মধ্যরাতের অভিযান রাজনৈতিক আন্দোলন ও বাস্তবতা

লিখেছেন লিখেছেন জুনায়েদ ১৩ মে, ২০১৩, ০১:৫৩:৩৪ দুপুর



কেন মধ্যরাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র হেফাজত কর্মীদের ওপর যৌথবাহিনী সশস্ত্র হামলা করেছে তার গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা বিবিসিকে সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা বলেছেন। অভিযোগে তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। উপদেষ্টার মতে, সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে সরকার পতনের একটি চেষ্টা ছিল এটি। বেগম খালেদা জিয়ার ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটামের সাথে হেফাজত কর্মীদের আন্দোলনকে যুক্ত করে দেখিয়ে হেফাজত কর্মীদের খাবার দাবার সরবরাহ ও তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বেগম জিয়ার আহ্বানকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৪ মে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশ থেকে বেগম জিয়া নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবির বিষয়টি উল্লেখ করে এ দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ঐ সমাবেশে তিনি বলেছেন, হেফাজতে ইসলামীর পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি থাকায় ২৪ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হলো। এদিকে মধ্যরাতের অভিযান সম্পর্কে রেডিও তেহরানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ও হেফাজত নেতা মওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেছেন, মধ্যরাতে যৌথবাহিনীর হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছে। নিহতদের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে পারেনি। এ নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের উপস্থিতির উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, নির্বিচারে যে গুলি হয়েছে সেটা সবাই দেখেছে। আমি নিজেও ছিলাম। লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোন কোন জায়গায় মানুষ দেখেছে ট্রাকে করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে? তা মানুষ জানে না। সরকারের শীর্ষমহল থেকে সংলাপের প্রস্তাব দেয়া এবং বিরোধী মহল থেকে আলোচনার জন্য নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণার আহ্বান জানানোর প্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলামের ঘটনা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুনমাত্রা যুক্ত করেছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলই এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রকৃত হতাহতের তালিকা প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের নেতারা আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছেন, হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এখন পর্যন্ত তাদের অরাজনৈতিক চরিত্রই রয়েছে। এটাও পরিষ্কার যে, কোন দল করার মতো কাঠামো নিয়ে তারা এগুচ্ছে না। তাদের আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য ইসলাম ধর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়। ঐতিহাসিক বিবেচনায় এ আন্দোলনকে সংস্কার আন্দোলন ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। অতীতের সূত্রে বলা যায়, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। মদীনার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একশ’ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষে মুসলমানরা বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলমানদের বিজয়ী হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, তৎকালীন হিন্দু শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের সংক্ষুব্ধতা। শাসক ও শাসিতের মধ্যে সহানুভূতি ও সৌহার্দ্যরে অভাব। রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে সিন্ধুর বৌদ্ধ ও জৈনদের অনেক অভিযোগ ছিল বিধায় তাদের অনেকেই মুহাম্মদ বিন কাসিমের দলে যোগদান করেছিল। বিজয়ী অঞ্চলে মুসলমানদের অনুসৃত উদারনীতির ফলে অনেকেই বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছিল। জাঠ, মেড প্রভৃতি স্থানীয় সম্প্রদায় নানাভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হওয়ায় মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতের বাংলায় যখন মুসলমানরা বিনা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন তখনও বাংলার ব্রাহ্মণ শাসকদের নির্যাতনে নির্যাতিত বৌদ্ধ ও সাধারণ মানুষ মুসলমানদের সমর্থন করেছিল। এই আলোচনার দুটি সমান্তরাল অংশ রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে মুসলিম শক্তি বিজয় লাভ করলেও প্রকৃতধারায় অর্থাৎ সামাজিক সংস্কৃতিতে ইসলাম বিরোধী ধারা থেকেই গিয়েছিল। সুতরাং নব্যমুসলিমদের প্রকৃত ধারায় ফিরিয়ে আনা জরুরি ছিল। ভারতবর্ষে ঐতিহাসিকভাবে যে দু’জন সংস্কারকের নাম গুরুত্বের সাথে উল্লেখিত রয়েছে তার একজন মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রা.) এবং অন্যজন সৈয়দ আহমদ শহীদ। এ দু’জনের সংস্কার নীতির মৌলিক দর্শন ছিল এক ও অভিন্ন। মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রা.) সংস্কার শুরু করেছিলেন, মোগল বাদশা আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে। বাদশার দরবারে প্রবেশের সময় মাথানত না করার মধ্যদিয়ে তিনি একাত্মবাদের যে পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন সে কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। সে সময় তার সমর্থনে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তিনি তার সমর্থকদের এই বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন, দিল্লী থেকে মোগলরা চলে যাক এমন কোন কাজ করা সঠিক হবে না। বিদ্রোহীদের তিনি নিবৃত্ত করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মোগল শাসনামলেই জন্ম নিয়েছিলেন জিন্দাপীর সম্রাট আওরাঙ্গজেব আলমগীর। সৈয়দ আহমদ শহীদ যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তখন দিল্লীতে মোগল শাসন থাকলেও কার্যত ইংরেজদের অধীনেই ভারতবর্ষ শাসিত হচ্ছিল। সৈয়দ আহমদও ভারতবর্ষে মোগল শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন। যেহেতু শিখরা ইংরেজদের সহায়তাকারী এবং পক্ষাবলম্বনকারী ছিল তাই তিনি শিখদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। নানা প্রতিকূলতা, সমসাময়িক বাস্তবতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তিনি প্রথমে জয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। সৈয়দ আহমদের লড়াইয়ের ধরনের সাথে হেফাজতে ইসলামীদের চলমান আন্দোলনে বৈশিষ্ট্যগত মিল রয়েছে। ১. শাহাবাগী মঞ্চের কোন কোন ব্লাগারের ইসলামবিরোধী বক্তব্য যা প্রকাশ্যত সরকারের কোন কোন মহল কর্তৃক সমর্থিত; হেফাজত মূলত নাস্তিক ব্লাগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ২. হেফাজত নিজেদেরকে ক্ষমতায় আনার জন্য নয়, বরং প্রকৃত আল্লাহর বিশ্বাসীদের ক্ষমতায় আনার জন্য লড়াই করছে। ৩. সৈয়দ আহমদ ও মোজাদ্দেদে আলফেসানী ইসলামের যে বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য সংস্কার আন্দোলনের শুরু করেছিলেন হেফাজতে ইসলামও সেই বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্যই ময়দানে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। আপাত পরিণতির দিক থেকেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সৈয়দ আহমদ শাহদাত বরণ করেছিলেন ৬ মে। হিজরী ও খ্রিস্টীয় দুই ক্যালেন্ডার মোতাবেকই হেফাজত ইসলামীদের ওপর আক্রমণও পরিচালিত হয়েছে ৬ মে।

হেফাজতে ইসলামের ৫ মে’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে যারা বিএনপিকে মিলিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আবিষ্কার করতে চাচ্ছেন তাদের যুক্তি বোঝা দায়। ৪ মে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট ঐ শাপলা চত্বরে যে সমাবেশ করেছে তার উপস্থিতি কোন বিবেচনাতেই কম ছিল না। সমাবেশ মহাসমাবেশে পরিণত হয়েছিল। হেফাজতের ঢাকা অবরোধে এক কোটি লোকের অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও বিএনপির সমাবেশে ৫০ লাখের কম লোক হয়নি। হেফাজতের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির কারণে সুনির্দিষ্টভাবেই বেগম জিয়া তার বক্তব্যে সময়ের ছাড় দিয়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে হেফাজতের আলেমদের সাথে বসে কেন তার আন্দোলন বাস্তবায়ন করতে হবে এটা বোঝা কষ্টকর। ৫ মে’র বা ৬ এপ্রিলের সমাবেশেও বিএনপির কোন নেতা বক্তৃতা দেননি। বেগম জিয়ার কোন বাণী পাঠ করা হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, ৫ মে’র জনসভায় বিএনপির পক্ষ থেকে কোন নেতা সেখানে উপস্থিতও ছিলেন না। বেগম জিয়া ৪ মে’র জনসভায় যে কোন জায়গায় অবস্থান গ্রহণের যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের নিজস্ব শক্তিই যথেষ্ট। বিএনপি কেন এটা করছেনা এটাই তাদের বিরুদ্ধে অনেক মহলের অভিযোগ। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট হেফাজতকে সাথে নিয়ে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন এটা যারা মনে করেন, তাদের এই আলোচনায় ভিন্ন গন্ধ রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পিলখানার হত্যাযজ্ঞ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে সবকিছুর মধ্যেই সরকারের কোন কোন মহল এক ধরনের গন্ধ খুঁজে বেড়িয়েছে। এই খোঁজার বিষয়টি কেন সেটি অবশ্যই বিশ্লেষণের ব্যাপার। হেফাজতের আন্দোলনের সাথে বিএনপির চলমান আন্দোলনের সম্পৃক্ততার মূল বিষয় হতে পারে, সংবিধানে আল্লাহর উপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের ব্যাপারে দু’পক্ষের মধ্যেই একধরনের ঐকমত্য রয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন সংবিধানে আল্লাহর উপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন তখনও দেশের তৌহিদবাদী দেশপ্রেমিক আলেম-ওলামা তার সাথে ছিলেন এবং এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বিএনপির রাজনৈতিক দাবির প্রতি হেফাজত কোন সমর্থন ব্যক্ত করেনি। সুতরাং রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত না থাকলে সরকার উৎখাতের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খোঁজার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। বিএনপির সাথে হেফাজতে ইসলাম বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কোন সম্পর্ক থাক বা না থাক সে সূত্র ধরে দেশের নাগরিকদের ওপর বাতি নিভিয়ে মধ্যরাতে আক্রমণ পরিচালনাকে যুক্তিসংগত মনে করা কোন স্বাভাবিক মানুষের কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না। সরকারের বেধে দেয়া সন্ধ্যা ৭টার পরে হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দেয়া যেত, নয়তো সকালেও দেয়া যেত। যারা মধ্যরাতের আক্রমণকে জাস্টিফাইড বলে মনে করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার চেষ্টা করছেন তারা ঠিক কি বুঝে এটা করছেন এটা বোঝা কষ্টকর। পৃথিবীর কোন সভ্যদেশে তার নিজ দেশের নাগরিকদের এভাবে হত্যা করা হতে পারে তার অন্য কোন প্রমাণ পাওয়া দুষ্কর। মধ্যরাতের হত্যাকা- বলতে ২৫ মার্চে পাকিস্তানীদের হত্যাকা-কে বুঝায়। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে গোটা জাতি ধিক্কার জনায়, এ অভিযানের তার চেয়েও ন্যাক্কারজনক ৫ মে’র মধ্যরাতের অভিযান। কারণ পাকিস্তানীরা পাকিস্তান রক্ষা করতে চেয়েছিল। সরকার কাকে রক্ষা করতে চেয়েছে? স্পেন থেকে মুসলমানদের বিদায়ের পরে খ্রিস্টান শাসকরা সেখানকার মুসলমানদের নিধন করতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মসজিদে ডেকে এনে ১ এপ্রিল হত্যা করেছিল। আলোচ্য হত্যাকা-কে কেবলমাত্র তার সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, ইসলাম বিদ্বেষী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহল তথা বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় যারা বিশ্বাসী নয় তাদের খুশি করতে এই হামলা পরিচালিত হয়ে থাকতে পারে। জনদাবির প্রেক্ষিতে অভিযানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরকারি মহল থেকে বলা হয়েছে, অভিযানে কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। অভিযান পরিচালিত হয়েছে দ্রুত ও ক্ষিপ্রতারসাথে। ব্যাখ্যাদানকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, হাজার হাজার ব্যক্তি নিহত হলে তাদের স্বজনরা কোথায়? তারা আরো বলেছেন, নিখোঁজদের তালিকা দেওয়া হলে তারা তাদের খুঁজে দিবেন। প্রাসাঙ্গিক এই আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যারা এই বক্তব্য প্রদান করেছেন তাদের উচিত এর উপর দৃঢ় থাকা। কারণ ইতিমধ্যেই সমাবেশ অবরোধে অংশগ্রহণকারীদের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে বিবরণ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। হেফাজত নেতৃবৃন্দও হয়তো এ ধরনের একটি অনভিপ্রেত অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতার চিন্তা করেননি বিধায় চটজলদি তালিকা প্রকাশ করতে পারছেন না। তালিকাটি এখানে বড় কথা নয়, ইসলামের জন্য যারা নিজেদের সমর্পণ করেছেন তাদের কাছে মৃত্যু পায়ের ভৃত্য। জীবনকে যারা ভোগবাদিতায় দেখেন তাদের কাছে জীবন যত মায়াময় মোহময়, যারা প্রকৃত জবাবদিহিতার দৃষ্টিতে দেখেন তাদের কাছে শহীদী মৃত্যু অনেক বেশী প্রত্যাশিত। কারণ তারা জান্নাতের প্রত্যাশি। সে প্রসঙ্গ বড় নয়, বড় হচ্ছে সরকার পরিচালিত বর্বরতার দৃষ্টিভঙ্গি।

হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী নিরস্ত্র আলেম ও তৌহিদী জনতার ওপর হামলার পর এখন তাদের বিরুদ্ধেই একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে অংশ নেয়া মাদ্রাসার শিক্ষকদের তালিকা করা হচ্ছে। সারাদেশের উপজেলা ও জেলা প্রশাসন এ কাজ করছে। কথিত অভিযোগে যেসব মামলা করা হচ্ছে তাতে লক্ষাধিক আসামি করার প্রক্রিয়া চলছে। আসামি ধরার নামে সরকার হেফাজতকে ছেঁকে ধরতে চায়। হেফাজত নেতাদের ধরার অর্থ হবে, কওমী মাদ্রাসাগুলো আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই টঙ্গীর কওমী মাদ্রাসা দারুল উলুমে তালা লাগিয়ে দিয়েছে পুলিশ। এভাবেই হয়তো একের পর এক মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হবে নানা কৌশলে। একটি গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে এসব করা হচ্ছে বা হতে পারে বলে মনে করা অযৌক্তিক নয়। ব্রিটিশ দখলদাররা সর্বপ্রথম এদেশে ইসলাম নিষিদ্ধ করতে যে কৌশল অবলম্বন করেছিল তার অংশ ছিল মাদ্রাসা বন্ধ করা। ব্রিটিশদের তাবেদার হিন্দু জমিদাররা দাড়ির উপর করারোপ করেছিল। এ ক্ষেত্রে বিট্রিশ ও হিন্দুদের ইসলাম বিদ্বেষী কাজে ঐক্য ছিল। সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমানদের কাছ থেকে যেহেতু ইংরেজরা ক্ষমতা নিয়েছিল তাই মুসলমানদের জাতীয় চেতনা বিমুখ করতেই মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধের চক্রান্ত ছিল। বর্তমান প্রক্রিয়ার সাথেও এর চেতনাগত যোগসূত্র রয়েছে। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়ে নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করার ফলে যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তারই প্রতিফলন হচ্ছে, শাপলায় আক্রমণ। মনে করার সঙ্গত কারণ রয়েছে, দেশের মাদ্রাসা বা ইসলামী শিক্ষার বুনিয়াদী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বন্ধ করে দেওয়া যায় এবং সেখানে যদি ছাত্র ভর্তিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা যায় তাহলে অবশ্যই সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ধর্মের স্বপক্ষে জনগণের অংশীদারিত্ব কমে আসতে থাকবে এবং ক্রমশ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। এতে নিরপেক্ষতাবাদী তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং সীমান্ত বিলোপের পক্ষের শক্তিই লাভবান হবে।

