মদীনা রাষ্ট্র না মানার কারণে নয় বনু কুরাইযাকে পাকড়াও করা হয়েছিল বিশ্বাসঘাতকতার কারণে, সংসদসদস্যদের কাছে দায়িত্বশীল বক্তব্য কাম্য।

লিখেছেন লিখেছেন জুনায়েদ ১৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০৯:২৬:০৩ রাত



ভূমিকা : মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর রঈস ও মাসিক আলকাউসার-এর সম্পাদক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জিহাদ-নীতি, বনু কুরাইযার ঘটনাসহ সম্প্রতি আলোচিত কিছু বিষয়ে গত ১৩ মার্চ একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সে সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত কটি অংশ গত ১৫ মার্চ দৈনিক আমার দেশ-এর ‘ধর্ম ও জীবন’ বিভাগে ছাপা হয়েছে। এখানে পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুল্লাহ ফাহাদ

প্রশ্ন : যুদ্ধ ও আক্রমণ-নীতির ক্ষেত্রে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ সম্পর্কে কিছু বলবেন কী?

উত্তর : যুদ্ধ শব্দ ব্যবহার না করে এক্ষেত্রে ‘জিহাদ’ শব্দ ব্যবহার করলেই ভালো হতো। কারণ কিয়ামত পর্যন্তের জন্য বিশ্বশান্তির দূত রহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জিহাদ এ যুগ বা ঐ যুগের দেশে দেশে বা গোত্রে গোত্রের যুদ্ধের মতো কিছু ছিল না। এসব যুদ্ধ তো হয়ে থাকে সম্পদলাভ, আধিপত্য বিস্তার তথা বিভিন্ন পার্থিব উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে। পক্ষান্তরে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জিহাদ ছিল হয়ত বিজাতীয়দের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার্থে, যাকে পরিভাষায় ‘দিফায়ী জিহাদ’ বলা হয়ে থাকে। না হয় খোদাদ্রোহী গোষ্ঠী কর্তৃক আল্লাহর জমিনে সংঘটিত ফিতনা-ফাসাদ ও জুলুম-অত্যাচার এবং আধিপত্যকে দমন করার জন্য। এটি হচ্ছে ‘ইকদামী জিহাদ’। কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে উভয় প্রকার জিহাদের এ তাৎপর্যগুলো সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। নমুনাস্বরূপ সূরা বাকারার ২৫১ এবং সূরা হজ্বের ৩৯, ৪০ নং আয়াত দেখতে পারেন।

এ কারণেই তাঁর জিহাদের ছিল কঠোর নীতিমালা। ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি এমন কোনো গোত্রের উপর হামলা করতেন না। ফিতনা-ফাসাদ ত্যাগ করে অনুগত হয়ে কোনো বিধর্মী ইসলামী রাষ্ট্রে থাকতে চাইলে তার জন্য সে পথ খোলা ছিল। আর জিহাদে নিরীহ নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র স্থাপনের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদী বিভিন্ন গোত্রের লোকদের শুধু সেখানে বসবাস করতেই দেননি; বরং তাদেরকে নিরাপত্তা সনদ প্রদান করেছেন, যাতে এ অঙ্গীকারও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, এ গোত্রগুলোর সাথে অন্য যে সকল গোত্রের সন্ধি আছে তারাও এদের মতো সুবিধা ভোগ করবে। (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৫০১)

প্রশ্ন : গত ৪ মার্চ জাতীয় সংসদে মহাজোটের একজন সংসদসদস্য (মঈনুদ্দীন খান বাদল) মদীনা রাষ্ট্র না মানার অপরাধে বনু কুরাইযার ৬০০ লোকের কল্লা কেটে নেওয়া হয়েছিল-এমন দাবি তুলে ‘বাঙ্গালী উম্মতের বিরোধিতাকারীদের কল্লা কেন কেটে নেয়া যাবে না প্রশ্ন তুলেছেন। একই প্রসঙ্গে তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তার উল্লেখ করা এ তথ্যে কেউ কোনো ভুল ধরতে পারলে তিনি প্রস্তরাঘাতের শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। এ প্রসঙ্গে আপনি কিছু বলবেন কি?

উত্তর : কথাগুলো আমি সংবাদপত্রে দেখেছি। যদি কথাগুলো জাতীয় সংসদে না বলা হত তাহলে আমি এর জবাব দিতাম না। কারণ ইসলাম ও বিশ্বনবীর অনুসারীদের এত দায় পড়েনি যে, যে কেউ মনগড়া একটি মন্তব্য করে দিলেই তার উত্তর দিতে হবে। কিন্তু যেহেতু কথাগুলো বলা হয়েছে সংসদের অধিবেশনে এবং সম্মানিত স্পীকার সাহেব কর্তৃক তা এক্সপাঞ্জও করা হয়নি তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে বাধ্য হচ্ছি। প্রথমেই বলে রাখি, ঐ সদস্যের কথাগুলো শুধু অসত্য ও বিভ্রান্তিকর ছিল তা-ই নয়; বরং তা কোনো মুসলমান বা সম্মানিত সংসদসদস্য-সূলভও ছিল না। সংসদসদস্যদের কাছে দেশের মানুষ আরও দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করে। তার ব্যবহৃত ভাষা ছিল কুরুচিপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘কল্লা কেটে দেয়া হয়েছে’, ‘বাঙ্গালী উম্মত’, ভুল প্রমাণ হলে ‘প্রস্তর মারা হোক।’ এ দিকটির উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। তবে তার বক্তব্যের বিষয়ে বলতে হয় যে, এটি ছিল সত্যের অপলাপ ও কুরুচিপূর্ণ। শত কোটি লোকের প্রাণের নবীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে তিনি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মদীনা রাষ্ট্র না মানার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী কুরাইযার ৬০০ লোকের কল্লা ফেলে দিয়েছেন।’ ইসলামের ইতিহাস ও সীরাতুন্নবীর মোটামুটি খবর রাখেন এমন লোকও বুঝবেন যে, কথাটি মনগড়া। বনু কুরাইযার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে হিজরী ৫ম সনের শেষ দিকে। আর মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম হিজরীতে। এ পাঁচ বছর বনু কুরাইযার লোকজন মুসলমানদের মতো একই সুযোগ-সুবিধা নিয়েই মদীনায় বসবাস করেছে। বরং বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের মদীনা রক্ষার জন্য জিহাদ করতে হলেও তাদেরকে তা করতে হয়নি। কিন্তু মদীনার অন্যান্য ইয়াহুদী গোত্রের মতো বনু কুরাইযার লোকজনও রাষ্ট্রের দেওয়া নিরাপত্তা ও শান্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা ঐতিহাসিক খন্দক যুদ্ধের সময় কাফেরদের বহুজাতিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। বনু কুরাইযার সর্দার শুধু নিজেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়নি; বরং অন্য গোত্রের লোকদেরও এ হীন ষড়যন্ত্রের অংশিদার করেছে। তারা মনে করেছিল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবার অবশ্যই কাফের-মুশরিকদের কাছে পরাজিত হবেন। তাই এই গোপন আঁতাত তাদেরকে পরবর্তীতে কাফেরদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি বা তাদের নৈকট্য লাভের সুযোগ করে দিবে। এ কাজটি ছিল তাদের সাথে কৃত চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, গুপ্তচরবৃত্তি, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং দীর্ঘ ৫ বছর থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের দেওয়া শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর ইচ্ছায় খন্দক যুদ্ধে কাফির, মুশরিক ও ইয়াহুদীদের বহুজাতিক বাহিনী খোদায়ী আজাবের শিকার হয়ে ব্যর্থ হয়ে ফেরত যাওয়ার পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বাসঘাতক বনু কুরাইযাকে পাকড়াও করেছেন জিব্রাঈল আ.-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশে। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বনু কুরাইযাকে অবরোধ করে রাখার পর তারা খন্দক যুদ্ধে আহত এবং ঐ সময়ে মদীনায় চিকিৎসাধীন থাকা হযরত সাদ ইবনে মুআয রা.-এর ফয়সালা মানতে রাজি হয়। হযরত সাদ রা. ছিলেন আউস গোত্রের সর্দার আর এ গোত্রটির সাথে বনু কুরাইযার সুসম্পর্ক ছিল-এ আশায় তারা ঘোষণা করে যে, সাদ ইবনে মুআয তাদের বিষয়ে যে রায় দিবেন তা তারা মেনে নিবে। এরপর তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী আহত অবস্থায় সাদ ইবনে মুআয রা.কে মদীনা থেকে আনা হয় এবং তাদের মেনে নেয়া সালিশ সা’দ ইবনে মুআয রা.-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তাদের শাস্তি নির্ধারিত হয়েছিল। সুতরাং রাষ্ট্র না মানার কারণে বনু কুরাইযার লোকদের হত্যা করা হয়েছিল এ বক্তব্য সম্পূর্ণ অসার।

বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন : সীরাতে ইবনে হিশাম ২/২৩৩ থেকে ২৫৪ ও ২/২২০

এখানে এ বিষয়টিও জানা থাকা ভাল, বনু কুরাইযার মনোনীত সালিশ সাআদ বিন মুআয রা. যে ফয়সালা দিয়েছিলেন তা ইহুদীদের ধর্ম-গ্রন্থের মোতাবেকই ছিল।

কিতাবুল মুকাদ্দস, (তৌরাত), পঞ্চম খন্ড, দ্বিতীয় বিবরণ; যুদ্ধযাত্রা ২০/১০-১৪ (বি, বি, এস, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রকাশকাল ২০০৬)-এ বলা হয়েছে

১০ ‘‘তোমরা কোন গ্রাম বা শহর আক্রমণ করতে যাওয়ার আগে সেখানকার লোকদের কাছে বিনা যুদ্ধে অধীনতা মেনে নেবার প্রস্তাব করবে। ১১ যদি তাতে তারা রাজী হয়ে তাদের দরজা খুলে দেয় তবে সেখানকার সমস্ত লোকেরা তোমাদের অধীন হবে এবং তোমাদের জন্য কাজ করতে বাধ্য থাকবে। ১২ কিন্তু তারা যদি সেই

প্রস্তাবে রাজী না হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে তবে সেই জায়গা তোমরা আক্রমণ করবে। ১৩ তোমাদের মাবুদ আল্লাহ যখন সেই জায়গাটা তোমাদের হাতে তুলে দেবেন তখন সেখানকার সব পুরুষ লোকদের তোমরা হত্যা করবে। ১৪ তবে স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে, পশুপাল এবং সেই জায়গার অন্য সব কিছু তোমরা লুটের জিনিস হিসাবে নিজেদের জন্য নিতে পারবে। শত্রুদের দেশ থেকে লুট করা যে সব জিনিস তোমাদের মাবুদ আল্লাহ তোমাদের দেবেন তা তোমরা ভোগ করতে পারবে।’’

সংসদের ঐ সদস্য তার বক্তব্যে ‘বাঙ্গালী উম্মত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা একটি ইসলামী পরিভাষার সুস্পষ্ট অবমাননা। ধর্মের ন্যূনতম জ্ঞান আছে এমন লোকও জানে যে, ‘উম্মত’ বলা হয় কোনো নবীর দাওয়াতপ্রাপ্ত এবং অনুসারী লোকদেরকে। যেমন হযরত মুসা আ.-এর উম্মত, হযরত ঈসা আ.-এর উম্মত। অর্থাৎ এটি একটি ধর্মীয় পরিভাষা। কোনো ভাষাভাষী, রাষ্ট্র বা গোত্রের সাথে এটি ব্যবহারের সুযোগ নেই। সুতরাং বাঙ্গালী উম্মত কথাটি ঠিক নয়, ঠিক শব্দ হবে বাঙ্গালী জাতি বা বাংলাভাষী জাতি।

পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ঐ সদস্য মহোদয় নাকি সংসদে চ্যালেঞ্জও দিয়েছেন যে, তার কথা ভুল প্রমাণ করতে পারলে তিনি প্রস্তর নিক্ষেপের সাজা নিতে রাজি আছেন। ইসলামে অবশ্য এ সাজা বিশেষ অপরাধীদের জন্য নির্ধারিত। যাহোক যদি মাননীয় স্পীকারের মধ্যস্ততায় ও বিজ্ঞ ইসলামিক স্কলারদের সালিশীতে ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং ঐ সংসদসদস্য স্বঘোষিত শাস্তি গ্রহণের আয়োজনটি রাষ্ট্র থেকে মঞ্জুর করিয়ে নেন তবে আমি আল্লাহর নামে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।

প্রশ্ন : ওই দিনই তিনিসহ আরেকজন সংসদসদস্য বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

উত্তর : কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, (অর্থ) ‘আল্লাহ এর দ্বারা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেন এবং বহু লোককে সঠিক পথের সন্ধান দেন।’-সূরা বাকারা : ২৬

সুতরাং কিছু লোক ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী থাকবেই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ছিলেন এ কথা চরম বেআদবী। আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম খোঁজ করবে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।’-সূরা আলে ইমরান : ৮৫

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে হালকা যে ব্যাখ্যা করে তা হল, রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে কোনো ধর্মকে টেনে আনা হবে না। এবার চিন্তা করুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাষ্ট্র কোন্ নীতিতে চলেছে? তিনি ১০ বছর যাবত কি নিজস্ব আইন-কানুন ও নিয়মনীতিতে শাসন ও বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন, নাকি ইসলামের বিধিবিধান অনুযায়ী করেছেন? নিশ্চয়ই তিনি দ্বিতীয়টি করেছেন। যদি এটিই হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা তবে তো ভালোই। আপনারাও কায়েম করে ফেলুন না সে কালজয়ী আদর্শ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে ইসলামের বিচার ব্যবস্থা ও শাসন পদ্ধতি চালু করতে তো আপনাদের আর কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কারণ আপনাদের কথামতো এটি তো একজন ধর্মনিরপেক্ষ (নাউযুবিল্লাহ) ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা। আমরা অন্যদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বলে অহরহ গালমন্দ করি, আর নিজেরা কী করি তা ভেবে দেখি না।

মূলত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ একটি জাগতিক রাজনৈতিক দর্শন। পাশ্চাত্য এটিকে আবিষ্কার করেছে গির্জার প্রভাব থেকে দূরে থেকে নিজেদের অবাধ পার্থিব ভোগ-বিলাসের সুবিধার জন্য। এটিকে ইসলাম বা ইসলামের নবীর সাথে যুক্ত করা চরম অবমাননাকর, মিথ্যাচার ও জুলুম।

আমি এ পত্রিকার মাধ্যমে সংসদের সম্মানিত স্পীকার সাহেবের কাছে অনুরোধ করব তিনি যেন ঐ কথাগুলো সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন।

প্রশ্ন : নবীজীবন ও সীরাতের বিভিন্ন বিষয়ে এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর কথা এক শ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত মহলের মুখে বিভিন্ন সময়ে শোনা যায়। এটি আসলে কী কারণে ঘটে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : এমনটি করে থাকে দু’ শ্রেণীর লোক। কিছু লোক ইসলামের ইতিহাস ও বিধিবিধান শিখে থাকেন অমুসলিম প্রাচ্যবিদদের লিখিত বইপুস্তক থেকে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ধরনের বইপত্রই পাঠ্য রয়েছে। এরা ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মূল স্কলারগণ (বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম)-এর কাছে যাওয়া বা তাদের দিক নির্দেশনা নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন না। ফলে তাদের পাঠ থেকে যায় ত্রুটিযুক্ত, ভ্রান্তিকর ও অসম্পূর্ণ।

আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকজন খুবই পরিচিত। ‘ধর্মব্যবসায়ী’ গালিটি তাদের আবিষ্কৃত হলেও এটি তাদের সাথেই বেশি মানানসই। মাঝে মাঝেই এ লোকগুলো ইসলামের অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হন। কখনো মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষালয়ে অন্যায় প্রভাব খাটান। এবং ধর্মের খাদেমদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এরা ধর্ম নিয়ে কথা বলেন মূলত নিজেদের ক্ষমতা সুরক্ষা, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করা এবং আপন অপকর্মগুলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর কেউ কেউ এদেরকে সমর্থন দেন পার্থিব কিছু সুবিধা হাসিলের মানসে। আমরা দু’ শ্রেণীর লোকের জন্যই আল্লাহ তাআলার দরবারে হেদায়েতের দুআ করছি।

প্রশ্ন : এদেশের সিলেবাস ও পাঠ্যক্রমে সীরাত বিষয়ক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্তি ও অধ্যয়ন সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

উত্তর : এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের সকল শ্রেণীর বিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য সীরাত পাঠ বাধ্যতামূলক করা দরকার।

মানবজাতির জন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন সর্বোত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব : ২১)

সীরাত পাঠ ও সীরাতের অনুসরণ ছাড়া কোনো প্রকৃত আদর্শবান জাতির কথা চিন্তা করা যায় না। সুতরাং সীরাত পাঠের কোনো বিকল্প নেই। আর এই পাঠক্রম ঠিক করতে হবে অবশ্যই বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের সাহায্য নিয়ে।

প্রশ্ন : ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদারতা বিষয়ে নবীজীর আদর্শ সম্পর্কে কিছু বলুন?

উত্তর : ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেখানে বসবাসকারী অমুসলিমদের প্রতি ইনসাফপূর্ণ আচরণ ও সুষম শাসনপদ্ধতি। গত বছরের শেষ দিকে বিশ্বজিৎ নামক যুবককে নৃশংসভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। আমি তখন আলকাউসারে এক নিবন্ধে কুরআন-সুন্নাহর দলিল-প্রমাণ দিয়ে আহবান করেছিলাম যে, অন্তত এ হত্যার বিচারটি ইসলামী আইনে করুন। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, দোষীদের চরম শাস্তি পেতে একমাস সময়ও লাগবে না। কিন্তু মানব রচিত আইনের সীমাবদ্ধতা ও ফাঁক ফোকর দেখুন, ৩ মাসের বেশি সময় পার হওয়ার পরও এ মামলার কোনো কিনারা হয়নি। শত শত মানুষ, অসংখ্য ক্যামেরার সামনে সংঘটিত এই প্রকাশ্য হত্যাকান্ডের অভিযোগ গঠন প্রক্রিয়াও এখনো শেষ হয়নি।

যারা ধর্মনিরপেক্ষতা বা এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তারা হয়ত মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিম সম্পর্কিত ইসলামের বিধিবিধানগুলো পড়ার সুযোগ পাননি। বা নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে তা পাঠ করেননি। বস্ত্তত একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের তুলনায় ইসলামী রাষ্ট্রে (যদি ইসলামী আইন প্রয়োগ হয়) এরা অনেক বেশি নিরাপদ থাকে এবং তাদের ব্যক্তিগত ধর্মচর্চা, খাবার-দাবার ও পারিবারিক রীতিনীতি নিজেদের মতো করে করতে পারে। অন্যদিকে কোনো মুসলমানও যদি তাদের উপর অবিচার করে তবে এই অন্যায়টি অন্য মুসলমানদের উপর করলে যে শাস্তি হত একই শাস্তি সে ভোগ করবে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামে মূর্তিপূজা কুফরী ও শিরকী কাজ। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা নিজেদের পরিসরে তা করতে পারে নির্বিঘ্নে। শূকর ও মদ ইসলামে নিকৃষ্ট হারাম। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিমরা শুধু এগুলো খাওয়ারই অধিকার রাখে না; বরং নিজেদের মধ্যে তা লেনদেন, বেচাকেনাও করতে পারে। ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয়; বরং দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে যে-ই ইসলামী রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করবে রাষ্ট্র তার জান, মাল ও ইজ্জতের হেফাজতের দায়িত্ব নিবে। খলীফা হযরত আলী রা.কে একজন ইয়াহুদীর বিরুদ্ধে তাঁর একটি বৈধ মালিকানার দাবি থেকে সরে আসতে হয়েছিল তাঁর পক্ষে ছেলে হাসান রা. ছাড়া অন্য সাক্ষী না থাকার কারণে। হযরত হাসান বাবার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চাইলে বিচারক বলেন, ছেলে বাবার পক্ষে সাক্ষী দিতে পারে না। খলীফা আলী রা. তৎক্ষণাৎ ঐ দাবি থেকে সরে আসেন। ইসলামের এ ইনসাফ দেখে ইয়াহুদী মুসলমান হয়ে যায়। খলীফা ঐ বস্ত্তটি তাকে দান করে দেন। আজকের সেক্যুলার পৃথিবীতে এমন কোনো নজির কি কেউ দেখাতে পারবে?

প্রশ্ন : ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের ওপর জিযিয়া বা ‘বিশেষ কর’ ধার্য হওয়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে কেউ কেউ বলে থাকেন যে, এভাবে তারা অবহেলিত নাগরিক হিসেবে মূল্যায়িত হয়ে থাকেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

উত্তর : জিযিয়া বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে কারো এমন ধারণা হতে পারে। বস্ত্তত ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিমগণকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মুসলমানদের তুলনায় কম সম্পদ জমা করতে হয়। অথচ রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা তারা ভোগ করে থাকে সমানভাবে। জিযিয়া মূলত ২ প্রকার : ১. পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে এই করের হার নির্ধারণ করা হয়। কোনো অমুসলিম অঞ্চল আলোচনা সাপেক্ষে ও সন্ধির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলে তাদের ক্ষেত্রে এ নীতি প্রজোয্য হয়। খলীফা ওমর রা. কোনো কোনো গোত্রের সাথে এভাবে আলোচনা করে জিযিয়ার হার নির্ধারণ করেছিলেন। জিযিয়ার ২য় প্রকার প্রজোয্য হয় ঐ সকল অঞ্চলের অমুসলিমদের ক্ষেত্রে, যে অঞ্চল জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের আওতায় আসে। এদের ক্ষেত্রে জিযিয়ার হার সুনির্ধারিত। বর্তমান সময়ের মানুষ এই করের হার দেখলে অবাক না হয়ে পারবেন না। হানাফী মাযহাবে এই হার হচ্ছে ধনীদের জন্য বাৎসরিক ৪৮ দিরহাম। মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে ২৪ দিরহাম। আর নিম্ন আয়ের লোকদের ক্ষেত্রে ১২ দিরহাম। যা রূপার বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী (আনুমানিক) যথাক্রমে ১৮,০০০/-, ৯,০০০/- ও ৪,৫০০/- টাকা হয়ে থাকে। তাও আবার এ জিযিয়া আরোপিত হয় শুধু সক্ষম বালেগ পুরুষের উপর। অমুসলিম সকল নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এ করের আওতামুক্ত।

আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রা. বলেছেন, ‘আমি আমার পরবর্তী খলীফাদের জন্য বলে যাচ্ছি, তারা যেন (সংখ্যালঘু) অমুসলিমদের সাথে সদাচরণ করে, তাদের সাথে কৃত চুক্তি যেন রক্ষা করে এবং তাদের জান, মাল ও ইজ্জত রক্ষার জন্য যেন লড়াই করে। আর তাদের উপর যেন সাধ্যাতিরিক্ত কিছু আরোপ না করা হয়। (কিতাবুল খারাজ পৃ. ১৩৬)

এমনকি হযরত উমর একজন দরিদ্র অমুসলিম বৃদ্ধকে দেখে তার জন্য মুসলমানদের বাইতুল মাল থেকে ভাতাও চালু করেছিলেন। যা পরবর্তীতে শরয়ী বিধান হিসাবে বিবেচিত হয়। (কিতাবুল আমওয়াল পৃ. ৫২)

জিযিয়া সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়িল এবং হাদীস ও আছার-এর জন্য পড়া যেতে পারে : মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১৭/৪০৬; কিতাবুল আমওয়াল পৃ. ৪৯; কিতাবুল খারাজ পৃ. ১৩২; আলমাউসূআতিল ফিকহিয়্যাহ ১৫/১৮৩।

আর আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. ‘আহকামু আহলুয যিম্মাহ’ নামে এ বিষয়ে সুন্দর একটি স্বতন্ত্র কিতাবও রচনা করেছেন।

এবার দেখুন ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমানদের দিকে। সকল সামর্থবান বালেগ মহিলা-পুরুষের উপর যাকাত ফরয। তার স্বর্ণ, রূপা, নগদ টাকা, ব্যাংক ব্যালেন্স ও ব্যবসার সম্পদের ২.৫% অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হয়। যা থেকে একই রাষ্ট্রে বসবাসকারী ও রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগকারী অমুসলিমগণ সম্পূর্ণ দায়মুক্ত। কারণ যাকাত হচ্ছে একটি ইবাদত, আর কোনো অমুসলিমের ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। সে কারণে তার ওপর কোনো ইবাদত চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লক্ষ্যণীয় হল যেখানে মানব রচিত আইনে শাসিত রাষ্ট্রগুলো ধনী-গরিব নির্বিশেষে বাধ্যতামূলক করারোপ করে থাকে, ভ্যাট বা মূল্য সংজোযিত করের নামে এমনকি একজন ভিক্ষুকের কেনা মাথাব্যাথার ট্যাবলেটের উপরও করের বোঝা চাপায় সে রাষ্ট্রগুলো বা ঐ রাষ্ট্র পদ্ধতির সমর্থকের মুখে জিযিয়া পদ্ধতির সমালোচনা কীভাবে মানায়!

বিষয়: বিবিধ

১৩৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File