ইসলামি সাংস্কৃতির বিপর্যয়, নিস্কৃয় মুসলমান ও বিপন্ন বাংলাদেশ

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২১ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:০৬:৩১ দুপুর



“ চাচাজান

সালাম বাদ আরজ, একিন করি আল্লাহর রহমতে বহাল ত্ববিয়তেই আছেন। আমি আল্লাহর রহমত ও আপনার নেক দোওয়ায় সহিহ সালামতে আসিয়া পোছিয়াছি। কলিকাতা আমার জন্য নতুন মোকাম হলেও কোন অসুবিধা হইতেছে না, মামা মামীর হামদর্দীর কোন মেছাল হয় না। তারা আমার কোন কিছুরই কমতি হইতে দেন নাই। অতএব আপনি আমার ফিকিরে পেরেশান হইবেন না, বরং নিজের তবিয়তের দিকে নজর রাখিবেন।

বা’দ আরজ আরও একটা খবর আপনাকে দিতে চাই। সেদিন আসিবার পথে দরিয়া ঘাটে আচানক মুহতারাম ওস্তাদজীর সাথে মোলাকাত হইয়া গেল। আমি আদবের সাথে সালাম দিলে তিনিও তাহার জবাব দিলেন, কিন্তু মনে হইল, তিনি যেন বহুত পেরেশান হইয়াই ছিলেন, দেখা মাত্রই আমার হাত দুইটি তাঁহার হস্ত মোবারকের মধ্যে ধরিয়া সবার আগে মরহুম আব্বা হুজুরের তবিয়তের সওয়াল করিলেন, দীর্ঘদিন সফরে থাকায় তিনি তাঁর আখেরি হাল জানিতেন না।

ওস্তাদজীর গলায় জবরদস্ত পেরেশানীর আলামত জাহির হইতেছিল। কি ভাবে তাঁকে আব্বা হুজুরের ইন্তেকালের খবরটা দিব, তাহাই ভাবিতেছিলাম, কয়েক পল খামোশ থাকিয়া তাহার দিকে তাকাইতেই তিনি আমার চোখে আঁসু দেখিতে পাইয়া যাহা বুঝিবার বুঝিয়া লইয়াছিলেন।

ওস্তাদজি বড়ই আকেলমন্দ, ইলমদার মানুষ, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়িয়া আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলাইয়া দিলেন আর বলিলেন, বাবা, হায়াত মওত আল্লাহর নিজের এখতিয়ার। তিনি ভাল মনে করিয়াছেন, তাই তাহাকে উঠাইয়া লইয়াছেন। তাহাতে কাহারো কিছু বলিবার নাই, থাকিতেও পারে না। তোমার আব্বা হুজুর বড় আলেম মানুষ ছিলেন, আমলও তাঁহার অনেক উঁচু মরতবার ছিল। ইয়াকিন করি, উমিদও রাখি, আল্লাহ পাক তাহাকে তাহার খাস মেহমান করিয়া জান্নাতেই রাখিবেন। তাঁর আওলাদ হিসেবে এখন তোমার উপরেই দায়িত্ব বর্তায়, দুনিয়াতে তার নেকবখতির প্রমাণ দিবে তোমার নিজের আমল আর আখলাকের মাধ্যমে। ইলম হাসিল করিবে, নিজে আমল করিবে, তোমার আম্মাজানের প্রতি খেয়াল রাখিবে, আর মরহুম আব্বাহুজুরের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত চাহিবে। ওস্তাদজি বিদায় লইক্ষার পূর্বে আরও কিছু নসিহত করিয়াছিলেন। ------ -- -- -- ”

উপরের বক্তব্যটি প্রায় শতাধিক বৎসর পূর্বে লিখিত একটা ব্যক্তিগত চিঠির অংশবিশেষ। কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কোলকাতায় পড়তে যাওয়া এক যুবক গ্রামে চাচার কাছে চিঠি লিখেছিলেন। কালের বিবর্তনে ক্ষয়ে যাওয়া চিঠিটির আংশিক পাঠোদ্ধার করেছিলাম প্রায় চল্লিশটি বৎসর আগে, যখন সবেমাত্র যৌবনের উপকন্ঠে পৌছেছি। চিঠির প্রেরক তখনও জীবিত, শতায়ূ বৃদ্ধ।

দীর্ঘদিন পরে চিঠিটি উল্লেখের উদ্দেশ্য; বাংলাভাষার তথাকথিত সংস্কারের নামে আমরা দৈনন্দিন জীবনে ইসলামি তহজীব হতে কতটা দূরে এসেছি, তা দেখা। চিঠিটা বিশ্ববিদ্যালয়গামী আমার দু’সন্তানের কাছে উপস্থাপন করলে তারা নিজেদের জ্ঞানের উপরে ভিত্তি করে এর পাঠোদ্ধার করতে পারেনি। অনেক শব্দেরই আভিধানিক ও ভাবার্থ তাদের অজানা। অথচ তারাও বাঙ্গালি মুসলমান, তবে আধুনিক প্রজন্মের!

এটাই প্রমাণ করে যে, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ইসলামি কৃষ্টি-কালচার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে দ্রুত। ইসলামি সংস্কৃতির যেটুকু তারা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় না গিয়েও পারিবারিক-সামাজিক বলয়েই শিখতে পারত, আজ তাদের সামনে সে সুযোগটুকুও নেই। এ অবস্থাটা একদিনে হয়নি, এমনিতেই হয়নি, হয়েছে দীর্ঘ সময়কালের সচেষ্ট প্রয়াসে। একটি বিশেষ গোষ্ঠি এরকম পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট ছিল, এখনও আছে। আগামিতে এ ধারা আরও বেগবান হবে, কোন সন্দেহ নেই।

আমার সন্তানদ্বয়ের মত বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বাংলা ভাষার ঐ চিঠিটা আবার ‘বাংলা’তেই তরজমা করে দিতে হবে! এভাবে;

“ কাকা

আশা করি ভাল আছেন। আমি ঠিকমতই এসে পৌছেছি কোন অসুবিধা হয়নি। কোলকাতায় নতুন হলেও কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। মামা মামীর আদরে ভালই আছি। আপনি অযথা আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না বরং নিজের স্বাস্থের দিকে দৃষ্টি দেবেন। আসার পথে মাস্টার মশাই’র সাথে ঘাটে দেখা হয়েছিল, কুশলাদি বিনিময়ের পরেই তিনি উদগ্রীব হয়ে আমার হাত ধরে বাবা’র অবস্থা জানতে চাইলেন, কিভাবে তাকে বাবার মৃত্যুসংবাদটি দেব ভাবছিলাম কিছুক্ষণ নতমুখে, অতপর যখন চোখ তুলে চাইলাম, আমার চোখে অশ্র“ দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছেন বিষয়টা।

মাস্টার মশাই অনেক বিজ্ঞ মানুষ, তিনি আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করে বললেন, বাবা, জীবন মৃত্যুর অধিকারী উপরের উনি, তিনি যেটা ভাল মনে করেছেন, তাই করেছেন। তোমার বাবা একজন জ্ঞানী ও কর্মবীর মানুষ ছিলেন, আশা করি ইশ্বর তাকে স্বর্গে ঠাঁই দেবেন। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে, তাঁর সন্তান হিসেবে যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠো, মায়ের দিকে খেয়াল রেখো, আর প্রয়াত বাবার কল্যাণ কামনা করবে---”

উভয় বক্তব্যের ভেতরে লেখক ও প্রাপকের ভাবাদর্শ ও চেতনাগত পার্থক্যটি সুষ্পষ্ট। একজন বাঙ্গালি যদি ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু হোন, তবে তার কাছে ‘আক্দ’'আক্বিদা 'ইক্করার’ 'ইনকার’ 'হিজাব’ 'ইজাব’ 'ইয়ানত’ 'দ্বিয়ানত’ 'জান্নাত’ 'জাহান্নাম’ 'জায়েজ’ 'নাজায়েজ এর কোন পরিচয় নেই, ব্যবহারও নেই। কিন্তু এসব শব্দের ব্যবহার ও সংরক্ষণ মুসলমান বাঙ্গালীদের চিন্তা-চেতনা সঠিক বিকাশে অত্যাবশ্যকীয় রক্ষাকবচ। এই রক্ষাকবচটিই অধূনা বাংলাদেশে নিশ্চিহ্নের পথে!

