আসুন জানি ‘মধ্যযুগ’ কোন সময়কাল? এবং তার চিত্র কেমন ছিল?

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২৪ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৪৫:০৮ সকাল

হেফাজতে ইসলামির ঘোষিত তের দফা নিয়ে বাংলাদেশে চিহ্নিত ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠি কর্তৃক সীমাহীন অপপ্রচার চলছে। বাম নেতা রাশেদ খান মেনন, সুলতানা চক্রবর্তী আর আমাদের সবজান্তা জাফর ইকবাল’রা দিন রাত ত্বারস্বরে চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছেন, তের দফা নাকি দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেবে। এর একটি দফা মানলেই নাকি দেশ একশত বৎসর পিছিয়ে যাবে! দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে এসব অপপ্রচারের মধ্যেই দেখতে চাই ‘মধ্যযুগ’ আসলে কি? মধ্যযুগে বিশ্বের অবস্থানটাই বা কেমন ছিল।

মধ্যযুগ বলতে খৃষ্টিয় পঞ্চম শতাব্দী হতে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত, মোট এক হাজার বৎসরের সময়কালকেই বোঝানো হয়। আর এই সময়কালটিও তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। পঞ্চম শতাব্দী, স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, ৪৭৬ খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে নবম শতাব্দীর শেষভাগ অর্থাৎ ১০০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় পাঁচশত বৎসরের এসময়কালকে গণ্য করা হয় মধ্যযুগের প্রথম পর্যায় তথা ‘Early Middle Age’ হিসেবে।

এটা ছিল পুরো রোমান সাম্রাজ্যজুড়ে চরম অস্থিরতার যুগ। প্রকৃত অর্থে, এর পতন শুরুর যুগ। এ সময়কালের শুরু থেকেই রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব (বাইজান্টাইন) ও পশ্চিমাংশ (রোম) পারষ্পরিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একই খৃষ্টবাদের অনুসারী হওয়া সত্তেও রোম ও বাইজান্টাইনের মধ্যে এ দ্বন্দ বহু প্রাণ ও সম্পদহানী ঘটিয়েছে। ঠিক এ সময়কালেই সপ্তম শতাব্দীতে (৬১০/৬১১ খৃHappy ইসলামের আবির্ভাব এবং তারই হাতে রোমান সাম্রাজেÍ পতন শুরু হয় সিসিলিতে (৭০০ খৃHappy, স্পেনে (৭১১) মুসলিম অভিযানের মাধ্যমে।

সপ্তম শতাব্দীর ৬৩৪ খৃষ্টাব্দ হতে ৬৪৪ খৃষ্টাব্দের মধ্যে রোমান সাম্রাজ্যের সিরিয়া, ফিলিস্তিন, পারস্য সাম্রাজ্য (৬৪২-৬৪৪), ইরাক, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, মিশর, তথা নীল নদীর তীর থেকে শুরু করে পূর্বে সিন্ধু নদী পর্যন্ত ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তৃুত হয়। এই একটি দশকের মধ্যেই প্রায় ৩৬০০০ নতুন শহর ইসলামি সাম্রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়। আর এসব জনপদে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪০০ নতুন মসজিদ, যার প্রতিটিই এক একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে ঠিক সেই সময়, যখন, ইউরোপে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই ছিল না। পৃথিবীর নানাদিকে মুক্তির পয়গাম হিসেবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ায় কোটি কোটি মানুষ দাসত্ব ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পায়।

এই সময়েই প্রায় হাজার বৎসর পূর্বে ইহুদিদের প্রতি জেরুজালেমের পবিত্র স্থানে প্রার্থনা করার উপরে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল রোমান খৃষ্টানরা, তা তুলে নিয়ে খলিফা ওমর ইহুদিদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেন। অপরদিকে ৭১১-৭৫২ সালের মধ্যে ইহুদি জাতিসহ প্যাগানরা তাদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরে পায় মুসলিম স্পেনে। আর স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থ-বিত্তে পৃথিবীর সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এ যুগের দ্বিতীয় পর্যায় (১০০০ খৃষ্টাব্দ থেকে পরবর্তি আড়াইশত বা তিনশত বৎসর) অর্থাৎ ‘High Middle Age’। আজ আমরা যে ভূখন্ডকে ‘ইউরোপ’ বলে জানি, সেই ইউরোপের উদ্ভব হতে থাকে ১০৬৬ খৃষ্টাব্দে পোপের নির্দেশে ফরাসিগণ কর্তৃক ইংল্যন্ড দখলের পর থেকে। ‘হলি রোমান এম্পায়ার’ থেকে বিকৃত খৃষ্টবাদ ‘পলিনিজম’কে ভিত্তি করে এসব অঞ্চলে খৃষ্টবাদী দর্শনের বিস্তৃতি ঘটতে থাকলে একদিকে প্যাগানিজম ও অন্যদিকে ‘এরিয়ান’ খৃষ্টবাদের সাথে এই ‘পলিন’ খৃষ্টবাদের সংঘাত শুরু হয়।

এটাই ছিল ধর্মীয় উন্মাদনা বা ‘রিলিজিয়স ফ্যানাটিজম’ তথা মৌলবাদী আন্দোলন। এ সময়েই ধর্মের নামে বিরোধিদের নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারার (ইনকুইজিশন) প্রথা শুরু হয়। ‘রিলিজিয়াস পারসিকিউশন’ মধ্যযুগে ইউরোপেরই উদ্ভাবন। এই ফ্যানাটিসজম বা ধর্মীয় উন্মাদনার হাত ধরেই ১০৯৫ খৃষ্টাব্দে পোপ দ্বিতীয় আরবান কর্তৃক ক্রসেডের ঘোষণা। ইসলামিক প্রাচ্য ও খৃষ্টবাদী পাশ্চাত্য এ দু’য়ের মধ্যে সংঘাতের শুরু, যা আজও চলছে।

সহস্রাব্দীর শুরুর দিকে, তথা একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া ভূ-রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মেরুকরণ, ব্যপক নগরায়ন ও সংস্কৃতিক পরিবর্তন-বিবর্তন এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠির মন মানসিকতায় এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৩৪০-১৩৫০ সাল নাগাদ ‘পলিন’ খৃষ্টবাদী আদর্শকে ধারন করে এ ভূখন্ডটি ‘ইউরোপ’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে ছোট ছোট রাজ্যগুলোর পাষ্পরিক যুদ্ধবিগ্রহ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

ততদিনে পলিন খৃষ্টবাদের কারণে সমাজে মুক্তচিন্তার দ্বারও রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাদ্রী ও ধর্মীয় যাজকরা সমাজকে ধর্মের নামে অন্ধ আনুগত্যে বন্দী করে বিজ্ঞানচর্চা ধর্মবিরুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বিজ্ঞানীদের আগুনে পুড়িয়ে, বা কারারুদ্ধ করে হত্যা করে। ইউরোপ চরম এক অন্ধকারের মধ্যে নিপতিত হয়। হানাহানী, মন্দা, আকাল, বেকারত্ব আর রোগ-জ্বরায় সে ধংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। ১৩৪৭-১৩৫০ মেয়াদের কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ডেথ’ এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে পুরো ইউরোপের এক তৃতিয়াংশ মানুষ মারা গেলেও কোন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা ছিল না জনগণকে এ বিপদে সাহায্য করার মত।

মধ্যযুগের তৃতিয় পর্যায় তথা ‘Late Middle Age’ ছিল মোটামুটি ১৩৪০ এর কাছাকাছি সময়কাল থেকে ১৪৫০ খৃষ্টাব্দ বা তার কাছাকাছি, একটি শতাব্দী সময়কাল পর্যন্ত। ততদিনে স্পেনের মাটিতে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছে। মক্কায় ইসলাম আবির্ভাবের পর অহীর আলোয় আলোকিত আরব মুসলমানদের হাত ধরে স্পেনে প্রাচীন গ্রীক, হেলেনিক, আর্য, পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের জ্ঞানভান্ডারকে ভিত্তি করে যে বৃুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের সুত্রপাত হয়েছে, তা মুসলিম গ্রানাডায় উজ্জীবিত ইংল্যন্ডের সমারসেটের রজার বেকন (১২১৪-১২৯৬)’এর মত ত্বাত্বিক দার্শনিকের হাত ধরে ততদিনে ইউরোপের মাটিতে এসে উঠেছে।

একটা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ততদিনে দাঁনা বাঁধতে শুরু করেছে। আর সে ধারা তীব্র গতী পায় আধুনিক যুগের সূচনাপর্বে। ১৪৫৩ সালে তূর্কী ওসমানীয়দের দ্বারা কন্সটাান্টিনেপল তথা বর্তমান ইস্তাম্বুল বিজয়ের মাধ্যমে এই অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগের সমাপ্তি ও আধুনিক যুগের সুত্রপাত ঘটে, শুরু হয় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উন্মেষ।

মধ্যযুগের পুরো সময়কালটাই ছিল ইউরোপ জুড়ে নারীদের জন্য এক দু:স্বপ্ন ও বিভিষিকাময় কাল। ৬১০ থেকে ৬৩২ খৃষ্টাব্দ সময়কালের মধ্যে ইসলাম যখন একজন নারীকে মানুষ হিসেবে সমান অধিকার দিচ্ছে, মা’এর পা’র নীচে জান্নাতের অবস্থান ঘোষণা করছে, নারীকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের, ব্যবসা বাণিজ্যের, সম্পত্তি অর্জন ও রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার দিচ্ছে, স্বাধীনভাবে পেশা বেছে নেবার, কাজ-কর্ম করবার এবং বিয়ে-তালাকের অধিকার দিচ্ছে। পুরুষের মতই স্বৎকর্ম সম্পাদনের ভিত্তিতে পরকালীণ জীবনে মুক্তির সুসংবাদ শোনাচ্ছে, তখন ইউরোপের নারীরা কেবলমাত্র নারী হবার কারণে পুরুষের হাতে নিগৃহিত হয়ে চলেছে, ঠিক যেমনটা ইসলাম পুর্বযুগে আরবের নারীরা নিগৃহিত হচ্ছিল।

কথায় কথায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দেবার ক্ষমতা যেমন ছিল, তেমনি অতি সামান্য কারণেই নারীকে হত্যা করাটাও স্বামীর জন্য ছিল ডালভাত! সম্পত্তির মালিকানা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাতো ছিলই না বরং পাদ্রীদের প্রচারণার কারণে বাইবেলের শিক্ষানুযায়ী(?) নারীরা বিবেচিত হতো ‘সকল পাপের উৎস’ ‘জাহান্নামের দ্বার’ রুপে! নারীদের আত্বা পুরুষের আত্বার মত কিনা, সেটাও ছিল তাদের কাছে এক বিরাট গবেষণা(!)র বিষয়।

বস্তুতই মধ্যযুগ আজকের পশ্চিমাসভ্যতার জন্য ছিল চরম অন্ধকার যুগ, অমানবিক পশ্চাৎপদ সময়কাল, আর এর বিপরিতে ইসলামের জন্য ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক মুল্যবোধসহ অর্থনৈতিক, প্রাশাসনিক, ভূ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিকভাবে চরম উৎকর্ষতার যুগ।

আজ যখন এই মেনন-সুলতানা চক্রবর্তি গং হেফাজতের ১৩ দফা মানলে দেশ মধ্যযুগে ফিরবে বলেন, তখন জানতে ইচ্ছা করে মধ্যযুগের কোন অবস্থাটাকে তারা বোঝাতে চান? টিভি টকশো’তে ‘মধ্যযুগ’ ‘মধ্যযুগ’ বলে যারা গলা ফাটাচ্ছেন, তারা কি জানেন, মধ্যযুগীয় বর্বরতা কাদের অপকর্ম? জাতিকে বাংগাল ভেবে হাইকোর্ট দেখাবেন না প্লিজ।



বিষয়: বিবিধ

১৪৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File