অল্প বয়সে অধিক জ্ঞান আহরণ কি বিপদ ডেকে আনে !!
লিখেছেন লিখেছেন দিগন্তে হাওয়া ০৬ মে, ২০১৪, ০৯:২৭:৩০ রাত
প্রয়োজনের তাগিদেই ৮ম শ্রেনীতে মাদ্রাসা পরিবর্তন করে গেলাম রাজশাহীর প্রথম সারির একটি মাদ্রাসায়। নতুন ক্লাস, নতুন মেধাবী মুখ, বলার অপেক্ষা রাখেনা শিক্ষকগনও নতুন। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম বিদ্যালয় পরিবর্তন তাই অন্য রকম এক অনুভূতি!!
পড়াশুনা করতে গিয়ে অবশ্যই বন্ধু থাকা প্রয়োজন আর সে বন্ধু যেন মেধাবী, কর্মঠ হয় সে বিষয়ে আমি সব সময় গুরুত্ব দিতাম। তার সুত্র ধরে প্রথম কয়েকদিনে অনেক মেধাবী মুখের সাথে পরিচিত হলাম। তাদের মাঝে কওমী মাদ্রাসা থেকে আসা এক মেধাবী শিক্ষার্থীও ছিল। যার নাম ছিল করিম (নিক নেম)। মনে হতো সর্বদা তার চেহারা থেকে জ্ঞান আহরনের নেশার ছাপ ঝলকানি দিচ্ছে!!
ধীরে ধীরে ক্লাসে পারফমেন্স দেখে কিছুটা আচ করতে পারলাম কারা মেধাবী। তাই তাদের সাথেই পরাশুনা কেন্দ্রিক দিনের বেশীর ভাগ সময় পার করে দিতাম। করিম নামের সেই ছেলেটি ক্লাসের ফাঁকা সময়টা পড়াশুনার মাঝেই কাটিয়ে দিত। ক্লাসের বিরতি বা শিক্ষকের অনুপস্থিতির সময়টা অন্যদের মত হয়-হল্লোর বা গল্পের মাঝে না কাটিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত ইংরেজী শব্দ ভাণ্ডার কখনো বা আরবী শব্দ ভাণ্ডারের বই নিয়ে।
তার সাথে কয়েকটা বিষয়ে একই স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম। প্রাইভেটেও ছিল তার ভাল পারফমেন্স। বিকেলে যখন সবাই মাঠে খেলায় মত্ত থাকতো তখন করিম নামের সেই ছেলেটিকে প্রায় দিনই দেখা যেত মেসে বই হাতে পড়ার টেবিলে জ্ঞানের ভুবনে বসে থাকতে।
এভাবেই বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট নিয়ে করিম সহ আমি ও অন্যরা ৯ম শ্রেনীতে উত্তীর্ন হলাম। শুরু হল দাখিল পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ+ পাওয়ার লক্ষ্যে যাত্রা।
আলহামদুলিল্লাহ, করিম আমি সহ ক্লাসের ভাল পারফমেন্স দেখানো প্রায় শিক্ষার্থীরা গোল্ডেন এ+ পেল। বাকিরা এ+ ও অন্যান্য গ্রেডে পাশ করলো।
এরপর কাছের কিছু বন্ধু আলিমে না পড়ে কলেজে এইচ এস সি পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। তাদের মাঝে করিম নামের ছেলেটিও ছিল। করিমের চান্স হলো রাজশাহির প্রথম সারির একটি কলেজে।
স্বভাবতই কলেজে যাওয়ার ফলে তার সাথে ধীরে ধীরে যোগাযোগের পরিমানও কমে যেতে লাগলো। কলেজের এক শিক্ষকের কাছে আমি ও করিম প্রাইভেট পড়তাম তবে আলাদা ব্যাচ হওয়ায় নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা হতো। কথা হতো পড়াশুনার কি অবস্থা সে বিষয়ে। এতটুকুই ...
এভাবেই আমার আলিম পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসলো তার এইচ এস সি পরীক্ষার। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সুস্থতার সহিত আলিম পরীক্ষা শেষ করলাম।
অতঃপর পরীক্ষা শেষের দিন বা দুই একদিন পরে কলেজে যাওয়া বন্ধুদের ফোন দিলাম তাদের পরীক্ষা কেমন হল সে বিষয়ে জানার জন্য। প্রথমেই ফোন দিলাম করিম নামক সেই ছেলেটিকে।
সালাম- কালামের পরে জানতে চাইলাম তার পরীক্ষা কেমন হলো সে বিষয়ে? সে প্রথমে না জানাতে চাইলেও বাধ্য হয়েই জানালো সম্ভবত প্রথম দুইটি/ তিনটি পরীক্ষা ছাড়া মাথায় সমস্যার কারনে বাকি পরীক্ষাগুলো দিতে পারি নাই।
তা শুনে আমি হতভম্ব !! ভাবতেই পারিনি তার মুখে এ কথা শুনবো !!
১০ম শ্রেনীতে এবং আলিমে আমাদের মাদ্রাসার জীব বিজ্ঞান ম্যাডাম সহ আমাদের ধারনা মতে, মেডিকেলে যদি কেউ চান্স পায় তবে করিম নামের সেই ছেলেটিই চান্স পাবে। তাই করিমকে নিয়ে আমরা সবাই একটু অন্যভাবে ভাবতাম। কিন্তু একি শুনলাম !!
আমি বললাম যাই হোক তোমার মেসের ঠিকানা দাও, আমি দেখা করবো। সে ঠিকানা দিল আমি তার সাথে দেখা করতে গেলাম। প্রথম দিন দেখা করে সান্তনা দিলাম আর বললাম চিন্তা করোনা সামনে বছর আল্লাহ চাইলে পাশ করে মেডিকেলে পড়তে পারবা তাই এখন থেকেই সে রকমভাবে প্রস্তুতি নাও।
এরপর শুরু হল আমার মেডিকেল কোচিং। আমার কোচিং ক্লাস ভবনের পাশেই তার মেস হওয়ায় মাঝে মাঝেই সময় পেলে তার সাথে দেখা করতে যেতাম। ধীরে ধীরে কিছুটা আবিস্কার করলাম তার মাথায় সমস্যা সৃষ্টি বা পরীক্ষা না দিতে পারার কারন সম্পর্কে!!
সে আমাকে মাঝে মাঝেই ইসলাম ধর্ম সহ অন্য ধর্ম নিয়ে আজগবি সব প্রশ্ন করতো। আমি বেশীরভাগ সময়ই তা এড়িয়ে যেতাম।
-একদিন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম এসব জ্ঞান তুমি কোথা থেকে আহরন করেছ?
-সে বললো বই থেকে।
-আমি বললাম এসব বই তো নিজের টাকায় কিনে পড়া সম্ভব নয়।
-সে জানালো লাইব্রেরীতে এ ধরণের অসংখ্য বই আছে।
-আমি হেসেই বললাম তাহলে তোমার বেশীরভাগ সময় কাটে লাইব্রেরীতে এসব বই পড়ে, একাডেমিক বই বাদ দিয়ে !!
সে কোন জবাব না দিয়েই অন্য বিষয়ে কথা শুরু করলো।
তারপরে মাঝে মাঝে সময় পেলেই তার সাথে দেখা করতে যেতাম। আমি ৮ম, ৯ম এবং ১০ শ্রেনিতে তার সাথে থেকে কখনো বুঝতে পারিনি তার মাথায় কোন সমস্যা আছে। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে মেসে একাকী জীবন-যাপন ও বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে অধিক জ্ঞান আহরনই তার মাথায় সমস্যার কারণ।
দেশের বাইরে আসার ফলে তার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি তবে শুনেছি, প্রথমবারের মত দ্বিতীয়বারও কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে আর দিতে পারিনি।
আশার বানী হচ্ছে, যথাসম্ভব বর্তমানে সে তার পরিবারের সাথে বাস করে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
সার সংক্ষেপ অধিক জ্ঞান আহরন মাঝে মাঝে বিপদ ডেকে আনতে পারে। যে সকল মা-বাবার সন্তানেরা শহরে মেসে থেকে পড়াশুনা করছে। তারা দয়া করে মাঝে মাঝেই খোঁজ নিন দিনের বেশিরভাগ সময় সে কিভাবে পার করছে?
কাদের সাথেই বা পার করছে?
এর সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত না করলেই নয় যে বিষয়টি আমার ধারনা মতে, আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের উপরে মারাত্মক বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে সে বিষয়টি হলো আমাদের আশে পাশেই কিছু অভিভাবকদের দেখা যায়, যারা তাদের ছোট্ট শিশুদের দিনের বেশীরভাগ সময়ই পড়াশুনার মধ্যে রাখেন। তাদের ধারনা আমার শিশু ছোট থেকেই অনেক কিছু জানবে, শিখবে ইত্যাদি।
কিন্তু এর ফলে সেই অভিভাবকগণ যে নিজের অজান্তেই তাদের চোখের মনি সেই ছোট্ট শিশুর মেধা বিকাশের নামে তার ভবিষৎ জীবনে কঠিন বিপদ ডেকে আনছেন তা কল্পনাও করতে পারছেন না ...
তাই সময় থাকতে সচেতন হওয়া একান্ত জরুরী ...
বিষয়: বিবিধ
২৩২৬ বার পঠিত, ৫৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের সাথে শেয়ার করা যায় কি..
একজন শিশুকে যেমন ভদ্র মানুষ কেমন তা দেখতে হবে, একজন অভদ্র মানুষ কেমন তাও জানতে হবে। চোর, চেঁছর, ঠগ, প্রতারক সবাইকে চিনিয়ে দেওয়াও পিতামাতার কর্তব্য। নতুবা উন্নত শিক্ষাও তার কোন উপকারে আসবে না।
ছোট বয়সে বেশী জ্ঞান যেভাবে শিশুকে সমস্যাগ্রস্থ করে,
ছোট বয়সে বেশী শারীরিক শক্তিও সমস্যা তৈরী করে।
তাই আল্লাহ যেভাবে মানুষ তৈরির পদ্ধতি দিয়েছেন, সেভাবেই চলা উচিত, তাহলে তা সার্থক হবে। নতুবা নয়।
ওর বেলায় যা বুঝলাম, সঠিক জ্ঞানের চেয়ে বেঠিক জ্ঞান বেশী অর্জন করেছে।
সবকিছুর এক সীমা আছে। আপনি পারবেন ২০ কেজি আপনারে দিলাম ৫০ কেজি তাহলে কেম্নে হবে ভাই।
তবে লেখাটা ভালো লেগেছে।
জ্ঞান আর বুদ্ধি যদি একসাথে না থাকে সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি।
দু:খ হয় তার জন্য।
ভাল একটা প্রসঙ্গে সুন্দর লিখেছেন। ধন্যবাদ।
এখন আমি আমার সন্তানদের বলি হয়েছে এবার ঘুমোও কিন্তু রাত ১২টার আগে ঘুময় না।
সহমত
মন্তব্য করতে লগইন করুন