' Turkey has been destroyed and shall never rise again, because we have destroyed her spiritual power: the Khilafah and Islam.' এর জবাবটা কে দেবে?
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০২ মে, ২০১৩, ১১:৪৬:৩৫ সকাল
ইংল্যন্ডের সাউথাম্পটন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জে এম রবার্টস (J M Roberts) গিয়েছিলেন কেনিয়া, হলিডে কাটাতে। বিশ্বসেরা ইতিহাস গবেষকের হলিডেতে যাওয়াটাও একটু ভিন্ন ধরনের হয়। হলিডেতে গেলেও তিনি যে চোখ জোড়া নিয়ে গেছেন সাথে, সেই চোখ দুটো গবেষকের চোখ, যে কান’দুটো নিয়ে গেছেন, সেগুলো একজন গবেষকের কান।
কেনিয়ার এক সমুদ্র উপকূলে হেঁটে বেড়ানোর সময় হঠাৎ তার নজরে পড়ল পেপসির একটা খালি ক্যান সমুদ্র উপকুলে নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে প্রচন্ড বেগে বাতাসের সাথে সাথে একবার এদিকতো আর একবার ওদিক ছুটে যাচ্ছে। আর প্রতিবারই এদিক ওদিক ছোটার সময় নূড়ি পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এক ধরনের আওয়াজও করছে।
রবার্টস একদন্ড থেমে গভীরভাবে ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। নুড়ি পাথরের সাথে খালি ক্যানটির নিরন্তর ঘর্ষণে সৃষ্ট আওয়াজটিও শুনলেন। ইংল্যন্ডের সাউথাম্পটন থেকে হাজার হাজার মাইল দুরে অনুন্নত কেনিয়ার এক প্রত্যন্ত সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে বাতাসের ঝাপ্টায় ছুটে বেড়ানো ঐ ক্যানটিকেই তিনি দেখলেন পশ্চিমা সভ্যতার বিজয় নিশান হিসেবে, আর নুড়ি পাথরের সাথে অনবরত ঘর্ষণে সৃষ্ট আওয়াজকে তুলনা করলেন পশ্চিমা সভ্যতার বিজয়ডংকা’র সাথে। দেশে ফিরেই লিখে ফেললেন, জীবনের সেরা গবেষণা গ্রন্থ Triumph of the West বা পশ্চিমা সভ্যতার বিজয় ডঙ্কা’।
হ্যাঁ, যাদের চোখ আছে, আছে অন্তর্দৃষ্টি, তারা এ বাস্তবতাকে খুব ভাল করেই জানেন, মানেনও। আর নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সন্মন্ধে সচেতনতা, দর্শন ও বোধ বিশ্বাস বিশেষে কেউবা এ বাস্তবতায় উল্লসিত হন, কেউবা আবার নিজেদের পরাজয়কে স্মরণ করে নীরবে ছাড়েন দ্বীর্ঘশ্বাস। পূর্ব হতে পশ্চিমে, উত্তর হতে দক্ষিণে যে কোন গোলার্ধের যে কোন স্থানে যান না কেন, উন্নত বা অনুন্নত বিশ্বের যে কোন শহরে বা গ্রামে, অন্তর্চক্ষু মেলে দেখলে দেখতে পাবেন, বিশ্বময় আজ এই পশ্চিমা সভ্যতা, বা পাশ্চাত্য সভ্যতা তথা খৃষ্টবাদী সভ্যতার জয়জয়কার। সর্বত্র তাদেরই বিজয় কেতন উড়ছে।
পশ্চিমা সভ্যতা, তথা খৃষ্টবাদী সভ্যতা বিশ্বের আর সকল সভ্যতার উপরে এমনভাবে আধিপত্য বজায় রেখে চলতে পারেনি কখনই। মাত্র ক’টি শতাব্দী আগেতো এর নাম নিশানাও ছিল না। অথচ আজ সর্বত্র তারই দাপট।
ইসলামি খেলাফতের অধপতন ও বিলুপ্তি, সে এক দীর্ঘ, জটিল কিন্তু জানা ইতিহাস। এর চুড়ান্ত ও আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ। তার আগে সেই ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন অষ্ট্রীয় হাঙ্গেরী সিংহাসনের উত্তরাধিকার ফ্রাঙ্ক ফার্নান্ডেজ সার্বিয় উগ্র জাতিয়তাবাদী কর্তৃক সারাজেভো টাউন হলে নিহত হন। ঘটনাটি ছিল পুরোপুরি ইউরোপীয় ভূখন্ডে, ইউরোপীয় জাতিসমূহের আভ্যন্তরীণ বিষয়, স্থানীয় ও আভ্যন্তরীণ সংঘাত। কিন্তু সেই স্থানীয় ও আভ্যন্তরীণ’ সংঘাতকেই টেনে আনা হয় বিশ্বমঞ্চে। উদ্দেশ্য হিসেবে খুবই চটকদার একটি শ্লোগাণও খাড়া করা হয় The great war; to end all war.
বিশ্বে সকল যুদ্ধ সংঘাতকে চিরতরে বন্ধ করতেই এ যুদ্ধ; বিশ্বযুদ্ধ। ২৮শে জুলাই ১৯১৪ এর শুরু আর শেষটি দিনটি ছিল ১১ই নভেম্বর ১৯১৮। কিন্তু তারপরেও থামেনি। তুরস্কের সাথে মিত্রবাহিনী জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে, যার দৃশ্যমাণ পরিসমাপ্তি ঘটে কামাল পাশা কর্তৃক ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ ইসলামি খেলাফতকে বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে।
ইঙ্গ-ফরাসি মিত্রপক্ষের সাথে তুরস্কের সংঘাত অবসান ও তাদের ভূখন্ড ছেড়ে যাবার পূর্বশর্ত হিসেবে দাবী ছিল ইসলামি খেলাফতকে বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে। এ মর্মে কামালপাশার সাথে ব্রিটেনের একটা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। আর ইসলামি খেলাফতের আওতাধীন আজকের আরব ভূখন্ডসমুহ তথা ফিলিস্তিন, হেজাজ, ইরাক, সিরিয়া এসব ভূখন্ডগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করাটা তো ছিলই।
এতকিছুর পরেও খোদ ব্রিটেনেই সরকারের বিরোধিতা ছিল। ব্রিটেন তুরস্ক ছেড়ে চলে আসুক, তুরস্ককে স্বাধীনতা প্রদান করুক তা চাইছিল না। জনৈক ইংরেজ এমপি ব্রিটেনের পরিকল্পনার পরপরই ‘হাউজ অব কমন্স’এর ফ্লোরে দাঁড়িয়ে, লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ঝাড়েন!
এর উত্তরে লর্ড কার্জন সেদিন ‘হাউজ অব কমন্সে যে মন্তব্য করেন তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এক কঠিন বাস্তবতা। সেদিন তিনি উক্ত এমপি’র ক্ষোভ প্রশমণ করতে গিয়ে বলেছিলেন;
" The point at issue is that Turkey has been destroyed and shall never rise again, because we have destroyed her spiritual power: the Khilafah and Islam.."
ভাবানূবাদ: এক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে, তুরস্ককে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, সে আর কখনই উঠে দাঁড়াবে না। কারণ,আমরা এর অন্তর্ণীহিত শক্তি; ইসলাম ও খেলাফতকে ধ্বংস করে দিয়েছি।
এটাই আসল কথা। তুরস্ক নয়। আসল বিষয়; ইসলাম ও মুসলমানদের প্রাণশক্তি; তাদের ঐক্য। এই ঐক্যের প্রতীকই হলো ইসলামি খেলাফত। এই খেলাফতকে ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তুপের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি নতুন সভ্যতা, বিশ্বসভ্যতা। আমরা কেউবা তাকে বলি ‘খৃষ্টবাদী সভ্যতা’ কেউবা জানি ‘পশ্চিমা সভ্যতা’ বলে। কেনিয়াতে ঐতিহাসিক রবার্টস বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রপাড়ে নুড়ীপাথরের সাথে পেপসির খালি ক্যানের ঘর্ষণে এই সভ্যতারই বিজয়ডংকা শুনেছিলেন।
এই সভ্যতার বিজয় আনতে ইউরোপকে অনেক চড়া মুল্য দিতে হয়েছে। এমনিতেই তার বিজয় নিশ্চিত করা যায়নি। বিশ্বে কোন দর্শন, কোন মতবাদই বিনা আত্বত্যাগে প্রতিষ্ঠা পায়না। এটাই নিয়ম।
সকল যুদ্ধের সম্ভাবনা চীরতরে শেষ করে দিতে আয়োজিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কি আসলেই বিশ্ব থেকে যুদ্ধ শেষ করতে পেরেছে? পারেনি। ঐ চটকদার শ্লোগাণটি ছিল নিছক একটা প্রতারণা। এই প্রতারণার পথ ধরেই ইউরোপের সামনে তার সবচেয়ে বড় শত্রু ইসলামি খেলাফতকে তারা ভেংগে সেখানে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘মানবতাবাদ’ এসবের আড়ালে নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পেরেছে মুসলিম দেশসমুহকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রভাব বলয়ে বেঁধে নিতে।
এর জন্য অতি চড়া মূল্যও তারা পরিশোধ করেছে। জার্মানি হারিয়েছে কুড়ি লক্ষ প্রাণ। ফরাসীরা চৌদ্দ লক্ষ, ইতালীয়রা চার লক্ষ ষাট হাজার আর ব্রিটিশরা হারিয়েছে ছয় লক্ষ জীবন। এর বিপরিতে রাশিয়া যে কত লক্ষ প্রাণ হারিয়েছে, তার কোন হিসেব নেই। সম্ভবত এই চারটি দেশের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও তাদের হারাতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশী লোককে। কেউ কেউ বলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পাঁচকোটি প্রাণহানী হয়েছে।
এই পাঁচকোটি প্রাণই সব নয়। সম্পদের নজরাণাও গুণতে হয়েছে অগণন। সে যুদ্ধে যে সম্পদ ব্যয় হয়েছে তার সঠিক হিসেব এ বিশ্ব কোনদিনই পাবে না। তার পরেও এক হিসেবে দেখা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞে এক ব্রিটেনই ব্যায় করেছে সাত বিলিয়ন পাউন্ড, আজকের হিসেবে তা প্রায় সাতশত বিলিয়নেরও বেশী। ফ্রান্স ব্যায় করেছে দুই বিলিয়ন, জার্মানি তিন বিলিয়ন ইতালি পাঁচ বিলিয়ন, সেই সেদিনের হিসেবে। আজকের মূল্যমানে এগুলো কয়েকশত গুণ বেশী হতে বাধ্য।
এই যে জীবন ও সম্পদের নজরাণা, এটা কিন্তু একটা দর্শনকে, একটা মতবাদকে বিজয়ী করে তুলতে অন্যতম একটা শর্ত। সে শর্ত তারা পূরণ করেছে। আর সেটা করেছে বলেই কেনিয়ার সমুদ্র তীরেই কেবল নয়, বিশ্বের যে কোন স্থানে, এমনকি সেই আমাজনের জঙ্গলেও আজ তাদের মতাদর্শের বিজয়ডংকা শোনা যায়।
আজ যারা ইসলামি আদর্শকে বিশ্বের বুকে বিজয়ীর আসনে দেখতে চান, তারা কি প্রাণ আর সম্পদের এরকম নজরাণা দিতে প্রস্তুত? প্রশ্নটা সেটাই। ভোগবাদী বিশ্বে মুসলমানরা, বিশেষ করে, ইসলাম আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর একটা বিরাট অংশ যেভাবে দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক জুড়ে নিয়েছেন, নিচ্ছেন, তা দেখে মনে বিরাট প্রশ্নের উদয় হয় বৈকি!
তাদের প্রতি প্রথমযুগের ইসলামি আন্দোলনের ঘটনাগুলো, সাহাবাদের ত্যাগ, কুরবানী আর আত্বত্যাগের ঘটনাগুলো আরও একবার দেখে নেবার নিবেদন রইল সবিনয়ে। (সংক্ষেপিত)
বিষয়: বিবিধ
১৪৬২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন