ভারতের কান্ডারা ও আজকের মুসলমান!!
লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৯ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৫২:৩১ সকাল
খুব বেশী দিন নয়, আজ থেকে দেড়শত বৎসর আগে ব্রিটিশ ভারতের একটা ঘটনা। উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের একটা গ্রাম; নাম ‘কান্ডারা’। হিন্দু, মুসলমান প্রায় একই সমান সংখ্যক জনঅধ্যূষিত গ্রাম। আর্থিক অবস্থা;শোচনীয়। বেশীর ভাগই ছিল মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ ছিল, আবার তারা একত্রে বসবাসও করত, চিরাচরিত নিয়মেই।
এ গ্রামেই হঠাৎ সংঘাতের সূত্রপাত হলো। একখন্ড পরিত্যক্ত জমি ছিল গ্রামে। জমিটিতে হিন্দু সম্প্রদায় মন্দির বানাতে উদ্যোগী হলে মুসলমান‘রা তার বিরোধিতা করে। তাদের দাবী, এটা মুসলমানদের জমি, এখানে মন্দির বানানো চলবেনা, বরং তারা সেখানে মসজিদ বানানোর ঘোষণা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুরা এর ঘোরতর প্রতিবাদ করে। মুসলমানরাও দাবীতে অনড়! অনিবার্য সংঘাতের মুখে বিষয়টি শেষপর্যন্ত আদালতে গড়ালে তা বিরাট প্রেস্টিজ ইস্যুতে পরিণত হয় উভয় গ্রুপের জন্যই। প্রত্যেক গ্রুপই তাদের সাধ্যমত দলীল-প্রমাণ, স্বাক্ষী সাবুদ জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু সেখানেও বাধে বিড়ম্বনা। এমন কোন দলীল প্রমাণ নেই হাতের কাছে কিংবা সরকারি সেরেস্তায়, যার ভিত্তিতে করে অকাট্যভাবে সনাক্ত করা যায় জমির প্রকৃত মালিককে। আদালত শেষ পর্যন্ত গ্রামের বয়স্ক, বিশ্বাসযোগ্য দু‘একজনকে আদালতে সমন করার কিংবা হিন্দু ও মুসলমান তথা বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষ যাদেরকে সাক্ষী মেনেছে, তাদের উপরেই নির্ভর করতে বাধ্য হয়।
এখানে একটা মজার ব্যপার হলো, হিন্দু স¤প্রদায় তাদের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে গ্রামের মসজিদের বৃদ্ধ ইমামকে সাক্ষী মানেন। হিন্দু হলেও তাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল, এই মুসলমান বৃদ্ধ ইমাম আর যাই হোক না কেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেন না, মিথ্যা কথা বলবেন না। তাঁকে দিয়ে ন্যায় বিচারের পরিপন্থি কোন কাজ করানো যাবেনা। জাত-বেজাত নয় বরং তিনি একমাত্র সত্যের পক্ষেই সাক্ষ্য দেবেন, কোন ভয় ভীতির পরওয়াও করবেন না।
হিন্দু স¤প্রদায়ের সাক্ষী হিসেবে বিচারক বৃদ্ধ ইমামকে আদালতে হাজির হতে সমন জারী করে। কিন্তু বৃদ্ধ ইমাম আদালতে হাজির হতে অস্বীকার করে বলেন, তিনি তাঁর দেশকে ধ্বংস করে দেয়া কোন কাফের, ইংরেজের মূখ দেখবেন না বলে পণ করেছেন, যেহেতু উক্ত আদালতের বিচারক একজন বিধর্মী ইংরেজ, তাই তিনি আদালতে যাবেন না সাক্ষ্য দিতে।
বিচারক ইমাম সাহেবের কথা শুনে বিব্রত ও ক্রোধান্বিত হলেও মামলার বিচারের স্বার্থেই বললেন; যদি ইমাম সাহেব সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন, তবে তাঁর পণ রক্ষার্থে বিচারক উক্ত সময়ে এজলাসের বাইরে অবস্থান করবেন এবং আদালতে উকিল পেশকাররাই তাঁর সাক্ষ্য রেকর্ড করবেন। এই ব্যবস্থায় ইমাম সাহেব নির্দিষ্ট দিনে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হলেন।
ইমাম সাহেব আদালতে সাক্ষী দিতে যাবেন শুনে হিন্দু ও মুসলমান সবার মধ্যেই দারুণ উত্তেজনা দেখা দিল। হিন্দুরা খূশী, কারণ তাদের বিশ্বাস ইমাম সাহেব আদালতে সত্য কথাই বলবেন। আর তেমনটা হলে তা হিন্দুদের পক্ষেই যাবে, কারণ, জমিটা আসলেই তাদের।
আর মুসলমানদের যদিও কেউ কেউ ভেবেছিলেন ইমাম সাহেব আদালতে সত্য কথাটাই বলবেন, যা প্রকৃতপক্ষে তাদের বিপক্ষেই যাবে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই বিশ্বাস করেছিলেন, আর যাই হোক না কেন, হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দে ইমাম সাহেব তার নিজ জাতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন না। কারণ, এখানে মুসলমান স¤প্রদায়ের মান-সম্মান আর ইজ্জতের প্রশ্ন জড়িত। জমিটাতে তো আল্লাহর ঘর মসজিদই বানানো হবে! অতএব একজন ইমাম হিসেবে তিনি কী করে নিজ জাতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে প্রস্তাবিত মসজিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন?