পলাশী বিপর্যয়ের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই দেশের আধ্যাত্মিক নেতারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দ্বীন রক্ষার জন্য যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন কার্যত সৈয়দ আহমেদের শাহদাতের মধ্যদিয়ে হয়তো সে প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছিল। তবে জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই চেতনা নতুন আলোড়ন তুলেছিল বিধায় সৈয়দ আহমদের শাহাদতের কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল। সে লড়াইয়েও হিন্দু এবং ব্রিটিশদের ঐক্য প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের পক্ষে বিজয় অর্জন সম্ভব হয়নি। মোগলদের দিল্লীর সিংহাসনে বসানো সম্ভব হয়নি। তবে ভারতবর্ষে মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। আজকের বাংলাদেশও সেই আন্দোলনের সুবাদেই পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়েছিল। এ অঞ্চলে মুসলমান শাসকদের আগমণের আগে-পরে যেসব আওলিয়া-সূফী-দরবেশ ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন তারা শাসন ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন না। পৃথিবীতে যখন মুসলমানদের শাসন ছিল তখনও বহু আধ্যাত্মিক নেতা শাসন ক্ষমতার অংশভুক্ত না হয়ে সমাজ পরিশুদ্ধকরণ তথা মানুষের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। সেই বিবেচনায় সমাজ বিশুদ্ধকরণ বা সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চাকে উৎসাহিত এবং উদ্ধুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া নতুন কিছু নয়। হেফাজতের উপর যে নির্বিচার গুলি করা হয়েছে এবং তার বিপরীতে শাহবাগীদের যেভাবে লালন করা হয়েছে এবং হচ্ছে তার ফলে বর্তমান সরকারের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির বহির্প্রকাশ ঘটেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের কোটি কোটি মানুষ আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য ও অনুসরণের যে নিদর্শন দেখিয়েছেন তার বিপরীতে সরকারি আক্রমণ সরকারের জন্য একটি কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকল।

সংবিধানে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রধান বিরোধী দল তথা ১৮ দলীয় জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে। অন্যদিকে সমাজ রাষ্ট্রে ইসলামী বৈশিষ্ট্য পুনঃস্থাপনের দাবিতে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা আন্দোলন করতে গিয়ে সরকারি ব্যাপক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সেই বিবেচনায় প্রধান বিরোধী দল ও তার কর্মী এবং হেফাজতের কর্মীসহ দেশপ্রেমিক বিভিন্নসংগঠনের নেতা ও কর্মীরা সরকারি নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছেন। হামলা-মামলা-গ্রেফতারের ফলে গোটাদেশে যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে প্রকৃত বিবেচনায় তাতে দেশের দু’তৃতীংশেরও বেশি মানুষ সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। একটি জাতির পথ চলার জন্য এই প্রবণতা ইতিবাচক হতে পারে না। সরকার যে পথ অবলম্বন করছে তাতে অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পাবে বা পেতে পারে। জনজীবন এমনিতে বিপর্যস্ত। অর্থনীতিতে অশনিসংকেত চলছে। আন্তর্জাতিক মহলও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ ধারণা পোষণ করছে না। তাই জাতীয়-উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধি সমৃদ্ধির বিবেচনায় সামগ্রিক কল্যাণ চিন্তাই কাম্য।

(আব্দুল আউয়াল)

বিষয়: বিবিধ

১৫৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File