ফরজ ওয়াজেব-এর নতুন সঙ্গা বনাম আলেমদের নিষ্কৃয়তা। আলেমদের ক্ষমতা বুঝেছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গির, সুলতান আল মানসুর: বাংলাদেশও বুঝবে।

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ২১ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:১৩:৪০ রাত

যেখানে প্রধানমন্ত্রী, সেখানে থাকা ফরয। ফতওয়াটি হলো আমাদের বর্তমান রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক-এর। ( দ্রষ্টব্য: বি ডি টুডে, তারিখ; ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৪)

বাংলাদেশে বর্তমান বামনির্ভর সরকার কৌশলে ইসলামের মূলোৎপাটনে মরীয়া হয়েছে যেমনি, তেমনি একশ্রেণীর আলেমও সরকারের সহযোগী হয়েছে। তাদের নিষ্কৃয়তা এতদূর গড়িয়েছে যে, এদেরই কেউ কেউ কুরআন হাদিস দিয়ে প্রমাণের (!) চেষ্টা করেছে, মরহুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন খলীফা, খলীফাতুল মুসলিমিন! ‘বিসমিল্লাহ’তে নয়, ‘জয়বাংলা’তেই বরকত বেশী! এমন দাবীও করেছে। বিষ্ময়করভাবে নীরব কুরআনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার ক্ষেত্রেও! নিশ্চুপ যখন ইসলামের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র বাতিলের দোওয়া করায় মসজিদের ইমামকে প্রকাশ্যে পেটালো সরকারের পেটোয়া বাহিনী, তখনও!

আলেমদের এরকম ভূমিকা সাধারণ জনমানসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে বলে প্রকৃত আলেমগণই সর্বপ্রথমে যেকোন অনৈসলামিক কর্মকান্ড, বিশেষ করে, ইসলামের মৌলিক দর্শন, শিক্ষা, আক্বিদার বিরুদ্ধে আঘাতের ক্ষেত্রে নিজেদের জানমালকে তুচ্ছ করে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন। জনগণও সাথে যোগ দিয়েছে তাঁদের অনুসারী হয়ে।

আজ কিছু আলেম স্থান-কাল-পাত্র, বাতাসের গতীপথ বুঝে কথা বলে। সরকারের সাথেও এদের দহরম-মহরম, লেজুড় বেঁধেছে ক্ষমতাসীনদের সাথে। এরা জনগণের সামনে বলে একরকম, ক্ষমতাসীনদের সামনে ভিন্নকথা! এটা সুষ্পষ্ট মুনাফেকি! একবার প্রখ্যাত সাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা:কে কিছু লোক কথা প্রসঙ্গে বলল ‘আমরা নিজেদের মধ্যে যেভাবে বাক্যালাপ করি, আমাদের শাসক ও ক্ষমতাসীনদের সামনে যখন কথা বলি, তখন সেভাবে বাক্যালাপ করি না।’ হজরত আব্দুল্লাহ বললেন, রাসুলুল্লাহ সা: এর যুগে আমরা এমন আচরণকে ‘মুনাফেকি’ বলতাম। এটা বস্তুতই মুনাফেকি। তাই কোন আলেম এরকম দ্বৈত চরিত্রকে প্রশ্রয় দেননি। ইতিহাসে প্রতিটি যুগেই আলেমদের এরকম সাহসী ভূমিকার নজীর পাওয়া যাবে।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের জুলুমের বিরুদ্ধে নিরন্তর কথা বলায় তারা ক্ষেপে যায়। বিভিন্ন প্রলোভন, সরকারী পদ, ভয়ভীতি দেখিয়েও কাবু করতে না পেরে এই মহামানবটিকে করুণ, অমানবিকভাবে কারারুদ্ধ করে। তাঁর সাথে সমকালীণ অনেক আলেম-ওলামাকেও জেলে পুরেছিল। সরকারের অত্যাচার সইতে না পেরে অনেকেই নতী স্বীকার করে এবং সরকারের বিরোধিতা না করার প্রতিশ্র“তী দিয়ে মুক্তি পায়।

এমতাবস্থায় ইমাম হাম্বলের চাচা, ইসহাক গেলেন ইমামের কাছে সরকারপক্ষ থেকে বার্তা নিয়ে, ইমাম সাহেব সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে সরকার বিরোধিতা থেকে নিবৃত থাকলে তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে। ইমাম ইবনে হাম্বল জবাব দিলেন ’চাচা, আপনি আমাকে এই প্রস্তাব দিচ্ছেন? আপনি কি জানেন না, জাতির আলেমরাও যদি জেল-জুলুম থেকে বাঁচতে সত্য না বলে, তা হলে এই জাতির অজ্ঞরা চিরদিন অজ্ঞই রয়ে যাবে, সত্য কোনদিনই মিথ্যার উপরে প্রতিষ্ঠা পাবে না। আপনি প্রিয় হাবিব স: এঁর হাদিসটি এত দ্রুত ভুলে গেলেন? তিনি না আমাদের জানিয়েছেন যে, আমাদের পূর্বে সত্যপন্থীদের উপরে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যে, তাদের শরীর থেকে মাংশ আর হাড় আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তারপরেও তাঁরা সত্য বলা, জুলুমের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত হননি!’ ইমাম সাহেবের কথা শুনে তাঁর চাচা ইসহাক ফিরে আসেন।

ইমাম আবু হানিফাও জীবন দিয়েছেন তবু জালিমের সহযোগী হননি। এজন্য তাঁকে কারাগারে যেতে, চাবুকের ঘা সইতে হয়েছে বুড়ো বয়সেও। রক্তাক্ত হয়েছে তার শরীরও! তারপরেও তিনি বাদশাহ মানসুরের রাজকীয় প্রলোভনে পড়ে কাজীর দায়িত্ব নিয়ে একটা জুলুমনির্ভর শাসনযন্ত্রের সহযোগী হননি। শেষপর্যন্ত তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলল। তিনি শহাদাতের মৃত্যুকেই মেনে নিলেন, তথাপি আপোষ করেননি।

কে রুখেছিল জাহাঙ্গীরের অনৈসলামিক কর্মকান্ড? কোনো সেনাবাহিনী সেদিন আসেনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিপক্ষে, একাই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ‘মুজাদ্দিদ-এ-আলফে সানী’ সৈয়দ আহমেদ (রহ: ) । জেল খেটেছেন তবুও মাথা নোয়াননি স্বৈরশাসকের কাছে। মুজাদ্দেদ সাহেব ছিলেন বিত্তহীন, দরবেশ। বিষয়-সম্পত্তি, রাষ্ট্রক্ষমতা, সৈন্যবাহিনী, কিছুই ছিল না তাঁর। তবুও আপামর জনগণ, এমনকি, জাহাঙ্গীরের খুব কাছের লোকজনও তাঁর ভক্ত ছিল। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে মুজাদ্দেদ সাহেব অনেকসময়ই সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিভিন্ন অনৈসলামিক কার্যক্রম, বিশেষ করে, দরবারে সম্রাটের উদ্দেশ্যে সেজদাপ্রথা চালুর বিরুদ্ধে ফতওয়া দিলে জাহাঙ্গীর ক্ষিপ্ত হয়ে উজির আশফজাহ’র পরামর্শে মুজাদ্দেদ সাহেবকে ডেকে পাঠান। আশফজাহ’র উদ্দেশ্য ছিল মুজাদ্দেদ সাহেবকে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে কুর্ণীশ করিয়ে নেয়া।

বিষয়টা মুজাদ্দে সাহেবও বুঝেছিলেন এবং এটাও জানতেন, মদ্যপ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধাচরণ করলে সম্রাট শাস্তিস্বরুপ যে কোন আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু তারপরেও মুজাদ্দিদ-এ-আলফে সানী রহ: নির্দিষ্ট সময়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে গেলেন এবং সকল নিয়ম ভেঙ্গে মাথা উুঁচু করেই দরবারে ঢুকলেন। সেজদাতো নয়’ই , এমনকি সম্রাটকে সালামটাও দিলেন না।

সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষেপেই ছিলেন, তদূপরি এখনকার আচরণ আরও অসহনীয় ঠেকল। তিনি প্রশ্ন করলেন, মুজাদ্দিদ সাহেব কেন বাদশাহকে কুর্ণীশ না করে দরবারের আঈন ভঙ্গ করলেন? মুজাদ্দিদের কড়া জবাব ‘আমি সম্রাটের গোলাম না, আমি ‘আব্দুল্লাহ’! আল্লাহর গোলাম, তাঁর আঈনই আমার কাছে আঈন, এর বাইরে সবকিছুই বেআঈনী ’

জাহাঙ্গীর রাগে-ক্ষোভে জ্বলে উঠলেও নিজেকে সামলে জানতে চাইলেন; তা না হয় হলো, কিন্তু মুজাদ্দেদ সাহেব সম্রাটকে ইসলামি সালামটাও দিলেন না কেন? মুজাদ্দেদ এবারে আরও শক্ত জবাব দিলেন; সালাম দিইনি, কারণ তুমি অহঙ্কারী, হয়ত উত্তর দেবে না; তখন আমার সালাম দেওয়ার অর্থ হবে প্রিয় নবীর সুন্নতকে পদদলিত করানো!

এর পরের ঘটনা,কেবলই ইতিহাস! জাহাঙ্গীর ক্ষোভে ফেটে পড়ে মুজাদ্দেদ (রহ: ) কে তাৎক্ষণিকভাবে গোয়ালিয়র কারাগারে পাঠায়। আলফেসানী (রহ: ) হাসতে হাসতে কারাগারে গেলেও জাহাঙ্গীরকে না কুর্ণীশ করেছেন, না ক্ষমা চেয়েছেন। এই ছিল আলেমদের ভূমিকা মুসলমান সরকারের অনৈসলামিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে।

আজ বাংলাদেশে যখন এক এক করে ইসলামের উপরে আক্রমণ চলছে, বিভিন্ন কলা-কৌশলে ইসলামি বক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা, দূর্বল করা হচ্ছে, স্কুলের বইপত্রে অনৈসলামিক বিষয়াদি পড়িয়ে আগামি প্রজন্মকে ইসলামি চেতনা থেকে দূরে সরানো হচ্ছে। কুরআনকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে জাতীয় পাঠ্যক্রমের পাতায়! কুরআন হাদীসের চর্চা করা, বাংলাভাষায় ইসলামি বইপত্র পড়াটাকে অভিহিত করা হচ্ছে সন্ত্রাসের সমার্থক হিসেবে! তখনও একদল আলেম মুখে কুলুপ এঁটে নিশ্চুপ, নিরুপদ্রব জীবনকেই বেছে নিয়েছে। নিজেদের সম্মান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে নিরপেক্ষ(!) থাকছে! কোন বাদ প্রতিবাদের মধ্যে নেই!

তারা খুব ভালো করেই জানে হজরত ওমর রা: এর উক্তিটি; ‘আমরা ছিলাম নিগৃহিত ও অপমানিত একটা জাতি, ইসলামের কারণেই আল্লাহ আমাদের সম্মানিত ও ক্ষমতাশালী করেছেন। কেউ যদি ইসলাম ছেড়ে অন্যকোন মাধ্যমে সম্মান, ক্ষমতা অন্বেষণ করতে যায়, তবে আল্লাহ তাদের লাঞ্চিত করে ছাড়বেন।’

আমাদের আলেম সমাজের একটা অংশ ইসলাম ছেড়ে আজ সম্মান আর নিরাপত্তা খুঁজছেন অন্যখানে! আজ যখন বিভিন্ন ছলাকলায়, রাষ্ট্রিয়, সামাজিক, সংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইসলামকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চলছে, তখন আলেম-ওলামাদের এই নিস্পৃহতা আর কিছুই নয়, আল্লাহর ক্রোধকেই ত্বরান্বিত করে তুলবে এদেশে। এ বাস্তবতা উপলব্ধীর আহ্বান থাকল সকলের প্রতি।

বিষয়: বিবিধ

২০০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File