ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক ন্যায় বিচার

লিখেছেন লিখেছেন টাংসু ফকীর ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৭:২৬:৩৫ সকাল

‘‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারা যালেম”৤ -আল-কোরআন

إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَـٰنِ

ইন্নাল্লাহা য়্যা মুরুবিল আদলে ওয়াল ইহসান৤

অর্থ্যাৎ আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন সকল বিষয়ে ন্যায় বিচার করতে এবং মানুষের কল্যাণ সাধন করতে৤” আল কোরআন (সুরা নহল ১৬ঃ ৯০)

ভূমিকা t বর্তমানে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে এক চরম সামাজিক অস্থিরতা উত্তেজনা বিরাজ করছে৤ চারদিকে মারা-মারি, হানা-হানি, চুরি ডাকাতি সহ নানান অসামাজিকতা বিরাজ করছে৤ কোথাও একটু স্থিরতা নেই৤ কোথাও শান্তি নেই৤ সামাজিক অস্থিরতা হ্রাসের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৤ পেরেস্ত্রেইকা, গ্লাস্ত-নস্ত, তথা মানব রচিত মতবাদের উত্তাল হাওয়ায় খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেছে সমগ্র কম্যুনিষ্ট বিশ্ব, সেখানে এখন বইছে স্বাধীন গণতন্ত্রের হাওয়া, কিন্তু সামাজিক কোন স্থিরতা নেই৤ শুধু তা কেন সারা বিশ্ব এখন চরম সংকটের সম্মুখীন৤ কোথাও মানুষ সংগ্রাম করছে আত্ন-নিয়ন্ত্রাধিকারের দাবিতে আবার কোথাও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য৤সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ, বসনিয়া, ফিলিপাইন, ফিলিস্তিন, বার্মা সহ সারা বিশ্বই এর প্রমাণ৤ কোথাও শান্তি নেই৤ কিন্তু কেন? গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল আড়াই হাজার বছর পূর্বেই এর উত্তর দিতে চেষ্টা করেছিলেন৤ তিনি ১৫৮টি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনা করে বলেন “ জনগণের মধ্যে বঞ্চনার অধিকারই মূলতঃ সামাজিক অস্থিরতার আসল কারণ৤” মানুষ যখন হয় নির্যাতিত-নিপীড়িত তখনই সে তার অধিকারের জন্য বিদ্রোহ করে৤এই জন্য বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র নায়কগণ নানান বৈঠক, সম্মেলন ইত্যাদির আয়োজন করেন৤ নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করেন শান্তির জন্য৤ কিন্তু বিশ্ব ক্রমেই অন্ধকারে নিপতিত হচ্ছে৤ এই জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তা হচ্ছে “ন্যায় বিচার৤” ন্যায় বিচার এবং সামাজিক শান্তি অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত৤ এখন কথা হচ্ছে এই ন্যায় বিচার কোন পথে প্রতিষ্ঠা হতে পারে? প্রচলিত জীবন ব্যবস্থায় মানুষ বিন্দু মাত্র অগ্রসর হতে পারছেনা, কারণ এটা মানুষের তৈরী জীবন ব্যবস্থা৤ কিন্তু বিতর্কের কোন শেষ নাই৤

পরিবর্তিত কিন্তু মানব সমাজ দেখে এসেছে বহু সামাজিক বিচার কাঠামো৤ ন্যায় বিচার তবু মানুষের নাগালের অনেক বাইরে থেকে যাচ্ছে৤ অথচ ইসলাম মানুষের জন্য এমন একটি জীবন ব্যবস্থার সুপারিশ করে যা সমাজে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের জন্য জাগতিক সুখ ও পারলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত করে৤

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন,

“ বল হে আদম সন্তানেরা প্রভু ন্যায় বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন৤(সুরা আরাফ-২৯)৤

যুগে যুগে তিনি (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) কিতাব সহ পথ নির্দেশক রাসুলদের পাঠিয়েছেন যাতে মানুষ সমাজে ন্যায় বিচার কায়েম করে৤(সুরা হাদীদ)

এমনকি সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (স.) কেও আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন৤(সুরা-শুরাহ-১৫)৤

মহানবী (স.) তাঁর দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে মদীনার ইহুদী, খ্রীষ্টান, পৌত্তলিক, মুসলিম সবাইকে নিয়ে একটি লিখিত চুক্তি বা মদীনা সনদ এর অধীনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন৤ এই সনদই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সনদ বা সাংবিধানিক সরকার হিসেবে স্বীকৃত৤

মহানবী (স.) এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ও সংগঠিত মদীনার ঐক্যবদ্ধ সমাজ আধুনিক অর্থে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল৤ যেখানে ইসলামী সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে ‘সাম্য” মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার নীতির পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল৤

ন্যায় বিচার কি?

ন্যায় বিচার হল আইনের শাসন, কার্ল জে ফেড্রারিক এর সংগাটি অসম্পূর্ণ৤ বক্তব্যের সীমাবদ্ধতা হল যে আইন তৈরীতে জনগণের অংশ গ্রহণের কথা এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি৤ “প্লেটো”র মতে প্রত্যেকে তার ন্যায্য প্রাপ্য প্রদান৤ এ সংগা সমন্ধে প্লেটো বলেন যে, প্রত্যেককে তার স্ব-স্ব অবদানের অনুপাতের যথাযথ প্রাপ্য/পুরস্কার প্রদান করাটাই হচ্ছে ন্যায় বিচার৤ কিন্তু সমাজে স্ব-স্ব অবদানের বিনিময়ে পুরস্কারই যদি ন্যায় বিচার হয়, তাহলে সমাজে যারা পংগু, অক্ষম, বৃদ্ধ, রুগ্ন তাদের ভাগ্যে কি হবে এ ব্যাপারে পাশ্চাত্যের পন্ডিতেরা নীরব৤

ইসলামে সামাজিক ন্যায় বিচার ঃ ইসলামে সামাজিক ন্যায় বিচার হচ্ছে একটি ব্যাপক ও সমন্বিত কর্মসূচী৤ ইসলাম হচ্ছে মানব জাতির জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা৤সামাজিক জীবনের বিধান হচ্ছে ন্যায় বিচার ভিত্তিক একটি কল্যাণমূখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা৤ (সূরা হাদীদ ঃ২৫ ইমরান ঃ ১১০)৤

ইসলামে ন্যায় বিচারের বৈশিষ্ট্য ঃ

ক. সামজিক আইন ও নীতি প্রণয়ন অর্থ্যাৎ সমাজের কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে মানুষের সমান অধিকার৤

খ. নির্ধারিত আইন ও নীতি প্রণয়ন ঃ সমাজের উচ্চ-নীচ, ধনী গরীব, শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে সবাইর ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ৤

গ. রাষ্ট্রীয় সেবা ও সরবরাহ গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রে বসবাসকারী সবার সমান অধিকার৤

ঘ. জনগণের মৌলিক চাহিদার (অন্ন, বস্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) পূরণ)৤

ঙ. দারিদ্র মোচন ( কর্মক্ষমদের জন্য কর্ম সংস্থান এবং কর্মে অক্ষমদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থার মাধ্যম)৤

চ. সম্পদের স্বার্থে উৎপাদনের উপকরণ সমূহের (ভূমি, শ্রম, পুজিঁ ইত্যাদি) সর্বাধিক ব্যবহারের মাধ্যমে অতিরিক্ত সম্পদ সৃষ্টি এবং ছ. ন্যায় বিচারের কর্মসূচী অব্যাহত রাখার স্বার্থে সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত না করা৤

প্রচলিত ন্যায় বিচার ঃ

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা যে ভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেটা মানব রচিত মতবাদের দ্বারা৤ ন্যায় বিচারকে তারা বিভিন্ন ভাবে সম্পন্ন করেছেন৤ অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকান স্বাধানতার প্রতিষ্ঠাতাগণ শাসনতন্ত্র প্রণয়নকালে সরকার গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন “ন্যায় বিচারই হচ্ছে সরকারের লক্ষ্য৤ “প্লেটো বলেছেন “ন্যায় বিচারই সরকারের আদর্শ৤

