রমজান আলোচনাঃ সূরা নিসা ৭৪ থেকে ৭৬ নং আয়াত
লিখেছেন লিখেছেন দিগন্তে হাওয়া ২০ জুলাই, ২০১৪, ০৩:৩৬:১৫ দুপুর
আলহামদুলিল্লাহ, মহান রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া যে, আমরা রহমত, বরকতের দশক শেষে মাগফিরাতের দশকে অবস্থান করছি। আর এই দশকের বিজোড় রাতগুলো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ন। আর গুরুত্বপুর্ন হবার কারণ আমাদের কাছে অজানা নয় !!
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের মুসলিমদের উপরে চলছে গনহত্যা। আল্লাহ তাদের হেফাজত করুন, আমিন।
আমাদের প্রিয় এই ব্লগে একজন শ্রদ্ধেয় ব্লগার যে সুন্দর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই উদ্যোগের মাঝে আমাকে সূরা নিসার ৭৪ থেকে ৭৬ নং আয়াতের আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আর তাই কথা না বাড়িয়ে আলোচনার দিকে যেতে চাই। আশা করছি আপনারা সাথেই থাকবেন।
আয়াতের অনুবাদের সাথে সাথে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও শিক্ষনীয় দিকগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
প্রথমেই ৭৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالآخِرَةِ وَمَن يُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَيُقْتَلْ أَو يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا
"সুতরাং যারা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন বিক্রয় করে, তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করুক এবং যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে তারা শহীদ হোক কিংবা বিজয়ী হোক আল্লাহ তাদেরকে মহাপুরস্কার দান করবেন ৷"
পুর্বের আয়াতের সুত্র ধরে মুনাফিক লোকদের লক্ষণ হলো, তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে জিহাদে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে, এমনকি অন্যদেরকেও বিরত রাখে৷ এই আয়াতে ওই বক্তব্যের জের ধরে বলা হচ্ছে-জিহাদ থেকে পালিয়ে যাওয়া আল্লাহ ও পরকালের প্রতি অবিশ্বাসের লক্ষণ। যদি কেউ পরকালের মহাপুরস্কারের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং দুনিয়ার অস্থায়ী জীবনকে পরকালের স্থায়ী জীবনের জন্য ক্ষেত্র মনে করে, তাহলে তার উচিত আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা৷ কারণ মুমিন বা বিশ্বাসী মুসলমানরা জানেন ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব এবং তারা এই দায়িত্ব পালনের জন্যই সচেষ্ট। যুদ্ধের ফলে জয় বা পরাজয় যাই হোক না কেন তা তাদের জন্য সমান৷ জয় বা পরাজয় উভয় ক্ষেত্রেই তারা বিজয়ী৷ কারণ আল্লাহর পথে থাকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ, শত্রুর ওপর বিজয়ী হওয়া এর তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
*প্রথমত : ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ধর্ম রক্ষা করা, দেশের সীমানা বৃদ্ধি, প্রতিশোধ নেয়া কিংবা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা জিহাদের উদ্দেশ্য নয়৷
*দ্বিতীয়ত : ঈমানদারদের পরীক্ষার একটি ক্ষেত্র হলো যুদ্ধের ময়দান৷ যুদ্ধই মুমিন ও মোনাফিকের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে৷
*তৃতীয়ত : সত্যের সংগ্রামে পলায়ন ও পরাজয়ের কোন অস্তিত্ব নেই৷ মানুষ হয় শহীদ হবে অথবা গাজী বা বিজয়ী হবে৷
এরপর ৭৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে ,
وَمَا لَكُمْ لاَ تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاء وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَـذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيًّا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيرًا
"তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের রক্ষার জন্যে? যারা বলে হে আমাদের প্রতিপালক !! জালেমের এই জনপদ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার কর। তোমার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী পাঠাও।"
আগের আয়াতে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসের কারণে জিহাদে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ আর এই আয়াতে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বলা হচ্ছে-যারা অত্যাচারীদের হাতে নিপীড়িত তাদেরকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করা উচিত এবং নীরব থাকা উচিত নয়। এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, জালেমদের হাত থেকে নিপীড়িত লোকদের রক্ষা করা ও তাদের মুক্তি দেয়া ইসলামী সংগ্রাম তথা জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য৷ মজলুমদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের শামিল৷ স্বধর্মী ও স্বজাতির প্রতি মুমিনের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। স্বদেশ ও স্বধর্মের লোক যখন কষ্ট পাচ্ছে তখন শুধু নিজের এবং পরিবারের সুখের চিন্তা করা মুমিনের লক্ষণ নয়৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