প্রক্রিয়াটি চলছে ব্রিটিশ ভারতীয় যুগ থেকে। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা থেকে সে কলেজের হিন্দু ছাত্র-শিক্ষকদের নেতৃত্বে শুদ্ধি অভিযানের নামে বাংলা ভাষা থেকে ইসলাম ও মুসলিম কৃষ্টি কালচারের প্রতিনীধিত্বকারী শব্দ বিদেয় করা শুরু হয়।

উক্ত কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান, ইংরেজ পাদ্রী উইলিয়াম কেরী অভিযানটির নেতৃত্ব দেন। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের মত ব্যক্তিরা। অচিরেই জোটে কবি ইশ্বরগুপ্ত, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্রদের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী, মুসলিম বিদ্বেষী কবি সাহিত্যিকরা।বঙ্কিমচন্দ্র প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন ‘ক্ষৌরিত চিকুর গো-হত্যাকারী মুছলমানের লেখা ইতিহাস দিয়ে বাঙ্গালীর (হিন্দুর) চলবে না’।

তামিল শব্দ 'ভিটু’ মানে, বাস করা। যেখানে বাস করে তাকে বলে 'ভিটুটি’ অর্থাৎ 'আবাসভূমি’। বাংলায় 'ভিটা’। 'ভিটামাটি’। বাংলাভাষায় ইসলামি শব্দ ছিল 'সাকিন 'মোকাম’। মুরুব্বীরা 'সাকিন-মোকাম’ চিনলেও বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ওগুলোকে বিদেশি শব্দ হিসেবে বর্জন করেছে বটে, তবে বিদেশী তামিল শব্দ 'ভিটু’ 'ভিটুটি’কে ঠিকই ধারন করেছে 'ভিটা-ভিটেমাটি’ হিসেবে।

একইভাবে, পালি ভাষার 'কপিতা’ থেকে সংস্কৃত 'কবিতা’। বাংলাতেও সেই 'কবিতা’ই। বিদেশী শব্দ হলেও 'কবিতা’কেই মোক্ষম অস্ত্র বানিয়েছি ইসলামের ‘আজান’কে তিরস্কার করতে। 'কবিতা’র ইসলামি প্রতিশব্দ 'শের’। একসময় 'শের’ লিখতেন 'শায়ের’রা। ইসলামি শব্দ 'শের’কে ‘বিদেশী’ হিসেবে বিদেয় করেছি 'শায়ের’ দরবেশ ফররুখ’কে 'শের’ লেখার অপরাধে অভূক্ত মেরেছি, যেন আর কোন 'শায়ের’ 'শের’ লেখার সাহস না দেখান!

এখনও জীবিত আল মাহমুদ, যতদিন ‘কবিতা’ লিখেছেন ততদিন পূজণীয় ছিলেন। তাঁর ‘সোনালী কাবিনে’র স্তুতিতে মুখে ফেনা তুলেছি। যেই না তিনি 'শায়ের’ হয়ে 'বখতিয়ারের তলোয়ার’ লিখলেন, অমনি ত্বকমা লাগালাম মৌলবাদী, রাজাকার বলে!

কারণ, আমরা কবিতার বিরোধি নই, 'শের’এর বিরোধি। কবির বিরোধি নই, আমরা 'শায়ের’কে সইতে পারি না। কবিতা হলো 'পালি’ আর 'শায়ের’ হলো 'ইসলামি’। যা কিছু ইসলামি, তাই পরিতাজ্য! আক্রোশটা বিদেশী শব্দের বিরুদ্ধে নয়, আক্রোশ হলো ইসলাম, ইসলামি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে!

বাংলা একাডেমি 'সংস্কারে’র নামে বাংলা ভাষা থেকে ইসলামি শব্দ তাড়িয়েছে যখন, তখন ইসলামি ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব ছিল তা রক্ষায় এগিয়ে আসা। কিন্তু সমস্যা হলো, সেখানে কোন বাংলাভাষী ‘আলেম’ নেই, আছেন 'ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলাভাষী সুশীল’! ফলে এক এক করে বাংলাদেশে শিক্ষা, সংস্কৃতিক পরিমন্ডল হতে ইসলাম ক্রমেই বিতাড়িত হচ্ছে, এরপরেও কি বাংলাভাষী 'আলেম’দের ঘুম ভাংবে না?

বিষয়: বিবিধ

১৮৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File