বাংলাদেশের ঘোষণা পত্রে ”সামাজিক ন্যায় বিচারকে” রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে৤ কিন্তু এর বাস্তবায়ন কোথাও হয়নি৤ আমেরিকায় সামাজিক সাম্যতার নামে শুধু পুরুষ এবং সাদাদের অধিকার দিয়েছিল৤ ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে কালোদের অধিকার দেয়া হয়েছে৤ ১৯তম সংশোধনীতে মেয়েদের ভোট প্রদানের অধিকার দেয়া হয়৤ কিন্তু বৈষম্য দূর হয়নি৤ কিছু দিন আগেও আমেরিকার লসেএঞ্জেলস এ ভয়াবহ বর্ণ দাঙ্গা হয়ে গেল শুধুমাত্র সামাজিক ন্যায় বিচারের অভাবে৤

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফেড্রারিক এর তে “ন্যায় বিচার হচ্ছে আইন অনুযায়ী সকল ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য নিশ্চিত করা কিন্তু এ সংগাটিকে বিভিন্ন মনীষী গণ অসম্পূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন৤ রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ”আর্নেষ্ট বার্কার” প্লেটোর একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে বলেন “ন্যায় বিচার হচ্ছে নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ববোধ৤” কিন্তু ইহাও স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়৤ ন্যায় বিচার সংক্রান্ত উপরোক্ত সংগা গুলো মানুষের সমষ্টিগত জীবন প্রবাহের ভিন্ন ভিন্ন দিক দিয়ে আবর্তিত হয়েছে৤ এমন কোন সংগা কেউ দিতে পারে নাই যেটা মানুষের সার্বিক দিক দিয়ে জীবন ব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত করে৤

এ ব্যাপারে ইসলাম বর্ণিত “ ন্যায় বিচার” বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে৤

ন্যায় বিচারের স্বরূপ ঃ ন্যায় বিচার ভিত্তিক একটি আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন কালে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক ”প্লেটো” সৎ ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তিদের শাসন কায়েমের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন৤ প্লেটোর মতে “ শাসকদের নিঃস্বার্থ হওয়ার জন্য স্থায়ী ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারবেনা৤ কিন্তু এ কথা হতে পারে না৤

কিন্তু ইসলাম সমাজে ন্যায় বিচারের কর্মসূচী সফল করার লক্ষ্যে সৎ ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন৤ (ইবনে মাজাহ)৤

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,

ٱتَّبِعُواْ مَن لَّا يَسۡـَٔلُكُمۡ أَجۡرً۬ا وَهُم مُّهۡتَدُونَ

“ ইত্তাবেয়ূ মাল্লা য়্যাছআলুকুম আজরাও ওয়াহুম মুহতাদুন৤ “ তোমরা অনুসরণ কর তাদেরকে যারা সৎ এবং যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায়না৤ (সুরা ইয়াসিনঃ ২১)

সামাজিক ন্যায় বিচার যাতে সুষ্ঠভাবে হয়, সে জন্য ইসলাম শাসকদের সৎ-নিষ্ঠার জন্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন৤

আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নির্ধারিত পথ নির্দশেনার অনুসরণ, জবাবদিহিতার চেতনা, প্রাত্যহিক সালাত ব্যবস্থা, কর্ম মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তির অঙ্গিকার৤

১. সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করো কোরআন সুন্নাহর আলোকে৤ প্রয়োজনীয় আইন ও কর্মসূচী প্রণয়ন কালে শাসক ও প্রশাসকদেরকে জনগণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বর্গের সাথে আলাপ আলোচনা ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন৤ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,

وَأَمۡرُهُمۡ شُورَىٰ بَيۡنَہُمۡ

“ ওয়া আমরুহুম সুরা বাইনাহুম৤ অর্থ্যাৎ “তোমরা নিজেদের মধ্যে কর্ম সম্পাদন কর আলাপ আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে৤ (সুরা শুরা-৩৮)৤

“ ভয় কর আল্লাহকে তার নিকট সমবেত হতে হবে৤”(সুরা মুকাদাসা-৯)৤

আল্লাহ আরো বলেন-

وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُ ۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَٮٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُ ۥ فُرُطً۬

ওয়ালা তুতিয়ূমান আগফালনা কাল বাহু আন জিকরানা ওয়াত্তাবায়া হাওয়া হু ওয়াকানা আমরুহু ফুরুতা”

“যে তার খেয়াল খুশীর অনুসূরণ করে (স্বৈরাচার) এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে ( শাসনতন্ত্র বিরোধী) তুমি/তোমরা তার আনুগত্য করোনা৤ (সুরা কাহফ-২৮, সুরা কলম-১২)৤

সমাজে ন্যায় বিচার কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে লোকপ্রশাসকের পথ নির্দেশিকা হবে আল্লাহর কোরআন, রসূলের (স.) এর সুন্নাহ এবং সমাজে বৈধ কর্তৃত্বের অধিকারী শাসক-প্রশাসকের ন্যায় সংগত নির্দেশাবলী৤

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন :

“ইন্না আনযালনা ইলায় কাল কিতাবা বিল হাককে লি তাহুকমা বায়নান নাছে বিমা আরাকাল্লাহ৤ “ নিশ্চয় আমি পরম সত্য কোরআন (রাসূল (স.) প্রতি অবতীর্ণ করেছি যেন আপনি আল্লাহর নির্দেশমত সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেন৤ সুরা নিসা-১০৫)৤

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ {7}

ওয়ামা আতাকুমুর রাসুলু ফাহুজুহু ওয়ামা নাহুকুম আনহু ফানতাহু৤

অর্থ্যাৎ “আল্লাহর রাসূল (স.) তোমাদের যা আদেশ করেন তা তোমরা প্রতিপালন কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক৤ সুরা হাশর-৭)

ইয়া আইয়্যু হাল্লাযিনা আ’মানু আতিয়্যুল্লাহা ওয়া আতিয়্যু রাসুলা ওয়া উলিল আমরু মিন কুম৤”

“হে বিশ্বাসীগণ তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আল্লাহর রাসূলের (স.) এর এবং আনগত্য কর তোমার উপর কর্তৃত্বশীলদের৤ সুরা নিসা-৫৯)৤

উপরোক্ত আয়াত সমূহে তিন স্তর বিশিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামোর কথা বলা হয়েছে৤ ক. আল্লাহ খ. আল্লাহর রাসূলের (স.) গ. দায়িত্বশীলদের৤

আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর প্রিয় সাহাবী মোয়াজ (রা.) কে ইয়ামেনের গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠানোর সময় জিজ্ঞেস করলেন “ মোয়াজ তুমি কিভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করবে?

তিঁনি বললেন “ আল্লাহর কোরআনই হবে আমার পথ নির্দেশিকা৤ রাসূল(স.) বললেন যদি কোন বিষয়ে কোরআনের সুস্পষ্ট ফায়সালা না থাকে তবে? তিঁনি বললেন আল্লাহর রাসূলের (স.) সুন্নাহ অনুযায়ী ফায়সালা করব, তিঁনি রাসূল (স.) বললেন সেখানেও যদি না থাকে? তিঁনি বললেন আমি ইজতেহাদ (বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে) করে ফায়সালা করব৤ এ কথা শুনে রাসূল (স.) মোয়াজ (রা.) কে দোয়া করে বললেন “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আল্লাহর, ও রাসূল (স.) এর প্রতিনিধিকে রাসূলের(স.) মন মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের তৌফিক দিয়েছেন৤ (তিরমিযি, আবু দাউদ)৤

৩৤ ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস হচ্ছে “ সারা জাহানে যা কিছু আছে সব কিছুর মালিক আল্লাহ৤ তিনিই সব কিছুর মালিক৤ তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী৤

পবিত্র কোরআনের ভাষায় “ আন্নাল্লাহা লাহু মুলকুস সামাওয়াতে ওয়াল আরদ” ”আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব এক মাত্র আল্লাহর”৤ সমাজে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন তারা হবেন আল্লাহর প্রতিনিধি মাত্র আর ক্ষমতার আমানতদার মাত্র৤

৪৤ ইসলাম প্রাপ্ত বয়স্ক নর নারীর জন্য দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছে৤ প্রাত্যহিক নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশ এবং অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভবিষ্যতে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার অঙ্গীকার থাকে৤ এই জন্য আল্লাহ সালাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন৤ কোরআনের ৮২ জায়গায় এর গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন৤

আল্লাহ বলেন “ইন্না সালাতা তানহা আনিল ফাহসায়ে ওয়াল মুনকার৤” সুরা আনকাবুত-৪৫

৫৤ ইসলাম মানুষকে সমাজবোধ এবং সমাজের জন্য ত্যাগী হতে উজ্জীবিত হয়ে মানব কল্যাণ ও সৎকর্মে উদ্যোগী হবার জন্য বারংবার উৎসাহী করেছে৤পবিত্র কোরআনের ভাষায় “ কুনতুম খায়রা ---”তোমরাই শ্রেষ্ঠজাতি , তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য, তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎকাজের নিষেধ করবে৤ সুরা ইমরান-১১০৤ মানুষের মধ্যে তারাই উত্তম যারা মানব কল্যাণে বেশি উপকারী৤ এভাবে ইসলাম আত্নকেন্দ্রিকতা বা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের উর্দ্ধে উঠে মানুষের মধ্যে সমাজ বোধ জাগ্রত করার এবং সমাজের জন্য ত্যাগ স্বীকারে উদ্ধুদ্ধ হওয়ার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করেছে৤

মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স.) শাসক ও প্রশাসকের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতিশীল, সুবিচারক ও তাদের কল্যাণকামী ও ন্যায় পরায়ণ হবার নির্দেশ দিয়েছেন৤ হাদীস শরীফে জনগণের কল্যাণকামী ও ন্যায় পরায়ণ শাসকদিগকে খোদার ছায়া বলে অভিহিত করেছেন৤

আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন “ যে ব্যক্তি জনগণের বিষয়ে দায়িত্বশীল হলেন অতঃপর তিনি তাদের কল্যাণ ও স্বার্থের জন্য সে ধরণের চেষ্টা করলেন না যে ধরণের চেষ্টা নিজের জন্য করেছেন আল্লাহ শেষ বিচারের দিন তাকে উল্টো করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন৤ (তাবারানী)

৬৤কোরআন ও হাদীসে সু-শাসকদের জন্য পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে৤ শেষ বিচারের দিন আল্লাহর আরশের নীচে যারা স্থান পাবেন তাদের মধ্যে ন্যায় বিচারক গণ থাকবেন৤ সুরা বাকারা-৮২, সুরা কাফ-৩১-৩২, সুরা নিসা-১২৩, সুরা ফাতির- ৩৬-৩৭ এই সুরা গুলিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর তরফ থেকে সু-শাসকের জন্য পুরস্কার আর দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তির কথা উল্লেখ আছে৤

কোরআনের আলোকে ন্যায় বিচারের বাস্তবতা ঃ

আল্লাহ বলেন “ হে বনি আদম বল আমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য৤ সুরা-আরাফ-২৭-২৯৤ “আমি রাসূলদের প্রেরণ করেছি ন্যায়-নীতির কিতাব সহ (পথ নির্দেশক) যাতে মানুষ সমাজে ন্যায় বিচার কায়েম করে৤ “ সুরা -হাদীদ ২৫

১৤ ইসলামে সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রথম কথা হল সমাজ বসবাস কারী সকলের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা৤

আল্লাহর রসূল(স.) বলেছেন “ প্রতিটি আদম সন্তানের তিনটি বিষয়ের উপর অধিকার রয়েছে৤ খাবার জন্য রুটি থাকার জন্য বাসস্থান এবং পরার জন্য বস্র৤ (তিরমিযী)৤

২৤ সমাজের সকল দক্ষ ও কর্মক্ষম ব্যক্তির জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা৤খ) সমাজের অক্ষম, রোগী, এতিম, বিধবা, ছিন্নমূল অর্থ্যাৎ যারা কাজ করতে অক্ষম তাদের জন্য সম্মান জনকভাবে জীবন যাপনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা৤ হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন “কেউ নির্ভরশীল পোষ্য রেখে রাখা মারা গেলে নির্ভরশীলদের দায়ত্ব আমাদের৤” এবং সমাজের যার কোন অবলম্বন নেই , রাষ্ট্র তার অবলম্বন৤(আবু দাউদ)৤ এই পুর্নবাসনের ব্যয়ভারের জন্য আল্লাহ ধনীদের সম্পদের কিছু অংশ গরীবের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন৤

আল্লাহ বলেন “ ধনীদের সম্পদে নির্ধারিত রয়েছে সমাজের গরীব ও বঞ্চিতদের৤ সুরা- জারিয়াত-১৯)

৩৤ সম্পদের ভারসাম্যের জন্য ইসলাম যাকাত, সদকা, উশর, ওয়াকফ ইত্যাদির বিধান করেছেন৤ আল্লাহ বলেন “ তোমাদের মধ্যে শুধু ধনীদের মাঝেই যেন সম্পদ আবর্তিত না হয়৤ (সুরা হাশর- ৭)

৪৤ সাম্য ঃ কৃষ্ণাঙ্গ , গৃহভৃত্য হতে শুরু করে দেশের সকল নাগরিকের সরকারী কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে ইসলাম মানুষের জন্য সমান অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদাণ করে৤ বুখারী-মুসলিম৤

৫৤ ইসলামে সামাজিক শান্তি ও সংহতি যা অব্যাহত উন্নয়নের জন্য অত্যাবশক তা রক্ষা করা৤ এ জন্য শাসক ও জনগণকে কোরআনের ও সুন্নাহর বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত নিজ নিজ সীমানার মধ্যে থেকে আচরণ করার জন্য বলা হয়েছে৤ সুরা- মাঈদা ঃ ৪৮-৮৭)

সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রয়োগ ঃ

ইসলাম মানুষের জন্য দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জীবন যাপন করার বিধান দিয়েছে৤ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা৤ সমাজের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন হতে শুরু করে খুটি-নাটি সমস্ত বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে৤

কৃষি ঃ সমাজের জন্য সম্পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইসলাম ভূমি, পুঁজি , শ্রম ইত্যাদি উৎপাদনের উপকরণ গুলির সর্বোচ্চ ব্যবহারের উপর জোড় দিয়েছে৤

খলিফা উমর (রা.) এর নির্দেশ ছিল “ কারো হাতে পুঁজি থাকলে তা প্রয়োগ করা উচিৎ এবং কারো মালিকানা জমি থাকলে তা চাষ করা উচেৎ৤ আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন “ কেউ জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও একাধিক্রমে তিন বছর জমি চাষ না করে পতিত রাখলে তার জমি বাজেয়াপ্ত হবে”৤

আল্লাহ কোরআনে উৎসাহিত করছেন যে কারে কাছে পুঁজি থাকলে সেটাকে উৎপাদন মূখী ব্যবহারে খাটানোর জন্য৤ (সুরা বাকারা-২৭৫)৤ রাসূল (স.) বলেছেন “ যদি কেহ কোন কওমের জমি বিনা অনুমতিতে চাষ করে সে উহার ফসল পাইবেনা কিন্তু যাহা সে খরচ করিয়াছে তাহা সে পাইবে৤”

”মদীনা বাসী অনেকেরই চাষবাস ছিল৤ আমাদের মধ্যে কেহ কেহ জমি লাগাইয়া বলিত , এই দাগ (অংশ) আমার এবংঐ দাগ তোমার৤ প্রায়ই হয়ত এক দাগে ফসল হইত অন্য দাগে ফসল হইত না৤ রাসূল (স.) এই প্রকার ভাগ করিতে নিষেধ করিয়াছেন৤ বর্ণনায় হযরত রাফে বিন-খাদিজা (রা.)৤

সমাজে সবার জন্য সাম্যের বিধানের জন্য আল্লাহ এবং রাসূল (স) এই বিধানের আলোকে আমাদের চলতে নির্দেশ দিয়েছেন৤

বিচার ঃ আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান৤ একদা সম্ভ্রান্ত বংশীয় এক রমনী ফাতেমা বিনতে আসাদ চুরির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে, অপরাধীর পক্ষে সুপারিশ কারীদের উদ্দেশ্যে করে রাসূল(স.) বলেন “আল্লাহর কসম! যদি ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদও চুরির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হত তাহলে শরীয়া আইন অনুযায়ী তাকে একই শাস্তি ভোগ করতে হত৤ “রাসূল(স.) এর সময় দুই ব্যক্তি একই স্বত্ব দাবী করিয়াছিলেন এবং প্রত্যেকেই দুই জন করে স্বাক্ষী প্রেরণ করিলি৤ তিনি তাহাদের মধ্যে ইহাকে সমান ভাগ করিয়া দিয়েছিলেন৤ (আবু দাউদ) বর্ণনায় ঃ হযরত আবু মুসা-আশয়ারী (রা.)৤

বিবাহ ঃ বিবাহের পর যদি কোন কারণে ছাড়া-ছাড়ি হইয়া যায় তবে- স্বামীর কাছ থেকে দেন-মোহরানার ব্যবস্থা করেছে ইসলাম৤ স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাহার স্বামীর কিছু অংশেএবং পিতার ও কিছু অংশ পাবে এই ভাবে সে ছেলে-মেয়েদের চাইতে বেশি সম্পদের অধিকারী হতে পারে৤ সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম৤ ইসলাম বলেছে মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত৤

মুজুরের অধিকার ঃ ইসলাম গরীব দিন মুজুরের অধিকার নিশ্চিত করেছে৤ আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন “চুক্তি বদ্ধ দাস খাদ্য পাইবে এবং যে কাজ তার সাধ্যে না কুলায় উহা তাহাকে তরিতে দেয়া যাইবে না৤বর্ণনায়ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রা.)৤

রাসূল (সা.) বলেন “ শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার পাওনা মিটিয়ে দাও৤ “তোমাদের দাস-দাসীর মধ্যে যে তোমাকে মান্য করে, তোমরা যা ভক্ষন কর তাহাকে তা ভক্ষন করতে দাও৤ তোমরা যা যাহা পরিধান কর তাহা তাহাকেও পরিধান করিতে দাও৤ উহাদের মধ্যে যে তোমার অবাধ্য হয় তাহাকে বিক্রয় কর কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টকে শাস্তি দিও না৤ বর্ণনায় ঃ হযরত আলী (রা.)৤

প্রতিবেশীল অধিকার ঃ রাসূল (স.) বলেছেন “ প্রতিবেশী যাহার অনিষ্ট হইতে নিরাপদ নহে, সে বেহেশতে প্রবেশ করিবেনা৤ মুসলিম বর্ণনায় ঃ হযরত আনাস (রা.)৤ রাসূল (সা.) বলেন “ তোমরা যখন তরকারী রান্না কর, তাহার সরুয়া বা ঝোল বৃদ্ধি করিও এবং তোমার প্রতিবেশীগণকে উহা হইতে কিঞ্চিত দিও৤ মুসলিম (বর্ণনায় ঃ হযরত আবু জর (রা.)৤

উপসংহার ঃ মানুষের কল্যাণে ইসলাম এত সুন্দর এবং বৈজ্ঞানিক ফায়সালা দিয়েছে তা এক বিষ্ময়কর ব্যাপার৤ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের তাঁর পথে ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে চলার তৌফিক দান করুন৤

১. স্বাধীনতার ঘোষণা ও বাংলাদেশ

অধ্যাপক আব্দুর নূর (অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

২. The Republic- Plato

৩. তাফহীমূল কোরআন-সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

৪. রিয়াদুস সালেহীন

৫. এন্তেখাবে হাদীস

৬. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা,

বিষয়: বিবিধ

৫২১২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

240446
০১ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:২৬
মাটিরলাঠি লিখেছেন :
Rose Rose Rose Rose
অসাধারণ লেখা প্রয়োজনীয় সকল রেফারেন্স সহ।
241179
০৩ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৭:৫৩
টাংসু ফকীর লিখেছেন : জনাব বহুত বহুত শুকরিয়া৤ আপনি কষ্ট করে পড়েছেন এই জন্য আদি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ৤ আল্লাহ আমাদের ঈমানী শক্তি দিয়ে সকল প্রকার তাগুতকে প্রতিহত করার তৌফিক দান করুন৤

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File