বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধি বনাম আন্না হাজারে-আল্লামা শফী

লিখেছেন লিখেছেন জুনায়েদ ১৫ মে, ২০১৩, ১২:৪৬:৩২ দুপুর



প্রবাদে আছে ‘মাছের পচন ধরে মাথায়’ আর ‘জাতির পচন ধরে বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে’। দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে পচন ধরার খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর হালুয়া-রুটি খেয়ে দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিড়াট একটা অংশ সরকারের ঘরে ‘বিবেকবন্ধক’ রেখেছেন। সরকারের শত অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম, জুলুম-নির্যাতনেও তাদের বিবেককে তাড়িত করে না। সরকার তোষণে এতোই ব্যস্ত থাকেন যে নীতি নৈতিকতার বিষয়গুলো তাদের মগজে কাজ করে না। ক্ষমতাসীনদের সব কাজই তাদের দৃষ্টিতে সুন্দর, সুচারু এবং আ্ইনী মনে হয়। পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা সে দেশের বৃদ্ধিজীবীদের কাবু করতে পারেনা; সে জন্য আন্না হাজারে হন সম্মানিত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এদেশের বুদ্ধিজীবীদের বিবেক কিনে নিয়ে সিন্দুকে তালা মেরে রাখায় সরকার যা ইচ্ছে তাই করেও সমালোচনার মুখে পড়ে না।

ওরা দুইজন। একজন ভারতের ৭৫ বছর বয়স্ক সমাজকর্মী আন্না হাজারে। অপরজন বাংলাদেশের ৯৪ বছর বয়সের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। প্রবীণ এবং অরাজনৈতিক এই দুই ব্যক্তিত্ব নিজ নিজ কর্মে সাফল্য দেখালেও দেশের মানুষের কাছে তেমন পরিচিত ছিলেন না। আন্না হাজারেকে যেমন ভারতের এক তৃতীয়াংশ মানুষ চিনতো না; বাংলাদেশের আল্লামা শফীর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দেশের মানুষের সামনে ঝড়ের বেগে হাজির হওয়া ‘দুই ব্যক্তিই’ জাতীয় সংসদে আইন পাসের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কর্মসূচি দিয়ে প্রশাসনের ভিত নাড়িয়ে দেন। প্রায় একই প্রক্রিয়ায় দুই দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি তুলে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন তারা। কিন্তু দুই দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, মিডিয়ার আচরণে তাদের ভিন্ন ভাগ্যবরণ করতে হয়। মরহুম লেখক দার্শনিক আহমদ সফা লিখেছিলেন-‘কোনো দেশের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে রাষ্ট্রের অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে না দাঁড়ায় তার মতো দুর্ভাগা জাতি আর নেই’। বাম ঘরানার লেখক হিসেবে পরিচিত আহমদ সফার সেই উপলব্ধির বাস্তব প্রতিফলন এখন ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের’ ক্ষেত্রে ঘটছে সেটা হারে হারে টের পাচ্ছে মানুষ। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর সমাজে পরিচিতি আছে তোতাপাখি বুদ্ধিজীবী, ক্যাঙারু বুদ্ধিজীবী, বিবেক বিক্রেতা বুদ্ধিজীবী, বধির বুদ্ধিজীবী, প্রেস রিলিজ বুুদ্ধিজীবী, হালুয়া-রুটি বুদ্ধিজীবী, গুণকির্তন বুদ্ধিজীবী, তোষামোদ বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি নামে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বদৌলতে সম্প্রতি হঠাৎ করে গড়িয়ে উঠেছে টকশো বুদ্ধিজীবী। এ সব বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই দেশ, সমাজ, দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। তবে অধিকাংশই বুদ্ধিজীবী শুধু হালুয়া-রুটি নিয়ে বেশি ব্যস্ত। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবী, প্লট-ফ্লাটসহ নানামুখী সুবিধা ভোগের কারণে তাদের সরকার তোষণে ব্যস্ত। তাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে গাছ কাটলে, পাখি মারলে, পুলিশের গুলি থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইট ভাংলে তাদের মন কেঁদে ওঠে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী মানুষকে মারা গেলেও তাদের প্রাণ কাঁদে না। তাদের বিবেককেও স্পর্শ করেনা। রাতের আঁধারে হাজার হাজার আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী লাখ লাখ ঘুমন্ত মানুষকে ‘সরিয়ে দেয়ার’ অজুহাতে হাজার হাজার গুলি খরচ করলে তারা ‘বাহবা বাহবা’ দেন সরকারকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর চেয়েও ভয়াবহভাবে ওলামা-মাশায়েখ, আলেমদের কান ধরে উঠবস করালে এবং আলেমদের দড়ি দিয়ে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তাদের বিবেককে তাড়িত করে না। কারণ, তাদের বিবেক সরকারের ঘরে বন্ধক রয়েছে।

ভারতের বিশিষ্ট সমাজকর্মী আনা হাজারে দুর্নীতি রোধে লোকপাল বিলের মতো আইন চালু করার দাবিতে ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল নয়াদিল্লির যন্ত্রণমন্তরে আমরণ অনশন শুরু করেন। তার কর্মসূচিতে যোগদেন হাজার হাজার দুর্নীতি বিরোধী ভারতীয়। তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন ভারতের দলমত নির্বিশেষে সব মহলের বুদ্ধিজীবী। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী অরিন্দ কেজরিওয়াল, স্বামী অগ্নিবেশ, ম্যাগসাইসাই পুরস্কারজয়ী কিরণ বেদী ও সন্দীপ পান্ডে। ৫ হাজার মানুষ প্রথম আন্না হাজারের সঙ্গে যোগদান করলেও পরে প্রচুর লোক তার প্রতি সমর্থন দেন। অতঃপর বিজেপি নেত্রী মানেকা গান্ধী ও প্রকাশ জাভাদেকার তার দাবির প্রতি সমর্থন জানান। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী পর্যন্ত আন্না হাজারেকে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ করেন। দুর্নীতি বিরোধী আইন করার দাবির কর্মসূচির সমর্থনে ভারতের চার শতাধিক নগর ও শহরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। ৯ এপ্রিল সরকার দাবি মেনে নেয়ায় ৯৬ ঘন্টা পর তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। অতঃপর আবার একই দাবিতে তিনি কর্মসূচি পালন করেন। সমাজকর্মী প্রবীণ আন্না হাজারেকে মানুষের দাবি নিয়ে আন্দোলন করে সরকারের হাতে অসম্মান হতে হয়নি। কারণ ভারতের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীরা সরকারের কাছে ‘বিবেকবন্ধক’ না রাখায় তারা হাজারের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবি নিয়ে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে মাঠে নামে। সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন’, নবী (সা.) নিয়ে কটূক্তিকারী ব্লগারদের বিচারসহ ১৩ দফা দাবিতে ৬ এপ্রিল লংমার্চ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে অনেক উচ্চতায় উঠে আসে। সরকারের বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা অবরোধ করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। একই দাবিতে ৫ মে ঢাকা অবরোধে অংশ নেয়। ঢাকা অবরোধ পরে মতিঝিলে সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যায় তা পাকিস্তান বাহিনীর ’৭১ এর ২৫ মার্চের নির্মমতাকে হার মানায়। ২০১০ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় অরাজনৈতিক এ সংগঠনটি জন্ম নেয়। মূলত ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শাপলায় ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ করে ‘নতুন শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সংগঠনটি সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সরকারও তাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা নমনীয়তা দেখায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ৩ মে সংবাদ সম্মেলন করে ১৩ দফা দাবি সম্পর্কে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। বিবেকহীন বুদ্ধিজীবীদের অপপ্রচার, হঠাৎ গজিয়ে উঠা টকশো বুদ্ধিজীবীদের গলাবাজী এবং কিছু মুখচেনা ব্যক্তির ইসলাম বিদ্বেষী মানসিকতা হেফাজতের প্রতি সরকারকে উস্কে দেয়। প্রধানমন্ত্রী হেফাজতের দাবির প্রতি সহনশীল হলেও কিছু মন্ত্রী ও কেনা বুদ্ধিজীবী ১৩ দফা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে অপপ্রচার চালান। বাঁশের চেয়ে যেন কঞ্চি বড়। অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বয়োবৃদ্ধ আলেম আল্লামা শফী প্রচলিত ‘রাজনৈতিক কূটচাল’ বুঝতে না পারায় সুনামি নেমে আসে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়া আলেমদের ওপর। নিতান্তই দ্বীনের স্বার্থে এ আন্দোলন এটা ইসলামের শত্রুরাও স্বীকার করবেন।কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের ‘বিবেকহীন’ আচরণ মানুষকে আহত করেছে। সরকারের হালুয়া-রুটি বুদ্ধিজীবীদের কত ‘বিবেকহীন করে রাখতে পারে’ তা গভীর রাতে শাপলা চত্বরে বিজিবি-র‌্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানের পর তাদের কথাবার্তায় পরিষ্কার বোঝা যায়। হালুয়া রুটি খাওয়া বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সরকারকে খুশি করতে ‘মধ্যরাতে শাপলা চত্বরে অভিযান প্রয়োজন ছিল’ বলে টেলিভিশনের পর্দা ফাটাচ্ছেন। কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় লিখছেন। অথচ এরা একবারও স্বীকার করেন না নিরস্ত্র মানুষকে অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে করতে আক্রমন করা কোনো মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে না। মানবাধিকর রক্ষার যারা এজেন্সি নিয়েছেন সেই মানবাধিকারের ব্যাপারীরা নীরবতা পালন করছেন। হেফাজত দাবি করছে শাপলা চত্বরে ৩ হাজার নিহত হয়েছেন। বিএনপিও দাবি করেছে হাজারের অধিক নিহত হয়েছেন। অন্যান্যরাও একই দাবি করছেন। গ্রাম গঞ্জের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখন শাপলা ট্রাজেডির কথা শোনা যায়। অথচ সরকার বিষয়টি পরিস্কার না করে সবকিছু গোপন করার কৌশল নিয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করলেও খুঁদকুঁড়া খাওয়া বুদ্ধিজীবীরা নীরব। বুদ্ধিজীবী হলো বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ; অথচ সরকারের কাছে বুদ্ধি বন্ধক রেখে যে জীবিকা নির্বাহ করা যায় সেটা এদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী জাতিকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবীরা সরকারের ঘরে বিবেক বন্ধক রাখায় আল্লামা শফীর মতো প্রবীণ আলেমকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। অবশ্য তার এ বিব্রতকর অবস্থা সাময়িক বলেই মনে হচ্ছে। ভারতের বুদ্ধিজীবীদের বিবেক সরকার কিনতে না পারায় আন্না হাজারে অনায়াসে সফল হয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টো ঘটনা।

বিষয়: বিবিধ

১৩১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File