*প্রথমত : ইসলামী জিহাদ শুধু ধর্মের স্বার্থেই হয় না, মানবীয় স্বার্থ রক্ষাও এর লক্ষ্য। মানুষকে মুক্তি দেয়ার সংগ্রাম ধর্মেরই সংগ্রাম৷
*দ্বিতীয়ত : মজলুম ও নিপীড়িত জনগণের ফরিয়াদ এবং কান্নার ব্যাপারে উদাসীন থাকা একটি বড় পাপ। সাহস ও শক্তি নিয়ে মজলুমের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত।
এরপর ৭৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
الَّذِينَ آمَنُواْ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُواْ أَوْلِيَاء الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا
"যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা অবিশ্বাসী তারা তাগুত বা অসত্যের পক্ষে যুদ্ধ করে৷ সুতরাং তোমরা শয়তানের অনুসারী ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।"
ইসলামী জিহাদ ও অবিশ্বাসীদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করার জন্য মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলছেন, "ঈমানদারগণ শুধু আল্লাহর ধর্ম রক্ষা এবং তা শক্তিশালী করার জন্য যুদ্ধ করে, ক্ষমতা বা পদের জন্য নয়৷ মুমিনের জন্য শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি যথেষ্ট৷ কিন্তু কাফেররা খোদাদ্রোহী শক্তি ও জালেমদের শাসন শক্তিশালী করার জন্য যুদ্ধ করে। তাদের লক্ষ্য অন্যদের ওপর কর্তৃত্ব করা এবং নিজ দেশের সীমানা বৃদ্ধি করা।"
এরপর আল্লাহ আধিপত্যকামী এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উৎসাহ যুগিয়ে বলছেন, "তোমরা মনে করো না যে, কাফেররা শক্তিশালী ও তোমরা দুর্বল৷ বরং বাস্তবতা এর বিপরীত। তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমানের কারণে সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারী৷ অন্যদিকে তোমাদের শত্রুরা শয়তানের অনুসারী বলে অত্যন্ত দুর্বল৷ তাই কাফের ও তাগুতি শক্তির সাথে সংগ্রাম করতে ভয় পেয়ো না এবং সর্বশক্তি দিয়ে কুফরি শক্তির সাথে যুদ্ধ কর৷ তোমরাই শ্রেষ্ঠ এবং শয়তানের অনুসারীরা আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবেলায় অত্যন্ত দুর্বল ও অক্ষম।"
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
*প্রথমত : ফি সাবিলিল্লাহ অর্থ-আল্লাহর পথে থাকা। জীবনের সব ক্ষেত্রে এটাই মুমিন ও ইসলামী সমাজের লক্ষ্য৷
*দ্বিতীয়ত : ঘরে বসে থাকা এবং উদাসীনতা মুমিনের লক্ষণ নয়৷ বরং খোদাদ্রোহী ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামই মুমিনের লক্ষ্য৷
*তৃতীয়ত : কাফের, তাগুত বা ইসলাম বিরোধী স্বৈরশক্তি ও শয়তান এরা একই ত্রিভুজের তিন দিক এবং এগুলো একটি অপরটির উপর নির্ভরশীল। অর এ জন্যই এগুলো একে অপরকে শক্তিশালী করার জন্য সচেষ্ট।
উপরক্ত তিনটি আয়াতে মুল যে বিষয়টি সম্পর্কে নির্দেশ করা হয়েছে সে বিষয়টি হচ্ছে ‘জিহাদ’ এবার চলুন সে বিষয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করি।
‘জিহাদ’ আরবী শব্দ। এটি আরবী ‘জুহদুন’ শব্দ থেকে নির্গত। বাংলায় জিহাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- কঠোর চেষ্টা-সাধনা করা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত মধ্যমতো সাধনা করা, চূড়ান্ত শ্রম নিয়োগ করা, কোনো বিষয়ে নিজেকে প্রাণপণে নিবেদিত করা।
পারিভাষিক অর্থ:
১. আল্লামা জুরযানী (র)-এর মতে, ‘ইসলামের দিকে আহবান করাই জিহাদ’
২. আল্লাহর এই জমিনে সকল প্রকার সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করে, সকল বাতিল মতাদর্শের উপর আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টার নাম জিহাদ।
পরিশেষে সবার কাছে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জন্য দোয়া কামনা করছি। আর ব্যস্ততার কারনে লেখাটার বেশিরভাগ অংশই অনলাইনের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে আপনাদের সামনে উপস্থাপনা করেছি।
বিষয়: বিবিধ
২৯৭০ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এরপরও মুসলমানরা বিশেষ করে আরব নেতৃবৃন্দ চুপ করে বসে আছে। আল্লাহর বাণীকে তারা কিতাবের মধ্যেই রেখেছে।
আমাদের একদল লোককে আপনার দেয়া রেফারেন্স আয়াতগুলো ও প্রাসঙ্গিকতা বললে তারা বলেন, "ঈমানই মজবুত হলো নাই, আর বলছেন..."। আরেকদল লোক আছেন ক্যাডার তৈরিতে ব্যস্ত, বহু যুগ ধরে ব্যস্ত। উভয়ের ক্ষেত্রেই জনগন মাইনাস। তারা একনিষ্ঠ ভাবে সাধনা করে চলেছেন, কিন্তু জনগণের কোন খবর নাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন