একটি প্রশ্ন, হযরত আলী রা:’র দশ উত্তর ও আমার কষ্টের কথা-

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:১০:১২ দুপুর

হযরত আলী রা:, একেবারে প্রথমদিকে ইসলামগ্রহণকারী মুসলমান, ক্রমিক তালিকায় তাঁর অবস্থান দুই নম্বরে। কেউ কেউ অবশ্য তাঁর নামটি তিন নম্বরে দিয়েছেন।

ইসলাম গ্রহণকারী পুরুষদের মধ্যে তিনিই নবীজি সা: এঁর ঘনিষ্ঠ সাহাচর্য পেয়েছেন সবচেয়ে বেশী, তাঁকে দেখেছেন সবচেয়ে কাছে থেকে। এর ফলও ভোগ করেছেন সারাটি জীবন। তাঁর মন ও মনন, চিন্তা ও চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তিক আর মানসিক, মানবিক দিকগুলো বিকশিত হয়ে উঠে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মানে। জ্ঞানে, গুণে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দী একজন।

একবার নবীজির একটি বাণী পড়েছিলাম, যাতে দেখা যায়, (যতদূর মনে করতে পারি) তিনি স: বলেছেন ‘আমি জ্ঞানের শহর আর আলী সেই শহরের দ্বার’ বা এরকমই একটা বক্তব্য।

বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় আলেম আলী হাসান আল নদভী (রHappy হযরত আলী রা: এর একটি চিঠি অনুবাদ করেছিলেন আরবী থেকে উর্দূতে, তার একটা ইংরেজি ভার্সন প্রকাশিত হয়েছিল `An administrative policy letter of the fourth khaliph Hajrat Ali (R)’ নামে। পুস্তিকাটি পড়েছি বেশ কয়েকবার। ইতিহাসে হজরত আলী রা: এর জ্ঞান, গুণ আল্ল¬াহভীরুতা, ত্বাকওয়া, পরহেজগারী, সাহস, উদারতা, মানবতা, বীরত্ব, বিচক্ষণতা, ত্যাগ এসব নিয়ে ভূরী ভূরী ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে, যা থেকে তাঁকে আরও বিশদভাবে জানা যায়। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা: ই তাঁকে বিশেষভাবে মুল্যায়িত করে গেছেন যেখানে, সেখানে আর কারও মুল্যায়ন বা সার্টিফিকেটের দরকারই পড়ে না।

ছোট্ট সেই পুস্তিকাটি আসলে হজরত আলী রা: এঁর লেখা একটা চিঠি। চিঠিটি তিনি তাঁর পুত্র হযরত হাসান রা: কে কুফার গভর্নর নিয়োগের সময় লিখেছিলেন। কি ভাবে জনপ্রশাসন চালাতে হবে, পাবলিক এডমিনিষ্ট্রেশন এবং একটা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মানে সমাজ ও প্রশাসন কিভাবে পরিচালনা করতে হয়, সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়ে।

সন্তানবৎসল একজন পিতা হিসেবেই কেবল নয়, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হিসেবে, আমীরুল মু’মিনিন হিসেবে চিঠিটা লিখেছেন, ছোট্ট এই চিঠিটা যেন পাবলিক এডমিনিষ্ট্রেশন বিষয়ে জ্ঞানের এক সুগভীর ভান্ডার। যাঁরা সংশি¬ষ্ট বিষয়ে উৎসাহী, তাঁরা ছোট্ট বইটা পড়ে দেখতে পারেন।

হযরত আলী রা: এঁর জ্ঞান আর গুণের ত্বারিফ শুনে শুনে মক্কার জ্ঞানী-গুণী কিছু লোক যারপরনাই ইর্ষান্বিত এবং বিরক্ত। তাদের মত সবজান্তা (!) মুরব্বীদের চোখের সামনে কবে, কি ভাবে আলীর মত কালকের এক বালক (!) জ্ঞানী হয়ে উঠল, তা তাদের মাথায় কিছুতেই ঢুকে না। অথচ সবার মুখেই তারা শোনেন আলীর প্রশংসা।

তারা সকলে মিলে যুক্তি করলেন, আলী রা: এর জ্ঞানের সত্যতা যাচাই করবেন। এ উদ্দেশ্যে দশজনের এক প্রতিনিধী দল গেলেন আলী রা: এঁর কাছে। দশজন লোকের একই প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর হতে হবে দশটা, প্রতিনিধীদলের প্রত্যেকের জন্যই একটা করে! আর প্রশ্নটাও খুবই সাধারণ; সম্পদ আর জ্ঞান, দুটোর মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ? এবং কেন?

হযরত আলী রা: এঁর সমীপে প্রশ্নটাও তারা উত্থাপণ করল। এটাও বলল যে, প্রশ্ন একটা হলেও এর দশটা উত্তর দিতে হবে। তাদের প্রশ্ন এবং অদ্ভূত শর্ত শুনে হজরত আলী রা: কিছুটা বিষ্মিত হলেও তিনি তাদের উত্তর দিলেন, এক এক করে দশটি’ই। নীচে দেখুন তাঁর দেয়া উত্তর গুলো;

(এক) সকল নবী রাসুলগণ জ্ঞানার্জনে জোর দিয়েছেন, সে লক্ষ্যেই সকলকে তাগাদা দিয়েছেন, আর সম্পদের উপরে জোর দিয়েছে ফেরআউন, নমরুদ, এ কারণে সম্পদের তুলনায় জ্ঞান শ্রেষ্ঠ।

(দুই) সম্পদ হারিয়ে যাবার বা লুন্ঠিত হবার ভয় থাকে তাই তাকে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়, কিন্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রে এর বিপরিত, জ্ঞানকে পাহারা দিতে হয় না বরং জ্ঞানই এর ধারক’কে পাহারা দিয়ে রক্ষা করে। তাই সম্পদের তুলনায় জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ।

(তিন) সম্পদ মানুষে মানুষে ইর্ষা, শত্র“তার সৃষ্টি করে, কিন্তু জ্ঞান মানুষকে বন্ধুতে পরিণত করে। তাই সম্পদের চেয়ে জ্ঞানই উত্তম।

(চার) সম্পদ বন্টন ও ব্যয়ে কমে যায়। কিন্তু জ্ঞান এর সম্পূর্ণ বিপরিত, জ্ঞান যতই বিতরণ করা হোক না কেন, তাতে সে কমে না, বরং উত্তরোত্তার বৃদ্ধি পেতেই থাকে। তাই সম্পদের তুলনায় জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ।

(পাঁচ) সম্পদ মানুষকে বখীল হিসেবে গড়ে তোলে বা তাকে বখীল অর্থাৎ কৃপণ বানিয়ে দেয়। কিন্তু জ্ঞান মানুষকে উদার করে তোলে, মনকে করে দেয় বড়। তাই সম্পদের বিপরিতে জ্ঞানই উত্তম।

(ছয়) সম্পদ তার মনীবকে সব সময় তটস্থ করে রাখে, কারণ তা হারবার, বা চুরি হয়ে যাবার বা কারো দ্বারা অবৈধভাবে, কিংবা ফাঁকি দিয়ে আত্বসাৎ করার ভয় থাকে। কিন্তু জ্ঞান তার ধারককে এরকম কোন অস্বস্থিতে কখনই ফেলে না। কারণ জ্ঞান কখনই চুরি হতে পারে না। তাই জ্ঞানই উত্তম সম্পদের চেয়ে।

(সাত) সম্পদের ক্ষয় আছে, ধ্বংস আছে। তা লোপ পেতে পারে, অপচয়, অপব্যয় হতে পারে, হারিয়ে যেতে পারে, লোকসান হতে পারে। সম্পদ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু এর বিপরিতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম কোন আশংকা নেই, এটা চিরস্থায়ী। তাই, জ্ঞানের চেয়ে সম্পদ কখনই উত্তম বা শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।

(আট) সম্পদ সীমিত, একে মাপা যায় সহজেই, এর সীমা পরিসীমা নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রে এর সীমা পরিসীমা মাপা যায় না। এর আকার নির্ধারণ করা যায় না। তাই সম্পদের চেয়ে জ্ঞানই উত্তম।

(নয়) জ্ঞান মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে। কিন্তু সম্পদ এর বিপরিতে মানুষের মনকে করে ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ, কলুষিত। তাই যে কোন বিচারেই হোক না কেন, সম্পদের চেয়ে জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ।

(দশ) জ্ঞানের প্রতিপক্ষে সম্পদ একেবারেই মূল্যহীন। জ্ঞান নবী-রাসুলদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে মানবতাবোধ, তাঁদেরকে গড়ে তুলেছিল মানবতাবাদী হিসেবে। আর অঢেল সম্পদের ধারক হওয়া সত্তেও ফেরাআউন, নমরুদদের কেউ মানবদরদী হতে পারেনি। বরং তারা হয়ে পড়েছিল কৃপণ, ধনপিপাসূ। অতএব জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ সম্পদের চেয়ে।

বলাই বাহুল্য, দশজনের উক্ত প্রতিনিধী দল অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে, আসলেই হজরত আলী রা: একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। আর এ বিশ্বও স্বাক্ষী, ইসলাম এবং তার নবী সা: এরঁ সাহাচর্যই তাঁকে এমন এক দূর্লভ জ্ঞানী মানুষে পরিণত করেছে।

প্রকৃত পক্ষে মুহাম্মদ সা: তাঁর মিশনের একেবারে শুরু থেকে এই কাজটিই করে গেছেন। তিনি মানুষকে সত্য ও হকের দাওয়াত দিয়েছেন, যার মূল কথাই ছিল, চিন্তা-গবেষণা করা, জ্ঞান চর্চা করা। আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে জ্ঞানের উৎস আল কুরআন নাজিল হচ্ছিল, আর তিনি সেই আল কুরআনকে ভিত্তি করেই মানুষকে জ্ঞানের চর্চা করার, সেই জ্ঞান ভিত্তিক চরিত্র তৈরী করার ত্বাগাদা দিয়ে গেছেন সারাটা জীবন।

একটি পরিপূর্ণ জ্ঞানের মৌলিক উৎস তিনি রেখে গেছেন, কি ভাবে তা চর্চা করতে এবং কি ভাবে তার উপরে নির্ভর করে জীবন পরিচালনা করতে হয়, সে উদাহারণও রেখে গেছেন বিশ্বমানবতার জন্য। তিনি বলেও গেছেন, এই দুটি উৎসকে ( আল কুরআন ও তাঁর সুন্নাহ) যতদিন আমরা অনুসরণ করে চলব, মেনে চলব, ততদিন আমরা বিপথে যাব না, ততদিন আমরা কল্যাণের মধ্যেই থাকব।

আমরা তাঁর সেই উপদেশের ধার ধারিনি বলে আজ আমাদের অবস্থান কোথায়, ধ্বংস আর অপমানের কোন স্তরে, তা আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে হবে না। তার পরেও আমাদের বোধোদয় হচ্ছে না কেন?

রাসূলুল্ল¬াহ সা: বলেছেন ‘জ্ঞানীর কলমের কালী শহীদের রক্তের চেয়েও দামী’। আরও বলেছেন ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ার সাফল্য চায় তার জন্য জ্ঞানার্জন প্রয়োজন, যে ব্যক্তি আখেরাতে সাফল্য চায়, তার জন্য জ্ঞানার্জন প্রয়োজন। যে ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জাহানে সাফল্য চায়, তারও জ্ঞানার্জন প্রয়োজন’।

জ্ঞানার্জন প্রতিটি মুসলমানের ্উপরে কবর থেকে দোলনা পর্যন্ত ফরজ করা হয়েছে ইসলামে। নবী রাসূলগণ কোন ধন সম্পদ রেখে যান না, তাঁরা রেখে যান জ্ঞান। একারণে জ্ঞানীদেরই নবী রাসূলগণের উত্তরাধিকারের মর্যাদাও দিয়েছেন তিনি সা:। রাতের একটি ঘন্টা জ্ঞান চর্চা করা সারা রাত নফল এবাদতের থেকেও উত্তম।

জ্ঞানের এতটাই শক্তি, সে কারণেই না মাত্র কয়েকটি দশকের মধ্যে মরুভূমির মধ্য থেকে অখ্যাত, অজ্ঞাত অশিক্ষিত, বর্বর একটা গোষ্ঠি জ্বলে উঠল। পুরো বিশ্ব সভ্যতাকেই বদলে দিল চিরদিনের মত। টমাস কার্লাইলের ভাষায় ‘বারুদের স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেবার মত করে হঠাৎ ই যেন মুহাম্মদ সা: পুরো আরব জাতিকে প্রোজ্জলিত করে তুললেন জ্ঞানের আলোকে। সে আলোকেই বিশ্ব আলোকিত হয়ে উঠল!’

আধুনিক বিশ্বে যেখানে জ্ঞান চর্চা যে কোন সময়ের চেয়ে সহজ, হয়ে উঠলেও আমাদের মুসলমান তরুণ যুবক, এমনকি আমরা বুড়োরাও কেন জ্ঞান চর্চায় এতটা নিস্পৃহ? কেন তারা কেবলই একটা ফ্লাট বাড়ী, কিংবা লেটেস্ট মডেলের গাড়ীর পেছনে সারাটা জীবন ব্যায় করছে? কেন তারা জ্ঞানার্জনে সামান্য চেষ্টাটাও করছে না?

যারা পরিণত বয়সের.সেই তারাইবা কেন এখনও কেবলই ব্যংকের হিসাব মেলাতেই ব্যস্ত? কেন আমাদের মধ্যে জ্ঞানচর্চার অভ্যসাটা গড়ে উঠল না? এমনকি, সমাজে ইসলামি ভাবাদর্শের ধারক, বাহক বলে পরিচিত যুবকদেরও দেখি কেবলই অর্থ-বিত্ত আর ব্যবসার পেছনেই ছুটছেন, কষ্টে কেবলই বুকটা ফেটে যেতে চায়। কষ্টের এ কথাটা কাকে বলি?



বিষয়: বিবিধ

১৯৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File