স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে রক্ত ঝরা দিনগুলি

লিখেছেন লিখেছেন সজিব ওয়াজেদ ০৫ মার্চ, ২০১৩, ০২:৩৪:১৯ দুপুর

সূত্র : http://coalitionbdus.blogspot.com/2013/03/blog-post_1232.html

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা শুরু হয় সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো ও শাসকশ্রেণীর অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে দেশটির পথচলা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে; রক্ত ঝড়েছে, বিপদও নেমে এসেছে বারবার।

তেমনই একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো গেলো শুক্রবার। একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ৬১ জনের মতো লোক নিহত হয়েছেন।

বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে পুলিশের এই হত্যাকাণ্ডকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘গণহত্যা’ নামে অভিহিত করেছেন রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা ।

কেবল একটি দিনের মধ্যে এত ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশের একচল্লিশ বছরের ইতিহাসে বিরল। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া পাক শাসনামলেও এমন নজির নেই।

এছাড়াও বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন আরও কিছু দিন আছে- যা নৃশংসতম দিন হিসেবে ইতিহাসে উল্লেখ থাকবে।

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: পুলিশি গণহত্যা

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি বর্বর ও দুঃখজনক দিন হিসেবে আখ্যায়িত থাকবে।

এদিনে পুলিশের গুলিতে বিরোধী দলের অন্তত ৬০ জন লোকের মৃত্যু হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-১ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে।

ট্রাইব্যুনালের রায়কে অস্বচ্ছ ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী দাবি করে জামায়াতের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে। বিক্ষোভে পুলিশ গুলিতে ৬০ জনেরও বেশি নিহত হন।

পাল্টা হামলায় নিহত হয়েছেন ৫ পুলিশ সদস্য ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই নেতাকর্মী। এছাড়াও আহত হয়েছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি লোক।

সর্বাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার, বগুড়া, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে।

৩ মার্চ, ২০১৩: গণহত্যার দ্বিতীয় পর্ব

দেশজুড়ে বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলির প্রতিবাদ এবং জামায়াত নেতা ও ধর্ম প্রচারক মাওলানা সাঈদীর মুক্তি চেয়ে তার ভক্ত ও দলটির লোকেরা রবিবারের হরতালে রাস্তায় নেমে এলে পুলিশের গুলিতে নারী-শিশুসহ ২৬ জন নিহত হয়েছে।

নিহতদের মধ্যে বগুড়ায় রয়েছে চার নারীসহ ১২জন, রাজশাহীতে নারী-শিশুসহ ৪জন, জয়পুরহাটে ৬ জন, সাতক্ষীরায় ২জন, গাজীপুরে একজন ও ঝিনাইদহে একজন পুলিশ কনস্টেবল। এসব ঘটনায় আরও অন্তত ৫০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯: পিলখানা হত্যাযজ্ঞ

সশস্ত্র বাহিনী তথা বাংলাদেশের এক কলঙ্কিত ও শোকের দিন। এই দিনে রাজধানীর পিলখানায় নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয় সেনাবাহিনীর চৌকষ কর্মকর্তাদের।

২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র দু’দিনের ভেতরে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৫ জন নিহত হয়েছেন। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে ঘটে যাওয়া এ বিভৎস ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোচনার ঝড় তোলে।

২৮ অক্টোবর, ২০০৬: লগি বৈঠার দিন

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দেশের রাজনীতি ইতিহাসে লগি-বৈঠার তান্ডবের দিন হিসাবে পরিচিত থাকবে। এই দিনে ঢাকার পল্টন মোড়ে আওয়ামী লীগ ও বাম সমর্থিত ১৪ দলের নেতা-কর্মীদের সাথে জামায়াতে ইসলামীর সংঘাতে ৬ নেতাকর্মী নিহত হন। নিহতদের ৫ জন জামায়াত-শিবিরের এবং একজন ১৪ দলীয় জোটের কর্মী ছিলেন।

ওইদিন আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা বাহিনীর হামলায় রাজধানীসহ দেশজুড়ে নিহত হয়েছেন ১৮ জনের মতো।

এ ঘটনায় জাতিসংঘের তৎকালীণ মহাসচিব এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বজুড়ে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে. এম. হাসানের নিয়োগের বিরোধিতা করে তখনকার প্রধান বিরোধীদল আওয়ামীলীগসহ বামপন্থী ১৪ দল আন্দোলনের ডাক দিলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬: নির্বাচন ঘিরে ১৫ লাশ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ-জামায়াতে ইসলামী-জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী দলগুলোর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়।

ক্ষমতাসীন বিএনপি এসব দাবি নামঞ্জুর করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। বিরোধী দলগুলোর প্রতিরোধের মুখে ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হন।

১১ মে, ১৯৮৫: নিরস্ত্র জনগণের ওপর পুলিশের গুলি

১৯৮৫ সালের ১১ মে চাপাইনবাবগঞ্জের মানুষের কাছে একটি ভয়াবহ দিন ছিল। সেদিন কলকাতার হাইকোর্টে মুসলমানদের ধর্মীয়গ্রন্থ কুরআনের সব বাংলা অনুবাদের কপি বাজেয়াপ্ত করতে একটি রিট আবেদন করা হয়।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ওইদিন বিকাল ৩টায় জেলার ঈদগাহ মাঠে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। প্রতিবাদী জনতার মিছিলে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দেয় চাপাইনবাবগঞ্জের তখনকার ম্যাজিস্ট্রেট ওহিদুজ্জামান মোল্লা।

এতে ঘটনাস্থলেই ৩জন নিহত এবং পরবর্তীতে হাসপাতালে ৮ জনের মৃত্যু হয়।

১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩: ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি

সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে ‘মধ্য ফেব্রুয়ারি’র আন্দোলনের দিন।

মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন কাঞ্চন, জাফর, জয়নাল, আইয়ুব, দিপালী ও ফারুক।

এই আন্দোলনটি ছিল স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী প্রথম বড় ধরনের কোন আন্দোলন।

৩০ মে, ১৯৮১: একজন রাষ্ট্রনায়কের বিদায়

১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল বিপথগামী সৈনিকের বুলেটে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে একজন জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্য গুলি করে হত্যা করে।

ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম হয়েছিল জেনারেল জিয়ার জানাযায় ।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫: বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা

পচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নৃশংস ঘটনাটি ঘটে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে খুন হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের ১৫ সদস্য।

১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে শোকদিবস পালন করা হয়।

১৭ মার্চ, ১৯৭৪: জাসদের ওপর লীগের হত্যাকাণ্ড

সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বৃষ্টির মতো গুলিতে ৪০ জনের মতো নিহত হয়েছেন।

তখনকার জাসদ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবসহ দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হন।

পহেলা জানুয়ারি, ১৯৭৩: রক্ত ঝড়ানোর প্রথম দিন

স্বাধীনদেশে প্রথমবারের মতো ছাত্র জনতার রক্তে লাল হয় ঢাকার রাজপথ।

পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মতিউল ইসলাম ও ঢাকা কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র মির্জা কাদের। গুরুতর আহত হন আরও ৬ জন।

ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে পরদিন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়।

বিষয়: বিবিধ

১৩২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File