সুন্দর পাপ
লিখেছেন লিখেছেন চেনা অচেনা ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৩:৪৭:৪৮ রাত
আমরা আমাদের চারপাশে, এমনকি নিজেদের পরিবারের মধ্যে শিক্ষায় ও রুচিতে অনন্য (!) মানুষদের মধ্যে খারাপ কাজের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখে কখনও হতাশ হই, রাগ হই, কখনও বা দুঃখ পাই। নিজেকে প্রশ্ন করি, কোনটা ভালো আর কোনটা ক্ষতিকর, মানসিকভাবে সুস্থ যে কোন মানুষেরই বুঝতে পারার কথা। কিন্তু তারপরও কেন মানুষ ভুল পথে পা বাড়ায়? পাপের সাগরে গা ভাসিয়ে দেয়?
দেখি কুরআন এই বিষয়ে কি বলে। কুরআনের বিভিন্ন সুরাতে পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বসবাস করতো এমন সব জাতি যারা আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করার কারনে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এমন দুইটি জাতি হল, আ’দ এবং সামুদ জাতি। সুরা আনকাবুতের ৩৮ নং আয়াতে এই জাতির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তারা ছিল ‘মুস্তাবসিরুন’। ‘মুস্তাবসিরুন’ এর অর্থ, উৎকর্ষতায় অনন্য ও উচ্চ মেধাসম্পন্ন জাতি (people of excellent skills and high Intelligence)। এতো মেধা থাকা সত্ত্বেও তারা শিরক ও কুফরে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু কেন? একই আয়াতে কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে, “শয়তান তাদের কর্মকে তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করেছিল”। সহজ ভাবে বলতে হয়, তারা তাদের পাপ কাজগুলিকে ভালো মনে করে উপভোগ করতো। যখন খারাপ কাজকে মানুষ খারাপ মনে না করে, সেখানে অপরাধবোধ ও প্রায়শচিত্ত করার তো প্রশ্নই আসে না। শয়তান অত্যন্ত চতুরতার সাথে অনৈতিক কাজকে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করে এবং অন্যায়ের প্রতি প্রলুব্ধ করে। খারাপ কাজকে আকর্ষণীয় করে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা শয়তানের একটি চতুর কৌশল। সরাসরি খারাপ কাজ কাউকে দিয়ে করাবে, শয়তানের এমন কোন ক্ষমতা নাই। তাই সে সুকৌশলে অনৈতিক ও অশ্লীল কাজগুলোকে কখনও দৃষ্টিনন্দন, কখন বা শৈল্পিক ভাষার মোড়কে সাজিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। আর এই ফাঁদে পা দেয়া মানুষেরা জ্ঞান ও মেধায় সর্বউৎকৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের অজান্তেই অন্ধকারের পথে পা বাড়ায়।
সুরা নাহল ও সুরা নামলে আরবি শব্দ জায়ান (Zayyan) ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ দাড়ায়, সজ্জিত (beautify) বা অলঙ্কৃত (to decorate)। এই শব্দ ব্যবহার করে দুটি ভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। “আমি আপনার পূর্বে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে রাসূল প্রেরণ করেছি, অতঃপর শয়তান তাদেরকে কর্মসমূহ শোভনীয় করে দেখিয়েছে”। [সুরা নাহল ১৬:৬৩] “আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সেজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে”। [সুরা নামল ২৮:২৪] এই পথে পা বাড়ানো মানুষেরা ক্ষমতার লোভে উন্মাদ হয়ে যায় এবং তাদের অহংকার ও উদ্ধত স্বভাব তাদেরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। পাপের মাধুর্যে বিভ্রান্ত লোকদের হৃদয় এতটাই কঠোর হয়ে যায় যে, তারা তাদের পরিজনদের ভালো পরামর্শের কোন আমলই দেয় না। সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য আল্লাহ্ মাঝে মাঝে তাদেরকে তখন বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে, এতে তাদের হেদায়েত তো হই না বরং তারা আরও বেশী গোমরাহে পথে ঘুরপাক খেতে থাকে। ফিরাউন ও তার সহযোগীদেরকে ধ্বংস করার আগে আল্লাহ্ তাদের উপর বিভিন্ন রকম দুর্যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা প্রতিবারই দুর্যোগের সময় মুসা (আঃ) কাছে বলেছে যে দুর্যোগটা কেটে গেলেই তারা ঈমান আনবে, অথচ দুর্যোগ কেটে যাবার পর তাদের ওয়াদা ভংগ করেছে এবং পুনরায় পাপে নিমজ্জিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সুরা আনআমের ৪৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের কাছে যখন আমার আযাব আসল, তখন কেন কাকুতি-মিনতি করল না ? বস্তুতঃ তাদের অন্তর কঠোর হয়ে গেল এবং শয়তান তাদের কাছে সুশোভিত করে দেখাল, যে কাজ তারা করছিল”। মুসা (আঃ) এর পুনঃ পুনঃ চেষ্টা ও সতর্কবাণী তাদের কঠিন হৃদয় গলাতে পারে নাই। শয়তানের আরেকটি চতুর কৌশল হল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া। যখন মক্কার মুশরিকরা বদরের ময়দানে মুসলিমদের মুখোমুখি হয়েছিল তখন শয়তান এই কৌশলটি অবলম্বন করেছিল। সুরা আনফালের ৪৮ নং আয়াতে এই ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে, “যখন সুদৃশ্য করে দিল শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপকে এবং বলল যে, আজকের দিনে কোন মানুষই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না আর আমি হলাম তোমাদের সমর্থক, অতঃপর যখন সামনাসামনী হল উভয় বাহিনী তখন সে অতি দ্রুত পায়ে পেছনে দিকে পালিয়ে গেল ….. ” শয়তানের অপর একটি ধূর্ত প্রবঞ্চনা। ফলশ্রুতিতে বদরের যুদ্ধে মক্কার ৭০ জন মুশরিক সর্দার প্রান হারায়। লুত (আঃ) এর গোত্র চুরি, ব্যভিচার, দুর্নীতি, সমকামিতা আর অশ্লীলতায় নিমজ্জিত ছিল। লুত (আঃ) প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজের পরিবারের কয়েকজন ছাড়া (এমনকি তাঁর স্ত্রীও এই পংকিলতায় ডুবে ছিল) আর কাউকেই আল্লাহ্র গজব থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন নি। আদ ও সামুদ জাতি নিজেদের মেধায় অহংকার ও দাম্ভিকতায় অন্ধ হয়ে, লুত (আঃ) এর গোত্র নিলজ্জতা ও অশ্লীলতায় ডুবে, ফেরাউন ও মক্কার মুশরিকরা অর্থ ও ক্ষমতার লোভে উন্মাদ হয়ে নিজেদের বিবেক হারিয়ে আল্লাহ্র চূড়ান্ত গজবের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
আজকে আমরা যে সমাজে বসবাস করি সেখানে এমন কোন পাপ, অশ্লীলতা, অনৈতিকতা বাকি নাই যা কুরআনে উল্লেখিত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের ভেতর অনুপস্থিত ছিল। কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের কাছে এই সকল ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেন আমরা শিক্ষা গ্রহন করি, সতর্ক হই, সাবধানতা অবলম্বন করি। যদি আমরা কুরআন যা সমগ্র মানব জাতির জন্য উপদেশ স্বরূপ নাজিল হয়েছে, অর্থসহ(আরবি যাদের মাতৃভাষা না) পড়তাম তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর সহজেই খুঁজে পেতাম। একই সাথে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত যে সব দুর্যোগ (যুদ্ধ, খরা, বন্যা, মহামারি, সুনামি, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, খাবারে বিষ, নতুন নতুন অসুখ, জালিম শাসক) আমাদের উপর কিছুদিন পর পর আপতিত হয় সেগুলোর কারন অনুসন্ধান করে নিজেদের সংশোধনের চেষ্টা করতাম। সুরা আল-আনফালের ২৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, "তোমরা এমন ফাসাদ থেকে বেঁচে থাক যা বিশেষতঃ শুধু তাদের উপর পতিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে জালেম এবং জেনে রেখ যে, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর"। সময় থাকতে আমাদের সাবধান হওয়া প্রয়োজন কারন, "প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহুর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে।" [সূরা আল আ’রাফ ৭ :৩৪]
বিষয়: বিবিধ
১১৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন