব।
- তাও যদি না দেই! এবারে রোমান জেনারেল জানতে চাইলেন।
তা হলে আমাদের মধ্যে তরবারীই ফয়সালা করে দেবে। হযরত খালেদ রা: বলে উঠলেন।
এ পর্যায়ে রোমান জেনারেল জর্জ বা জারজাহ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবলেন। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে কি যেন ভেবে তার পরে আবার মুখ তুলে খালিদ রা: এর নিকট জানতে চাইলেন;
- আজ যদি কেউ আপনাদের ধর্ম গ্রহণ করে, তা হলে তার মর্যাদা ও অবস্থান আপনাদের মধ্যে কেমন হবে?’ জেনারেল জর্জ জানতে চাইলেন।
- আমাদের মধ্যে সবার একটাই মাত্র মর্যাদা, সবাই সমান। খালিদ রা: এর উত্তর।
-তা হলে স্বাক্ষী থাকুন, আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। আশশাহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশশাহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
পুরো ময়দানকে অবাক করে দিয়ে রোমান জেনারেল জাররাহ মুসলমান হয়ে গেলেন।এবং যুদ্ধেও অংশ নিলেন। শেষ পর্যন্ত রোমান বাহিনীর এক দশমাংশ সংখক সৈন্য ও স্বল্পতম রসদ নিয়েও আল্লাহর সাহায্যে হযরত খালিদ রা: এঁর নেতৃত্বে মুসলমানরা ইতিহাসের মোড় ঘুরানো এ যুদ্ধে জয়লাভ করে।
ইতোমধ্যেই বলেছি জেনারেল জাররাহও মুসলিম বাহিনীর হয়ে রোমানদের বিরুদ্ধে লড়েছেন এ যুদ্ধে। ইয়ারমুকের যুদ্ধে আবু জেহেলের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ইক্বরামা রা: সহ চার হাজার মুসলিম সৈন্য শাহাদাত লাভ করেন। অবাক বিস্ময়ের ব্যপার হলো, যুদ্ধের শুরুতে ইসলাম গ্রহণকারী জেনারেল জাররাহ’ও এ যুদ্ধে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর এই সম্মানিত সাহাবীর সাথে সাথে শহীদ হয়ে যান।
এ ঘটনার মর্মমূলে যে শিক্ষাটা রয়েছে, তা হলো; হেদায়েত একমাত্র আল্লাহরই হাতে। তিনি একেবারে শেষ মহুর্তেও ইচ্ছা করলে ইসলামের ঘোরতর শত্র“কেও ঈমানের মত অমূল্য সম্পদে ভূষিত করতে পারেন, নিতে পারেন কবুল করে। মুসলমানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো ঈমান, ত্বাকওয়া ও ধৈর্য। এ তিনটার হাত ধরেই আসে আল্লাহর সাহায্য। বিজয় নিজ দলের শক্তি ও রসদের জোরে নয়, বরং বিজয় আসে আল্লাহর সাহাযের উপরে ভিত্তি করে।
আজ প্রিয় বাংলাদেশে ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠি চেনা-অচেনা ইসলামবিদ্বেষীদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত, সেরকম একটা ক্রান্তিকালে বিষয়টা ইসলামপ্রিয় তরুণ যুবকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করছি, এই আশায় যে, তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবেন, কারণ, ইতিহাস কেবল তারাই গড়ে, যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়।
বিষয়: বিবিধ
১২২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন