আমি তোমাদেরই মেয়ে- মাহমুদা ডলি
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী যাযাবর ১৩ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:০৩:০২ সন্ধ্যা
পুলিশে ধরলে কি আর সতীত্ব থাকে? মহিলারা জেলে গেলে কি আর তাদের ইজ্জত আব্রু ঠিক থাকে? ‘এমন অসতী স্ত্রীলোকের আমার দরকার নেই। তোরে তালাক দিলাম’Ñ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে এমনভাবেই ঘর ভাঙল শিল্পীর (৩৪)।
‘সেলাই আপা’ শিল্পী। দর্জিপাড়ার মেয়ে সে। দিন-রাত যায় সেলাই করতে করতেই। আবার ফিরেও আসে কিন্তু তাতে রঙ থাকে সাদাকালো। খোসপাঁচড়ায় আক্রান্ত ছেলের ওষুধ কিনতে বের হন অবরোধের দিন। পাড়ার গলিতে পেয়েও যান। ওষুধ নিয়ে বাসায় ফেরার সময় অতর্কিত লাঠিচার্জ তার ওপর। ওষুধের বোতল পড়ে ভেঙে যায়। এটুকুই মনে আছে তার। তারপর যখন জ্ঞান ফিরে এলো, তখন নিজেকে আবিষ্কার করেন থানায় চেয়ারের সাথে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। এরপর ১২ দিন কেটে যায় তার কারাগারে। যখন ফিরে এলো সে তার চেনা জগতে, ততক্ষণে সমাজের রাজনীতির নোংরা জলে ভেসে গেছে তার সংসার। বলছিলাম, বগুড়া জেলার সদর উপজেলার পালশা খন্দকার পাড়ার শিল্পীর কথা। এভাবেই সরকারের স্বৈরাচারী, কুৎসিত ও কালো হাতের থাবায় ভয়াবহভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দেশের নারীরা।
শহর, জেলা, উপজেলা থেকে গ্রামÑ কোথাও বাদ নেই। প্রতিটি জায়গায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তথা পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল দ্বারা নারী নির্যাতিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে, লাঠিচার্জ চলছে নারীর ওপর। এমনকি, দিন আনে দিন খাওয়া পরিবারের স্কুলছাত্রী, ঘরের বধূ, মধ্যবয়সী কিংবা প্রবীণ নারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না নির্যাতন নিপীড়নের কবল থেকে।
বগুড়া জেলায় এ পর্যন্ত শতাধিক নারীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। তিন প্রবীণ ও মাঝবয়সী নারী পুলিশের গুলিতে খুন হয়েছেন। আর লাঠিচার্জ, পালিয়ে বেড়ানো এবং পুলিশের রিমান্ড ও গ্রেফতার বাণিজ্য এড়াতে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু বেশ কয়েক হাজার নারী। নিশ্চিন্তপুরের নারীদের দিন কাটে ভয়ে, রাত কাটে নিজেদের বাঁচাতে লাঠি নিয়ে পাহারা দিতে। কথা বলেছিলাম বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর, নিশ্চিন্তপুর, দুপচাঁচিয়া, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকার অর্ধশত নারীর সাথে। সিরাজগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে ঘরের বউ-ঝিদের। আইনের দুর্গতি আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কবলে পড়ে আজ শিল্পীদের মতো হাজারো নারীকে সতীত্বের প্রশ্নে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিতে হচ্ছে। মেয়ে হিসেবে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন, কেন বিরোধী দল-মত ঠেকানোর বড় হাতিয়ার হিসেবে নারীর ওপর নির্যাতন চালাতে হবে? এভাবে অত্যাচার চালিয়ে কি মুখ বন্ধ করা যায়? সিরাজগঞ্জের জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ টুকু গত ২৭ অক্টোবর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের নারীদের ওপর পুলিশ যেভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে, যেভাবে রাতের অন্ধকারে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে লুটপাট করছে এবং ঘরের বউ-ঝিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে তা নজিরবিহীন।’
বলপূর্বক দলীয় শাসন কায়েমের জন্যই স্বৈরাচারী পথ বেছে নিয়েছে সরকার। দেশবাসী এ ধরনের অপশাসন মেনে নিতে রাজি নয় বলেই আজ গ্রামে-গঞ্জে, পথে-ঘাটে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাংবিধানিক অধিকারের মতো ভারী ভারী শব্দ আজ দেশের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর কাছে খড়গ হয়ে নেমে আসছে। গণতন্ত্রের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙ্গিয়ে নাগরিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত করে তোলা হচ্ছে।
নিশ্চিন্তপুরের বাসিন্দা আকরামের স্ত্রী শেফালী বানু (৪৭) বললেন, ‘৫ জানুয়ারি সরকার যে নির্বাচন দিয়েছে ওই নির্বাচনে কেউ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ওই ক্ষোভে পুলিশ রোজ কেউরে না কেউরে ধরি ল’যায়। ট্যাকা পয়সা চায়। এ নিয়া শাহজাহানপুর থানা পুলিশের সাথে একদফা মারামারি হইছে। এতে আরো বাগে পাইছে পুলিশ। অহন আর কেউ ঘরে থাকতে পারি না। দিনে কোনোভাবে কাটলেও রাইতের অন্ধকারে মেয়ে-ছেলে, বেটা-পুরুষ সব বাড়িঘর ছেড়ে পালায়। রাইতের বেলা ডিবি পুলিশ সারা এলাকা দাবড়ে বেড়ায়। ধরলি পরেই ৫০ হাজার ট্যাকা দেওন লাগে। আর অহন কেউরে ধরতে বিএনপি-জামায়াতের কোনো কর্মসূচি লাগে না। ধরব, ট্যাকা চাইব। না দিতে পারলি বিরোধী দলের মামলায় দেখাইয়া চালান করব। এত নির্যাতন মা, কেউ বাইর অইনা কাম কাইজ করতি পারে না। কোনোভাবে না খেয়ে না পরি চলি। আর কদদিন? তাই নিজেদের প্রতিবাদ নিজেরাই করি।’ লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন নারীরা। সাধারণ মানুষের কথা হচ্ছে, অতীতে কেউ এমন নারকীয় ঘটনা ঘটায়নি, যা এখন পুলিশ চালাচ্ছে। নারীরা লাঠিসোটা নিয়ে পাহারা দেয় দিনের বেলা। পুলিশ দিনের বেলা ঢুকতে পারে না। আজ দেশের সাধারণ নারীদের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রগতিশীলদের মোমবাতি কোথায়? প্রদীপের অন্ধকারের তলে জমে রয়েছে কথিত বুদ্ধিজীবীদের জন্য কতকগুলো প্রশ্ন। সেই কণ্ঠগুলো আজ কোথায়, যে কণ্ঠগুলো ছয় বছর আগেও মানবাধিকার, নারীর অধিকার নিয়ে রাস্তায় মঞ্চ বেঁধেছিল? সেগুলো স্তব্ধ কেন?
সরেজমিন ঘুরে পুলিশের গুলিতে নিহত তিন নারীর স্বজনদের সাথে কথা হয়েছিল। ৩ মার্চ ঘটে যাওয়া পুলিশের তাণ্ডবের কথা বলতে বলতে কাঁদছিলেন বেইলি (৫৮)। বললেন, ‘কোথায় যাই, জানি না। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। তাই হামো সাথে গেলাম। সবাই চলছে হামরাও চলি। কেউ বলতে পারে না কোথায় যায়। হঠাৎ বিকট শব্দ। দেখলাম সামনে পুলিশ খালি গুলি চালাইতেছে। ছুটাছুটি করে সবাই যে যেখানে পারে গেল। একটু পর সব যখন ঠাণ্ডা হইল, বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় গেলাম, দেখলাম রাস্তায় রক্তের দরিয়া।’ এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ডুমুনপুকুর এলাকার আকলিমা বেগম (৬০), মনজিলা বেগম (৫৬), তোতা মিয়ার বউ আরজিনা বেগম (৩৫)। নারীর জীবন নিয়ে লড়াই, অন্ধকার অতীত, অত্যাচারিত হওয়ার কাহিনী অনেক। রাজনৈতিক নিপীড়নের সাথে মিশে গেছে তাদের ব্যক্তিগত জীবন।
শাহজাহানপুরের স্থানীয় সাংবাদিক জিয়াউর রহমান এবং সজীব বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যত মামলা রয়েছে, তারচেয়ে বেশি নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বাদ যাচ্ছে না নারীরাও। তারাও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন।’
ফিরে এলাম শিল্পীর কাছে। শহরের শ্যামলী রেস্তোরাঁয় বসে কথা হয় তার সাথে। তিন ছেলের মা শিল্পী। দর্জির কাজ করে সংসার চালায়। ২০১১ সালে পুলিশ তাকে জেলে পাঠানোর কারণে স্বামী মাসুম মোল্লার সাথে তার ডিভোর্স হয়ে যায় গত ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে। দুই ছেলে প্রাইমারি স্কুলে পড়ে।রাগে দুঃখে অপমানে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেই সে সব ছেড়ে রাস্তায় নামে। ২০১৩ সালে পুলিশ স্থানীয় সাংবাদিকদের সামনে রাজপথ থেকে তাকে তুলে দিতে বুক, পেটের ওপর বুটের আঘাত করে, সাপের মতো পেটায়। এরপর তার জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে দেয়। তার বিরুদ্ধে মামলা হয় (৯৪৫/২০১৩)। আবার জেলে যেতে হয়। এবার আর তার ভয় নেই জেল খাটতে। তার আর হারানোর কিছু নেই। কিন্তু পুলিশের লাঠির আঘাতে শিল্পীর পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। এখন সে আর সেলাই মেশিনের ওপর বেশিক্ষণ বসতে পারে না। কিছুক্ষণ পর তার মাথা অস্থির হয়ে যায়, বুকের ব্যথায় সেলাই মেশিনের ওপরেই মাথা রেখে কেটে যায় হয়তো এক ঘণ্টা। শিল্পী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে চাই, আপনার পুলিশ বাহিনী দিয়ে এভাবে নারীর মানসম্মান নিয়ে খেলা করবেন না। আমি তো আপনাদেরই মেয়ে, তা হলে কেন ইজ্জত নিয়ে এই খেলা?
কোনো কোনো বাহিনী এখন বিরোধী দলসহ সাধারণ নারীদের ওপরও নিগ্রহ, নিপীড়ন চালাচ্ছে। এভাবে প্রাণ নেয়া যায়, ইজ্জত নেয়া যায়, অর্থ লুট করা যায়, মারধরে পঙ্গু করে দেয়া যায়। কিন্তু আসলে আন্দোলন দমানো যায় না। আর তাই শুধু বগুড়া কিংবা সিরাজগঞ্জ নয়, যেখানে অন্যায় অত্যাচার, সেখানেই নারীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ক্ষমতায় মত্ত অপরিণামদর্শী রাজনীতির ফল বিপরীত হচ্ছে। অপশাসনের জগদ্দল পাথর সরাতে শিল্পীদের মতো নির্যাতিত নিপীড়িত নারীরাই পারেন। আজ হয়তো শিল্পীকে বলতে হতো না ‘আমি তোমাদের মেয়ে’ যদি ওই সময়েই এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কেউ রাজপথে ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করতেন। ডিজিটাল সরকারের আমলে এখন অনুভূতিও পাল্টে গেছে। কে নির্যাতিত হলো তার প্রোফাইল দেখে প্রতিবাদ করছেন কথিত নারীনেত্রী এবং তথাকথিত সুশীলসমাজ। প্রতিবাদীরা সব সময়ই শ্রদ্ধার। তবে প্রতিবাদ চাই তাদের কাছ থেকে সবার জন্য। দল-মত নির্বিশেষে সব নারীর জন্য। দেশের নাগরিক হিসেবে তারাও প্রতিবাদের সমান দাবিদার।
লেখক : সাংবাদিক
লিংক:http://www.dailynayadiganta.com/details.php?nayadiganta=ODUwMjY%3D&sec=7
বিষয়: বিবিধ
১১৭৫ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন