"শাহবাগের আন্দোলন সরকার পরিচালিত ফ্যাসিবাদী আন্দোলন, এর সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই।" -মাহমুদুর রহমান
লিখেছেন লিখেছেন জাগ্রত ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৯:৩৬:৩৬ রাত
জনাব মাহমুদুর রহমান, আপনি কোন যুক্তিতে রাজধানীর শাহবাগের সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচিকে ফ্যাসিবাদ বলছেন? ফ্যাসিবাদের যে সংজ্ঞা আছে তার আলোকে কি এ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদ বলে আখ্যায়িত করা যায়?
মাহমুদুর রহমান : দেখুন! আন্দোলনের কিছু ধারা আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, আন্দোলন বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা হয় সরকার কিংবা establishment-এর বিরুদ্ধে। আর বর্তমান আন্দোলনটি পরিচালিত হচ্ছে সরকার দ্বারা এবং সরকারের সহায়তায়। সরকার খাওয়া দিচ্ছে, টাকা-পয়সা দিচ্ছে, সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে এবং মিডিয়াতে প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। কাজেই এটা পরিপূর্ণভাবে সরকার দ্বারা পরিচালিত একটি সমাবেশ। এটাকে আন্দোলন বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
আর আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি নিয়ে আপনি প্রশ্ন করেছেন- সেটি হচ্ছে ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত। ফ্যাসিবাদ মানে কী? ফ্যাসিবাদের মানে খুব সহজে যদি আমি বলি- তা হচ্ছে আমি যাকে পছন্দ করি না বা যার মতামত আমি পছন্দ করি না তাকে আমি একটা খারাপ নাম দেব, তার বিরুদ্ধে আমি অপপ্রচার চালাব এবং তাকে ধ্বংস করার জন্য কিংবা হত্যা করার জন্য instigate করব।
আমরা যদি ১৯৩০ সালের জার্মানীতে ফিরে যাই তাহলে দেখব- হিটলার তখন বলত- জার্মানীর সব অসুবিধার জন্য দায়ী ইহুদি এবং কম্যুনিস্টরা। কাজেই ইহুদি এবং কম্যুনিস্টদের ধর এবং হত্যা কর। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তখন হিটলারের নাতসি বাহিনীর নেতৃত্বে reichstag পোড়ানো হয়েছিল এবং তখনও কিন্তু জার্মানীর তরুণ সমাজ এই কাজটি করেছিল।
আজকের শাহবাগে কী হচ্ছে? শাহবাগে বিচারের কথা কিন্তু বলা হচ্ছে না। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘ফাঁসি চাই, জবাই কর’। তো একবিংশ শতাব্দীতে কোন সভ্য রাষ্ট্রে, ‘ফাঁসি চাই, জবাই কর’ -এসব কোনো আন্দোলনের ভাষা হতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া যখন পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ড উঠিয়ে দেয়ার আন্দোলন চলছে তখন শাহবাগ থেকে এই স্লোগান দেয়া হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদের আরেকটি বড় কথা হচ্ছে যে, ভিন্নমতকে আটকে দেয়া বা ভিন্নমতকে থাকতে না দেয়া। শাহবাগ থেকে বলা হচ্ছে, instigate করা হচ্ছে পত্রিকা অফিস আক্রমণ করতে। পত্রিকা পোড়ানোর কথা বলা হচ্ছে এবং শারীরিকভাবে নিগৃহীত করার কথা বলা হচ্ছে। আপনারা জানেন যে, ইতোমধ্যে গত দু’দিনে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ও অফিসে এবং তাদের ছাপাখানায় আগুন দেয়া হয়েছে। খুব বড় একটা দুর্ঘটনা থেকে তারা বেঁচে গেছে। আগুন যদি spread করত তাহলে ১০০/২০০ সাংবাদিক সেই আগুনে পুড়ে নিহত হতেন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বিক্রিতে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং সর্বত্র আমার দেশ পত্রিকায় আগুন দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে আমার দেশ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দেয়া হয়। তার মানে দেশে যে ভিন্নমত আছে সেই ভিন্নমতকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। গতকাল (১৩ ফেব্রুয়ারি) ১৪ দল অর্থাত যারা বর্তমানে সরকারে আছে-তাদের একটি মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাদের কোনো অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য ভিন্নমতের কোনো মিডিয়া প্রবেশ করতে পারবে না। আপনারাও মিডিয়াতে আছেন; সেক্ষেত্রে এগুলো সব যদি আমি মিলিয়ে দেখি- তাহলে এর চেয়ে বড় ফ্যাসিবাদ তো আর কিছু হতে পারে না, অন্তত আমি যতটুকু লেখাপড়া জানি তাতে সেটাই মনে হয়। কাজেই শাহবাগের আন্দোলন কোন সাধারণ-স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নয়, এটা সরকার দ্বারা পরিচালিত, সরকারের সহায়তায় দেশের ভিন্নমত দমনের জন্য এক ধরনের সহিংসতা বা হিংসা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সমাজে। আর এতে করে বাংলাদেশ long term-এ একটা বড় বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি। আর আমি যেটা মনে করি তা প্রকাশ করার অধিকার যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজে যেমন আছে আমারও সে অধিকার আছে।
রেডিও তেহরান : দেশের চলমান এ আন্দোলনে সাংবাদিকতার জগতে সম্ভবত আপনিই একা এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছেন? আপনার অবস্থান তো তাহলে গণবিরোধী হয়ে গেল? তাছাড়া, এ আন্দোলন যদি ভুল পথে এবং ভুল উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় তাহলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ কেন এর সঙ্গে রয়েছে?
মাহমুদুর রহমান : দেখুন, দেশের সর্বস্তরের মানুষ যে এর সঙ্গে আছে এর প্রমাণ কোথায় পাওয়া গেল তা আমি জানি না! এ নিয়ে কোন রকম survey করা হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। তবে আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে, প্রতিটি স্কুলের বাচ্চাদের বলে দেয়া হচ্ছে যে, কোন্ দিন কোন্ স্কুলের বাচ্চাদের এখানে আসতে হবে এবং ক্লাস থ্রি/ফোরের বাচ্চাদের মাথায় ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগানের ব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এসব ব্যান্ড পরিয়ে দিচ্ছেন স্কুলের শিক্ষকরা। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনেছি, সরকার স্কুল কর্তৃপক্ষকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে। এভাবে যদি সরকার একটা concord আন্দোলন চালায় তাহলে তাকে গণমুখী আন্দোলন বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
আর আমার অবস্থান নিয়ে আপনি যে প্রশ্ন করলেন- সে ব্যাপারে আমি বলব- ভিন্নমতকে তো অনেক রকম নাম দেয়া যায়। তবে আমার বিবেচনায় আমি সঠিক অবস্থানে আছি; আপনার বিবেচনায় সেটা নাও হতে পারে। তার মানে তো এই নয় যে, আপনি ভিন্নমতকে ধ্বংস করে দিতে চাইবেন, ভিন্নমতকে আপনি পুড়িয়ে মেরে ফেলে দিতে চাইবেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে জনগণের আবেগ বা উন্মাদনাকে পুঁজি করে ফ্যাসিবাদ বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশে তারই এক ধরনের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি।
রেডিও তেহরান : আপনি শাহবাগের এ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদ বলছেন। কিসের ভিত্তিতে বা কিসের দাবিতে আন্দোলন হলে আপনি তাকে সঠিক বলে আখ্যায়িত করতেন?
মাহমুদুর রহমান : শাহবাগের এ আন্দোলনকে আমি সঠিক বলে আখ্যায়িত করতাম যদি এখানে সঠিক বিচারের দাবি করা হত। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে ট্রাইবুনালে বিচার করা হয়েছে সেই ট্রাইব্যুনালটি সরকার গঠন করেছে। যে বিচারপতিরা ট্রাইব্যুনালে বিচার করছেন তাদেরকে সরকার বিচারক বানিয়েছে। আর বাংলাদেশে বর্তমানে আদালতের যে অবস্থা সে সম্পর্কে আমি বলব- এ দেশের ইতিহাসে এর আগে এখনকার মতো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আদালত কখনও হয়নি। কাজেই এখানে যে রায়গুলো হচ্ছে তাতে সরকারের যে হাত নেই সে কথা না বলারও কোন সুযোগ নেই। তাহলে কি সরকারই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে? কাজেই এটাকে আমি তখনই জনগণের প্রকৃত আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করতাম- যদি ‘ফাঁসি চাই ও জবাই কর’ মার্কা ফ্যাসিস্ট স্লোগান এখান থেকে উচ্চারিত না হত। দ্বিতীয়ত যদি আন্দোলনটা সরকারের বিরুদ্ধে হত তাহলে বলতে পারতাম এটি জনগণের আন্দোলন- কারণ কাজটি তো সরকার করছে। পক্ষান্তরে এখানে দেখতে পাচ্ছি সরকার উল্টো সহায়তা দিচ্ছে। আর সরকারের সঙ্গে ১৪ দল মিলে এ আন্দোলনটি পরিচালনা করছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এটাকে নিরপেক্ষ বলা বা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া বলার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই আন্দোলনের যে নিরপেক্ষ চরিত্র সেটা প্রথম থেকেই ধ্বংস হয়েছে।
আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে-সেটি হচ্ছে- এখানে যারা উদ্যোক্তা তারা যেভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেছেন...আপনি জানেন যে, গত পরশু দিন ঢাকা শহরে বিক্ষোভের সময় যেভাবে বয়োবৃদ্ধ মুসল্লিদের দাড়ি ধরে টানাটানি করা হয়েছে- এ রকম দৃশ্য একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে দেখতে হবে বলে আমি কখনও মনে করিনি।
link
বিষয়: বিবিধ
১৮৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন