আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক সংকট

লিখেছেন লিখেছেন টাংসু ফকীর ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৭:০৫:২৯ সকাল

বর্তমান বিশ্বে বা বিশ্ব পরিস্থিতিতে একটা জিনিস পরিস্কার যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক দিয়ে মুসলিম বিশ্বের চেয়ে পশ্চিমারাই বেশি উন্নত৤নীতি নৈতিকতার দিক দিয়ে না হোক অন্নতঃ প্রযুক্তি, কলা-কৌশলের দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে উন্নত এবং সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উৎপেতে আছে৤অথচ এটা হওয়ার দরকার ছিল বা প্রাপ্য ছিল মুসলমানদের৤ যদিও ইসলামী সোনালী যুগের শত শত মুসলিম বিজ্ঞানীর তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে আজ পশ্চিমারা নাচা নাচি করছে৤ আজ বিশ্বের প্রায় সব মুসলমান চরম ভাবে ব্যর্থ৤ মুসলমানদের শাসন ক্ষমতা হাত ছাড়া হওয়ার পর আস্তে আস্তে তাদের ধস নামতে শুরু করে এবং বর্তমান বিশ্বের অবস্থাত সবার জানা৤ কিন্তু বর্তমান বিশ্বের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, যতগুলি মূল সমস্যা তার অন্যতম সমস্যা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট৤ যা মুসলমানদের জন্য ভয়ানক সমস্যা৤এখন দেখা যাক শিক্ষা কি? বিভিন্ন মনীষী এটাকে বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করেছেন৤

মহাকবি ‘ইকবালে’র মতে, ‘‘মানুষের খুদীর উন্নয়নই হলো আসল শিক্ষা৤’

রবীন্দ্রনাথের মতে ঃ ‘‘অভ্যন্তরের আসল মানুষটির পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর নামই শিক্ষা-যাকে তিনি শেষের কবিতায় পরশ-পাথর বলে অভিহিত করেছেন৤

মহা কবি ‘’মিল্টনের’ মতেঃ Education is the harmonious development of body mind and soul. ইত্যাদি৤

এখন আমাদের কথা হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কি রূপ? উপরোক্ত সংজ্ঞার সাথে আদৌ কোন মির আছে কি না৤ আদর্শ হল কোন কাজের বা পরিকল্পনার বা সূত্রের গুণাগুণ৤ তা অবশ্যই সৎ ও সত্যনিষ্ঠ হতে হবে৤ শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী হবে এটাই স্বাভাবিক৤ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক আমলের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার ফসল৤ ধর্মনিরপেক্ষতার সাজে সাজানো এমন কতকগুলো উপাদানে ম্যাকলে তৈরী করেছেন ভয়ানক এক শিক্ষা ব্যবস্থা, যার কারণে আমরা আজ মুসলিম নামধারী শিক্ষাবিদের (!) মুখ থেকে ধর্মহীন শিক্ষার কথা শুনি আর তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আজও নিলর্জ্জভাবে মেনে চলেছি৤ কিন্তু জেনে রাখা দরকার এ শিক্ষা ব্যবস্থা যখন প্রবর্তন করা হয় ১৬০ বছর আগে, তার কিছু দিনের মধ্যে মুসলমানরা এটাকে অগ্রাহ্য করলে, বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে Sir William Hunter কে assessment করতে দেয়া হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন ``The truth is that our system of public instruction is Opposed to the tradition unsuited to the requirement and hateful to the religion of mussalman.

কিন্তু অত্যন্ত এবং ভয়ানক লজ্জার বিষয় সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা পড়াশুনা করছি৤এই শিক্ষা ব্যবস্থা আদর্শ বিবর্জিত হওয়ায় আমরা আজ পদে পদে মার খাচ্ছি৤ মুসলমানরা যাতে মাথা তুলি দাড়াতে না পারে এবং চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়, সেই জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছিল৤ আদর্শ বর্জিত হওয়ার কারণে আমাদের ছেলে মেয়েরো কোন নৈতিকতা শিখতে পারছেনা৤ পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের মত এত নৈরাজ্য, আর বিশৃংখলা আর কোথাও নেই৤ সেশন জট, সন্ত্রাস, হানা-হানি, টেন্ডারবাজি, খুন-খারাবি, অপসংস্কৃতি সর্বোপরি, সহ-শিক্ষার কুফলে শিক্ষাজীবন অতিষ্ঠ৤ বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত নৈরাজ্যকর পরিবেশ অন্যান্য অমুসলিম দেশেও নেই৤ তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশের চাইতে আমরা অনেক দিক দিয়েই পিছিয়ে আছি৤ তাছাড়া শিক্ষার বৈষম্য৤ সরকারী-বেসরকারী, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, এবতেদায়ী, কওমী সবমিলিয়ে এক জগাখিচুরী অবস্থা৤ আদর্শহীনতার কারণে আমরা মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত, ফলে নিজ দেশসহ সারা বিশ্বে মুসলিমরা অবহেলিত, লাঞ্ছিত৤

পাকিস্তান আমলে বিশিষ্ট শিক্ষা বিদ নূরখান কর্তৃক একটি প্রস্তাব দেয়া হয়, সেখানে বলা হয়েছিলঃ Pakistan must aim at Ideological unity not at Idelogical vacuum; it must impart a unique and integrated system of education. When can impart a common set of cultural values based on the precept of Islam.

কিন্তু তথাকথিত সেক্যুলারিষ্টদের জন্য আমরা আজ সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠছি৤ সেই উইলিয়াম হান্টার গংদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা যেন আমাদের কাছে দুধ-ভাত৤ উইলিয়াম হান্টার বলেছেন -‘‘ আমরা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা করে যাচ্ছি যারা রক্তে মাংসে হবে উপমহাদেশীয় কিন্তু মনে প্রাণে হবে পাশ্চাত্য৤ কি আশ্চর্য , আমরা কিন্তু ঠিক তাই হচ্ছি৤ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কি পরিমাণ দূষণ হয়েছে তা আজ প্রতিটি সুস্থ্য নাগরিক মাত্রই জানেন৤ তবে কথা থাকে যে, কথিত সেক্যুলারিষ্টরা শিক্ষা থেকে ধর্মকে বা আদর্শকে মুক্ত রাখার যে কৌশল প্রয়োগ করে বা যাকে নিয়ে হৈচৈ করে তা তাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক৤

সমাজ বিজ্ঞানে বা নীতি বিজ্ঞানের বিচারে ভাল হোক বা মন্দ হোক দুটোই আদর্শ বা মতবাদ৤ সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা লিবারেল বা সেক্যুলার হলেও তা কোন না কোন আদর্শের অনুসারী হবে৤ তা কখনোই আদর্শমুক্ত হতে পারে না৤ পাশ্চাত্য দালালেরা শুধুমাত্র তাদের প্রভুদের পা চাটার জন্য, নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, কায়েমী স্বার্থের জন্যে এই ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে নিরলস কাজ করে যায়৤

আল্লাহর এই জমিনে আল্লাহর শিক্ষা বাস্তবায়িত হবে এই উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালের ১৫ই আগষ্ট আবদুল মালেক তার তাজা রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে দেন বাংলার এই জমিন৤ তিনি জানতেন যে, ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা ছাড়া কোন অবস্থাতেই শান্তি আসবে না৤ মুসলমান জাতি আত্ন-বলে বলীয়ান হতে পারেনা৤ এভাবে চলতে দেয়া যায়না৤

পাশ্চাত্যের নিরেট বস্তুবাদী এবং লিবারেলজম দ্বারা রচিত শিক্ষার কুফল হাড়ে-হাড়ে উপলব্ধি করার পর বিবেকবান মানুষের যে আর্তনাদ শুনতে পাই তাতে মনূষ্য সমাজের সকল স্তরের লোকদের উচিৎ শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা৤তারপরও কিভাবে সেক্যুলার শিক্ষার কথা বলে?

ড. আলেক্সিজ ক্যারেল বস্তুবাদী শিক্ষার কুফল প্রত্যক্ষ করার পর আফসোস করে বলেছেন- ÔÔ To Day the most neglected field of study is poor man. পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত এ জন Social Philosopher এবং Educationist তার ‘‘The teaching of reverence’’ for life গ্রন্থে Three kinds of Progress are significant. Progress in Knowledge and technology. Progress is socialization of mankind, and progress in spirituality, the last one is the most important. তিনি বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তার জন্য Turning Point-এ শিক্ষাকে Ideologically করার চেষ্টা করতে বলেছেন৤ এই ক্ষেত্রে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন-’Our age must achieve spiritual renewal. A new renaissance in which mankind discovered that ethical action is the supreme truth and the supreme utilitarism by which mankind will be liberated.” এই Spiritual Liberation ছাড়া যে Mankind এর কোন Liberation হতে পারে না এটা তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন৤

পৃথিবীর সব দেশেই আদর্শিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে৤ অবশ্যই তা তাদের নিজ ধর্মের নির্দেশিত পথ অনুসারে৤তথাকথিত সেক্যুলার দেশ বৃটেনে তাদের শিক্ষার সাথে Worship বাধ্যতামূলক এবং আশ্চর্যের বিষয় বৃটেন সেক্যুলার বলে নিজেকে দাবি করলেও পৃথিবীতে সর্ব প্রথম তারাই ব্লাসফেমী আইন চলু করে৤ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখলে স্পষ্ট দেখা যায় তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হিন্দুয়ানী বাড়া বাড়ি রকমের প্রাধান্য৤ এটাই স্বাভাবিক৤ তারা তাদের জাতির চিন্তা চেতনার বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে৤ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমরা শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষায় কোন ইসলামী মূল্যবোধের ছাপ রাখতে পারিনি৤ যদিও এখানে হওয়া উচিৎ ছিল ইসলামী শিক্ষা৤ পাখির মত বুলি কপচিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবি নামি চামচা নাস্তিক্যবাদীতায় বিশ্বাসীরা ইসলামকে ভয় পায়৤

মিল্টনের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেখানেও আদর্শের কথা বলা হয়েছে৤বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের মতে ‘ শুধুমাত্র সু-শিক্ষাই জ্ঞান৤অশিক্ষা কখও জ্ঞান হতে পারেনা৤ মানুষ শিক্ষা লাভ করে যদি মানুষের কল্যাণই না করতে পারল তবে সেই শিক্ষা দিয়ে কোন উন্নতি হতে পারেনা মানব জাতির৤ মনীষীরা বলেছেন দুর্জন বিদ্ব্যান হলেও পরিতাজ্য৤ সর্পের মাথায় মণি থাকিলেও সে কি বিষধর নহে? সুতরাং আত্নিক উন্নয়নের জন্য আদর্শিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিৎ৤ মানুষের যখন আত্নিক উন্নতি হয় তখন সে শান্তি-প্রশান্তি লাভ করে৤ ফলে তার দৈহিক উন্নতি সাধিত হয়৤ সে সকল কাজে উৎসাহিত হয়ে নতুন রূপে কাজে মনোযোগ দিতে পারে অন্য ভূবনের মুক্তির আশায়৤ আদর্শিক সংকটের কারণে মুসলমানদের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে শত শত বছর ধরে তার থেকে বাহির হওয়ার এক মাত্র পথ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য সকল প্রকার সহযোগীতার পথ প্রশ্বস্ত করা৤

২৮শে এপ্রিল, ২০০৫ইং সালে দৈনিক ইনকিলাব এ প্রকাশিত৤

বিষয়: বিবিধ

১৬২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File