এরকম টান টান উত্তেজনার মধ্যেই বৃদ্ধ ইমাম আদালতে হাজির হয়ে গোরা ইংরেজের সাময়িক অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য দিলে তা আদালতে রেকর্ড হলো। ইমাম সাহেব বলিষ্ঠতার সাথে আদালতকে জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে ভূমিখন্ডের প্রকৃত মালিক হলো হিন্দু স¤প্রদায়। মাত্র কয়েক মিনিটের সাক্ষ্য প্রদান শেষে ইমাম সাহেব বেরিয়ে এলেন।
কিন্তু তিনি আদালতের সিঁড়ি বেয়ে দু কদমও নামতে পারলেননা। তাঁকে ঘিরে ধরল আক্রমণোদ্যত এক বিশাল মুসলিম জনতা। মামলায় হেরে যাওয়া মুসলিম পক্ষ সকল আক্রোশ আর ক্ষোভ নিয়ে সম্মানিত ইমাম সাহেবের উপরে নেকড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি কেন মুসলিম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে হিন্দুদের পক্ষে, তাঁর নিজ জাতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন? তাঁর কারণেইতো আজ মুসলমান স¤প্রদায়ের এই পরাজয়! কিছু পাষন্ড সম্মানিত ইমাম সাহেবের মাথার টুপি, মুখের দাঁড়ি ধরে টান দিল। ‘গাদ্দার’ ‘হিন্দুদের পেইড এজেন্ট’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে শারিরিকভাবে লাঞ্ছিতও করল!
বেচারা ইমাম সাহেব তার সকল শক্তি সঞ্চয় করে উত্তেজিত জনতাকে বোঝাতে তৎপর হলেন, সকল শক্তি তাঁর গলায় জড় করে বলে গেলেন ‘ ভাই সকল, আমি কোন অন্যায় করিনি, একজন মুসলমান হিসেবে কেবলমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছি। মনে রেখো, আমরা মুসলমান, আল্লাহ পাকের নির্দেশ ‘ ...... তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম, পূর্বে এবং এই আল কুরআনেও। যেন রাসূল তোমাদের উপের সাক্ষী হন, আর তোমরাও সাক্ষ্যদাতা হও মানবগোষ্ঠির জন্য’ (সুরা হাজ্জ -৭৮)
কে শোনে কার কথা! উত্তেজিত জনতা সম্মানিত ইমাম সাহেবের উপরে এক এক করে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকল। আর ইমাম সাহেব সকল আক্রমণ নীরবে সহ্য করেও বলে চলেছেন ‘ ভাই সকল, তোমরা আমার কথা শোন, বোঝার চেষ্টা কর, স্মরণ করো, মহান আল্লাহর নির্দেশ প্রতিটি মুসলমানের উপরে, তিনি পাক কালামে বলেছেন ‘ আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী গোষ্ঠি বানিয়েছি যেন তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষ্যদাতা হও, আর রাসূল হন তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা’ (আল বাকারাহ - ১৪৩)
রক্তাক্ত ইমাম বলে চলেছেন, ‘ভাই সকল আমি তোমাদের ক্ষোভ বুঝি, কিন্তু মিথ্যার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, বিশেষ করে একজন মুসলমান হিসেবে এটার ধারে কাছেও আমি যেতে পারিনা, তোমাদেরকেও যেতে দিতে পারিনা। মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে অপরের জমি বাগিয়ে সেখানে মসজিদ বানানোর কথা কোন মুসলমান চিন্তাও করতে পারেনা। মনে রেখো আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে ফেলোনা, আর জেনে শুনে সত্য গোপন করোনা’।
কিন্তু হায়, ততক্ষণে ইমাম সাহেবের করূণ দশা, তিনি আহত, রক্তাক্ত! উত্তেজিত মুসলিম জনতা ইমাম সাহেবের কোন কথাই শুনতে প্রস্তুত নয় যেন! অদূরে দাঁড়ানো হিন্দু স¤প্রদায়, যারা আজকের মামলায় নিজেদের পক্ষে রায় পেয়েছেন, পেয়েছেন জমির মালিকানা, এতক্ষণ তাঁরা মুসলিম জনগোষ্ঠির এই গর্হিত আচরণ দেখছিলেন, তাঁরাই এগিয়ে এলেন ইমামকে উদ্ধারে।
তাঁকে উদ্ধার করে তাঁরা নিজেদের পাড়ায় নিয়ে এনে প্রাথমিক পরিচর্যা করলেন। এবং সেখানেই তাদের নেতৃস্থানীয় একজনের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে ইমাম সাহেবের কাছে নিবেদন করলেন আদালত থেকে পাওয়া জমির দলিল। বললেন, হুজুর, আমরা আপনার মহানূভবতায়, সততায় মুগ্ধ। আমরা আপনার উপরে আক্রমণকারী ঐ জনগোষ্ঠির মত নয় বরং আমরা ‘আপনার মত’ই মুসলমান হতে চাই। এই জমি গ্রহণ করুন, এখানে আপনি মসজিদ বানান। আর আমাদেরকে, আমাদের সন্তানদেরকে আপনার মত করে তৈরী করুন। আমরা আপনার ধর্মে দীক্ষিত হতে চাই!
ইমাম সাহেবের উপরে আক্রমণকারী ক্রোধোম্নত্ত মুসলিম জনগোষ্ঠি দিনের পুরো একটি বেলা অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে দেখল, গ্রামের কয়েক শত হিন্দু জনগোষ্ঠি ইমাম সাহেবের সামনে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল! বিষ্ময়ে হতবাক এই মুসলমান(!) জনগোষ্ঠির মুখে কোন কথা নেই! যে জমিটা করায়ত্ত করতে তারা শত ছল চাতুরীর কোন কমতিই করেনি, সেই জমিই আজ গ্রামের হিন্দুরা স্বেচ্ছায় ইমামের হাতে তুলে দিল, তাই নয়, বরং তারা সকলেই স্বেচ্ছায় বাপ দাদার ধর্ম বিসর্জন দিয়ে মুসলমান হয়ে গেল!
এরকমই হয়। কারণ, ইসলাম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মনোনিত ধর্ম। সকল মানুষের জন্য, সর্বকালের জন্য নির্ধারিত ধর্ম। কাল কেয়ামত পর্যর্ন্ত টিকে থাকবে। বিশ্বের কোন না কোন মানব গোষ্ঠি এ ধর্মের মশালটিকে হাতে করে এগিয়ে যাবে। তারাই পরিচিত হবে মুসলমান হিসেবে। কেউ যদি এ কাজে অবহেলা করে, তবে তাকে মশাল বাহকের এ মর্যাদা হতে সরিয়ে তার স্থলে আল্লাহ পাক এমন একটা দলকে নিয়ে আসবেন, যাঁরা ইসলামকে মানব স¤প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করতে এগিয়ে আসবে। এব্যাপারে তারা এতটাই নিবেদিতপ্রাণ হবে যে, কোন শক্তিরই পরওয়া করবেনা , ভ্রুক্ষেপও করবেনা।
পুরো বিশ্বের মালিকতো আল্লাহ স্বয়ং। তাঁর বিশ্বে কি কোন কিছুর অভাব আছে? ছয়শত কোটি বিশ্ববাসীর দেড়শত কোটিকে তিনি মুসলমান বানিয়েছেন। এই দেড়শত কোটি মুসলমান যদি তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে, তবে কি তিনি তাদের বসনিয়া, চেচনিয়া, ফিলিস্তিন আর কাশ্মীরের মত আজাবে নির্মূল করে তদস্থলে ক্যাট স্টিভান্স’দের ইউসুফ ইসলাম হিসেবে দাঁড় করাতে পারেন না ইসলামের মশাল বাহক হিসেবে ? পারেন কিনা, তা জানতে আল কুরআনে সুরা মায়েদার ৫৪ নম্বর আয়াতটি দেখে নিতে পারেন ভালো করে। উত্তরটা সেখানেই আছে সুষ্পষ্ঠভাবে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন