দুর্ণীতিতে শিক্ষক

লিখেছেন লিখেছেন টাংসু ফকীর ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৩:৩১:৪২ রাত

এক.

বর্তমান সময়ে একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় দুর্ণীতি৤ মন্ত্রী-মিনিষ্টার, এমপি, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, আমলা, কামলা, বন রক্ষক, পুলিশ, ব্যবসায়ী, বিচারক সহ মোটামুটি সব সেক্টরেই দুর্ণীতির করাল গ্রাস আচ্ছন্ন করে রেখেছে৤ আর নির্বিঘ্নে সবাই অবৈধ ভাবে সরকারী সম্পদ, বেসরকারী সম্পদ গ্রাস করে যাচ্ছে৤ কিন্তু জাতীর মেরুদন্ড বলে পরিচিত একটি সেক্টর ‘শিক্ষা’- এখানে যে দুর্ণীতির পাহাড় গড়ে আছে সে দিকে কেউ খুব একটা নজর দেয় না৤ কারণ জাতীয় জীবনের দুর্ণীতির বীজ বপন করা হয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে৤ দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার যত গুলি ধাপ আছে সব গুলো ধাপেই দুর্ণীতি আচ্ছন্ন করে রেখেছে৤ সরকারী-বেসরকারী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবখানেই একই অবস্থা তবে দেশে সকল সরকারী কলেজ গুলো যেহেতু জনগণের সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে তাই উচ্চ মাধ্যমিক সেক্টরে সরকারী কলেজের কথা আজ আমি আপনাদেরকে শুনাব৤

কলেজ শিক্ষা একটি জাতির টার্ণিং পয়েন্ট৤ ভবিষ্যতে কোন একটি ছাত্র কোন পেশায় নিয়োজিত হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে এই কলেজ শিক্ষার উপর৤ কিন্তু আমাদের কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্ণীতি এতটাই ভয়াবহ যে পুলিশ কিংবা বন খেকো, তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়৤ এখানে প্রধান ব্যবসা হচ্ছে প্রাইভেট৤ বিশ্বাস করুন আর নাই করুন ক্লাশের ধার ধারেন না কোন শিক্ষকই৤ তাদের প্রত্যেকের বাসা যেন এক একটি স্কুল৤ সেখানে দেয়ালে টানানো হয়েছে সাদা বোর্ড আর বিশ হইতে পঁচিশ জন ছাত্র- ছাত্রী এক সঙ্গে বসে রীতি মত ক্লাশ করে বাসায়৤ কলেজ শুধু নামে মাত্র৤ এই ব্যবসার জন্য কোন শিক্ষক যে কত নীচে নামতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা৤ কোন স্যারের কত জন ছাত্র, কার কাছে পড়ে কত নম্বর পেয়েছে, কে কি ভাবে পড়ায় শুধুমাত্র এই আলাপ শিক্ষকদের মধ্যে৤

আমাদের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক সুরুজ্জামান স্যারের বাসায় ৫ কেজি মিষ্টি নিয়ে গেলে যা খুশী হন তার বেশি খুশী হন দুইজন ছাত্র নিয়ে গেলে৤ স্যার এই দুইজন ছাত্র আপনার কাছে প্রাইভেট পড়বে৤ একটু খেয়াল রাখবেন৤ কে কিভাবে কত বেশি ছাত্র ধরতে পারবে সেই চিন্তা করেন সদা সর্বদা এবং এদের মধ্যে আবার সিন্ডিকেট থাকে৤ যেমন পদার্থের একজন, গণিতের একজন , হিসাব বিজ্ঞানের একজন উনারা এই ভাবে সিন্ডিকেট করে যে , আমার কাছে পদার্থ পড়বে আপনার কাছে গণিত আর আপনার কাছে হিসাববিজ্ঞান৤ এই ভাবে একেক বিভাগের শিক্ষক আর এক বিভাগের শিক্ষকের সাথে , অনেকটা রিলে দৌড়ের মত সিন্ডিকেট করে প্রাইভেট পড়ায়৤ আবার টাকা কালেকশনের বেলায়ও এই সিন্ডিকেট কাজ করে৤ এতে করে অনেক সময় দলাদলি আর মনোমালিন্যও হয় তাতে অবশ্যই শিক্ষকদের কিছু আসে যায় না৤ অবশ্যই সব বিষয়ে সমান প্রাইভেট থাকে না৤ মানবিক কিংবা বাণিজ্যে তুলনামূলক প্রাইভেট কম৤ বেশির ভাগ প্রাইভেট পড়ে এমন বিষয় গুলো হল ইংরেজী, অর্থনীতি, যুক্তিবিদ্যা, হিসাব বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা ইত্যাদি৤ মনে করুন একটি বিভাগে চারজন শিক্ষক আছে৤ প্রাইভেটের জন্য সকল শিক্ষকই উদগ্রীব থাকে সে অধ্যাপক কিংবা সহযোগী অধ্যাপক যাই হোক না কেন৤ সহযোগী অধ্যাপক একটি কত বড় সম্মান জনক পদ কিন্তু প্রাইভেট বাণিজ্যের জন্য তাদের একথা মনে থাকেনা৤ ক্রমানুসারে অধঃস্তন শিক্ষকদের ছাত্র দিতে নারাজ৤ তাই তারা তখন ছাত্র ধরতে অন্য ধান্ধা করে৤ প্রায় সকল শিক্ষকই একই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন৤ ছাত্রদের কাছ থেকে কিভাবে টাকা আদায় করা যায় সেই চিন্তায় সদা ব্যস্ত৤ কত ভাবে যে শিক্ষকরা দুর্ণীতিতে আক্রান্ত তার কিছু নমুনা দেখুন৤

প্রাইভেট বাণিজ্যই সব চেয়ে স্থায়ী বাণিজ্য৤ আমার এক বন্ধু একটি বড় সরকারী কলেজে মাত্র যোগদান করেছে৤ ঠিক দুইদিনের মাথায় সে হিসাব করছে বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র মোট ৩০০৤ শিক্ষক হল ৪জন৤ ভাগে পাবে ৭৫জন৤ কিন্তু কোন মতে ছাত্র যদি পাই ১০০, তবে ৩০০০টাকা করে মোট ৩লাখ৤ দুই সেশনে ৬লাখ৤ দুই বছরে ঢাকা শহরে বাড়ী আর জেলা শহরে একটি বাড়ী৤ আর যদি কোন মতে এক দুই জন ছাত্র কম বেশী হয়ে তবেত মাথা মনে করুন খারাপ৤

একবার হল কি ? বদলী আর পদোন্নতি জনিত কারণে শিক্ষক সব বদলী হয়ে গেল আর সে রইল একা, মাবুদে এলাহী আর যাস কই৤ সব ছাত্রই আমার৤ ৩০০+৩০০= ৬০০৤ চারদিকে শুধু টাকা আর টাকা৤ ছাত্রের পর ছাত্র ৤ পড়াতে পড়াতে মাথা নষ্ট৤ ছাত্রদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার৤ যা তোর মত ছাত্রের আমার দরকার নেই৤ এত টাকা দিবি৤ আর টাকা কই? বাপের কাছ থেকে টাকা এনে বিড়ি খাও ৤ ইত্যাদি, ইত্যাদি৤ সে এক দারুন মহাকাব্য৤

সকাল বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ঢল নামে৤ পাখ-পাখালীদের পদচারণায় মুখরিত হয় পাড়া মহল্লার রাস্তা ঘাট৤ যেন আরেক কলেজ চলছে শিক্ষকের বাসায়৤ আর ছাত্র-ছাত্রীরা এ বাসা থেকে পড়ে ও বাসায় যায়৤ কি মজা! দিনে চারটা পাঁচটা প্রাইভেট৤ ব্যস্ত আর ব্যস্ত৤ কলেজে গেল কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয় নয় প্রাইভেটে গেল কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়৤

প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধ করতে না পারলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে পর্যায়ে পৌছেছে তার থেকে মুক্তির কোন সম্ভবনা নেই৤

পরীক্ষা কমিটিঃ কমিটি বাণিজ্য, কলেজের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য৤ এটা সাধারণের চিন্তার বাইরে৤ একটি কলেজের শিক্ষকেরা কি পরিমাণ বাণিজ্য করে তা অনেক পুলিশ অফিসারও চিন্তা করতে পারেনা৤ পরীক্ষা কমিটিতে সাধারণত সিনিয়র শিক্ষকেরা থাকে আর জুনিয়রদের মধ্যে যে যত বেশী অধ্যক্ষকে তেল দিতে পারবে সে থাকতে পারবে কমিটিতে৤ সাধারণতঃ মানবিক কিংবা বাণিজ্যের শিক্ষকদের যেহেতু প্রাইভেট বাণিজ্য কম সুতরাং তারাই অধ্যক্ষকে তেল বেশী করে দিয়ে কমিটিতে থাকার চেষ্টা করে৤ বিজ্ঞানের শিক্ষকের প্রাইভেট বাণিজ্য বেশী থাকায় তারা এই দিকে মনোযোগ একটু কম দেয়৤ একটি বছরে কমিটিতে থাকলে মোটামুটি ৮০ হাজার থেকে ১লক্ষ টাকা ভাগে পায়৤ কলেজ বিশেষে এটা আরো বেশী হয়ে থাকে৤ যেমনঃ ঢাকা কলেজ কিংবা তেজগাঁও কলেজের একজন শিক্ষক কিংবা অধ্যক্ষ কি পরিমাণ আয় করে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেবনা৤ তারা প্রতিমাসে ২ থেকে ৩লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতন নিয়ে থাকে৤ ভাবতেও অবাক লাগে৤ বিভিন্ন পরীক্ষা থাকে বিভিন্ন সময় অর্থ্যাৎ প্রায় প্রতি মাসেই কোন না কোন পরীক্ষা থাকে৤ একাদশ, দ্বাদশ অনার্স কিংবা মাস্টার্স বিভিন্ন বর্ষের বিভিন্ন পরীক্ষা বিভিন্ন কমিটি আর লুটপাট৤ কোন বর্ষের হয়ত ভর্তি আর কোন বর্ষের হয়ত বার্ষিক পরীক্ষা৤ কোন না কোন কমিটিতে শিক্ষকরা থাকবে আর টাকা আর টাকা৤ পুলিশের চাইতে যা অনেক বেশি৤

ক্লাশ ঃ এক জন প্রভাষকের সপ্তাহে কম পক্ষে ২৪টি ক্লাশ নেওয়ার কথা থাকলেও অবিশ্বাস্য ভাবে পুরো একবছরেও তারা ১২টি ক্লাশও নেয় না৤ তা ছাড়া ক্লাশে গিয়ে গড়াশুনা বা বিষয় বস্তুর দিকে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই৤ সব সময় চিন্তা একটা কি ভাবে নিজেকে ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়?

এক ক্লাশের ভাতা ২০০০টাকাঃ আমার এক বন্ধু আছে সে একটি কলেজের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক৤ মাসে বড় জোড় সে দুই দিন যায় শুধুমাত্র হাজিরা দিতে৤ মাসে সে ১০,০০০ টাকা বেতন পায়৤ দুই দিনে ডিগ্রি- উচ্চ মাধ্যমিক মিলিয়ে মোট ৫টি ক্লাশ নেয় তাতে তার প্রতি ক্লাশের ভাতা পড়ে ২০০০টাকা৤ আর সরকারী কলেজের শিক্ষকের একেক ক্লাশ সময় ভেদে ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা পড়ে৤ কারণ বিভিন্ন সময়ে মারা-মারি, পরীক্ষা, হরতাল, ধর্মঘট ইত্যাদির ফলে বাৎসরিক ক্লাশের সংখ্যা দাড়ায় ১০ থেকে ১২টি৤

ভর্তি কমিটি ঃ কলেজ বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য হচ্ছে ভর্তি বাণিজ্য৤ বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া নির্ধারিত ‘ফি’র ধার-ধারেনা কেউ৤ তাদের ইচ্ছে মত ‘ভর্তি ফি’ আদায় করে থাকে৤ অধ্যক্ষের পছন্দমত কিংবা তোষামোদে অগ্রগামী শিক্ষকেরা এই বাণিজ্যে অগ্রাধিকার পায়৤ এক জন শিক্ষক ভর্তি কমিটিতে থাকা মানে প্রায় ১ থেকে ১.৫ লক্ষ্য টাকার ভাগ পাওয়া৤ ছাত্রদের কাছ থেকে একেবারেই ইচ্ছামত এবং অনেকটা জোড় জবরদস্তি করে ফি আদায় করা হয়৤ নানান ধরণের খাত লিখে একটা ফর্দ তৈরী করা হয়৤ উন্নয়ন খাত, মসজিদ, মিলাদ, যদিও কোন দিন কোন অনুষ্ঠান হয় কিনা সন্দেহ৤ আমাদের কলেজের ছাত্র সংসদ একবার ২৫কেজি জিলাপী কিনে ভাউচার করল ৮মনের৤ শিক্ষকের সাথে ভাগ-ভাটোয়ার করে টাকা খেয়ে ফেলল৤ তখন আপ্যায়ণ সম্পাদক বলল এতগুলো ছাত্রের মধ্যে ২৫ কেজি জিলাপী হবে না ত স্যার৤ স্যার বললেন শোন ঘটনা হল যখন মিলাদ শেষের পথে তখন তোমরা নিজেরাই একটা প্রীতি মারা-মারির আয়োজন করবে, তাতে সব ছাত্র-ছাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে পালাবে আর কিছু জিলাপী নষ্ট হবে আর সবাই বলবে মারা-মারির জন্য জিলাপী খেতে পারলাম না৤ ভর্তি রশিদ দেখলে মনে হবে সে একটা বিশাল উন্নয়ন, এইবার আর কলেজের উন্নয়ন কেউ আটকাতে পারবেনা৤ অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এর পুরো টাকাটাই কলেজ কর্তৃপক্ষ ভাগ ভাটোয়ারা করে খায়৤ এক জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যদি ৩০০০ টাকা ফি নেয়া হয় তবে সেখানে দেখা যাবে বোর্ড ফি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০টাকা বাকীটা নিজেদের পকেটে৤ এটা সব সরকারী কলেজে অবস্থা৤ কলেজ ভেদে আরো করুন অবস্থা৤ বড় বড় কলেজ গুলোতে তো মাফ নেই৤ সেখানে ভাগের টাকা যাতে কম না পড়ে সেই জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করা হয়৤ এবং একাউন্ট সম্পূর্ণ আলাদা৤ ভাব দেখলে মনে হয় কত না শৃংঙ্খলা, আর মেশিনের মত সবাই টাকা জমা দিয়ে যাচ্ছে৤ ঝিম ঝাম ভাবে ফান্ডে টাকা জমা হচ্ছে৤ ব্যাংক থেকে কমিটি টাকাটা তুলে সুন্দর ভাবে ভাগ করে নিয়ে নিল৤ কেমন সুন্দর নিয়মে আর নিরবে নিভৃতে অনিয়ম গুলো নিয়মে পরিণত হয়েছে, চিন্তারও বাইরে সাধারণ মানুষ৤

যে খাতের কথা বলে ফি নেয়া হয় দেখা গেছে কোন দিনই সে খাতে টাকা আর জমা হয় না৤ অনেক খাতের কথা কমিটির লোকও জানেনা৤ এই ভাবে সাধারণ ছাত্র, গরীব বা অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার পথকে প্রতি নিয়ত সংকুচিত করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে শিক্ষক নামের এই দুর্বৃত্তের দল৤

ডিউটি বাণিজ্য ঃ পরীক্ষা কমিটি নামে একটি কমিটি আছে যারা সাধারণত এই ডিউটি বাণিজ্যের সাথে জড়িত৤ অত্যন্ত নিলর্জ্জ ভাবে পরীক্ষা কমিটি এই টাকা আত্নসাৎ করে৤ কি ভাবে করে? শুনুন তবে৤ মনে করুন একটি সরকারী কলেজে নতুন পুরাতন মিলিয়ে প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার পরীক্ষার্থী থাকে উচ্চ মাধ্যমিকে৤ কলেজের সব শিক্ষক ডিউটি দিলেও পরিদর্শক কম পড়ে৤ তখন ছোট-খাট কলেজ সাধারণত বে-সরকারী কলেজে থেকে শিক্ষক ভাড়া করে আনে৤ পরিদর্শকদের জন্য বরাদ্দ থেকে তারা নিজেরা করে চুরি আর তাদের নিজেদের কলেজের শিক্ষকদের দেয় এক রকম, আর ভাড়া করা শিক্ষকদের দেয় কম৤ এখান থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়ে নেয়৤ ভাড়া করা বে-সরকারী কলেজের শিক্ষকদের যা দেয় তাতেই তারা খুশি৤ যেখানে ৫জন পরিদর্শক দরকার সেখানে ২জন শিক্ষককে দিয়ে কাজ সারিয়ে নেয়৤ আর বিল করে ৫ জনেরই৤ আরো কত কি? ছটের কি আর ছলের অভাব?

প্র্যাকটিক্যাল বাণিজ্য ঃ এই বাণিজ্যটা অত্যন্ত দুঃখজনক, অমানবিক এবং অত্যন্ত ক্ষতিকারক৤ কত ছাত্রের জীবন যে নষ্ট করেছে শিক্ষক নামের কলংকরা৤ তার কোন ইয়ত্তা নেই৤ এক জন শিক্ষক প্রাইভেট বাণিজ্যের জন্য ব্যবহারিক পরীক্ষাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে৤ আমার কাছে প্রাইভেট পড়বি নইলে ব্যবহারিকে দিমু ২৫ এ ৮৤ বুঝ মজা৤ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে চলে প্রতিযোগীতা৤ কে কত জন পড়ালো, কার ছাত্র কত জন? এটাই হল বড় আলোচনার বিষয়৤ এক জনের ছাত্রকে আরেক জন শিক্ষক বলতে গেলে পাত্তাই দেয় না৤ শিক্ষকের কাছে সব তথ্যই থাকে৤ ব্যবহারিকের আগে টাকা না দিলে ব্যবহারিক পরীক্ষায় দিবে ০৭ নম্বর৤ এক দিনের জন্য পড়তে গেলেও দিতে হবে কোর্সের পুরো টাকা৤ সম্পূর্ণ ক্লাশ জুড়ে নিজের বাহাদুরী ফরমান৤ পড়ানোর জন্য নানান ফন্দি ফিকির৤ আমার একজন শিক্ষক ছিলেন বিমল চন্দ, যিনি উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক৤ তিনি দীর্ঘদিন একই কলেজে ছিলেন৤ একবার তাকে বদলী করা হলো কুমিল্লায়৤ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছিল তখন৤ তার প্রাইভেটের টাকা আদায় বাকী অনেক, মাথা মনে করেন খারাপ৤ কুমিল্লায় যোগদান করে এসে ঢাকা বোর্ডে যেয়ে বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে আসলেন শুধুমাত্র প্রাইভেটের টাকা আদায় করার জন্য৤ সাধারণ ভাবে ত্বত্তীয় পরীক্ষা শেষে শিক্ষাবোর্ডে আবেদনের প্রেক্ষিতে বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কলেজে বহিরাগত পরীক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকেন৤ সরকারী কলেজের বিভিন্ন শিক্ষক যারা সাধারণত প্রাইভেট ব্যবসায় জড়িত, তারা বোর্ডে যেয়ে তদবিরের মাধ্যমে নিজেরা পছন্দীয় কলেজে যান অথবা তাদের কলেজে বহিরাগত পরীক্ষক নিয়ে আসেন আপোষ রফা করার জন্য৤ যাতে ইচ্ছে মত ব্যবহারিক নম্বর দেয়া যায় আর তাতে প্রাইভেট বাণিজ্য ঠিক থাকে৤ সে এক দারুণ এবং ভয়ানক অভিজ্ঞতা প্রাইভেটের ইতিহাসে৤ আমি এক জন শিক্ষককে চিনি, তিনি প্রাণীবিদ্যার প্রভাষক, তার বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক যিনি তিনিই মূলতঃ সব ছাত্রদের ব্যবহারিক পরীক্ষার ভয় দেখিয়ে নিজের বগলদাবা করে রেখেছেন৤ যার কারণে সেই প্রভাষক সাহেব কোন প্রাইভেটের সুযোগ পান না৤ মাথা আল্লাহর রহমতে খারাপ৤ চিন্তায় অস্থির কিভাবে টাকা কামানো যায়? এক দিন আসল সুযোগ৤ কম্পিউটার শিক্ষা পড়াতেন অর্থনীতি বিভাগের এক জন শিক্ষক৤ সুযোগ হল তার এলাকার উপাধাক্ষ্য কলেজে যোগদান করলে তার ক্ষমতা যায় বেড়ে আর কম্পিউটার শিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব পেয়ে যায়৤ এই বার কোটি পতি হওয়ায় অদম্য ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার পথে৤ ক্লাশে গিয়েই ঘোষণা আমার কাছে প্রাইভেট পড়লে প্র্যাকটিক্যালে পূর্ণ নম্বর আর না পড়লে ফেল৤ অথচ কম্পিউটার পড়ানো দূরের কথা, কম্পিউটার খুলতেও পারেন না৤ ছাত্ররা একটি প্রশ্ন করলে তার জবাব না দিয়ে ধমক দেয় তুই বেশি বুঝস৤ ক্লাশে একদম বেশি কথা বলবি না৤ বিষয় বস্তু বাদ দিয়ে অন্য পেচাল দিয়েই ক্লাশ শেষ৤ অনেক ছাত্র এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ , উপাধাক্ষ্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও কোন প্রতিকার পায়নি কারণ তারাও এর ভাগ পায়৤ ছাত্ররা অসহায়ের মত টাকা দিয়ে নম্বর কিনে নিত৤ ছাত্রদের জিম্মি করে ডাকাতের মত টাকা আদায় করত৤ পড়ুক আর না পড়ুক৤ ‘পিস্তল আটকিয়ে টাকা নেওয়া আর ব্যবহারিক পরীক্ষার ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়া একই কথা৤’

উন্নয়ন বাণিজ্যঃ কলেজের উন্নয়নের খাতের টাকা কিভাবে ভাগ বাটোয়ারা করে খায় তার হিসাব সবার জানা৤ কোন বিল্ডিং, রাস্তা, কোন অবকাঠামোর উন্নয়নে ছাত্রদের সাথে মিলেমিশে এক সাথে থাকে, এক সাথে ভাগ ভাটোয়ারা করে৤

বিভিন্ন ফি বাণিজ্য ঃ কলেজ কর্তৃপক্ষ এক জন ছাত্রের কাছ থেকে কত ভাবে যে টাকা আদায় করে তার ইয়ত্তা নেই৤ এটা শুধু সুদী কারবারীদের সাথেই তুলনা করা যায়৤ ভর্তির সময় নানান ফর্দের টাকা, তিন মাস পরে ত্রৈমাসিক পরীক্ষার ফি, বর্ষ সমাপনী পরীক্ষার ফি, ফরম ফিলাপ, নতুন বর্ষের সেশন চার্জ, পিকনিক, শিক্ষা সফর, বন্যা দুর্গতদের সাহায্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ল্যাব চার্জ ইত্যাদি হাজারো খাতের নামে ফি আদায় করা হয়৤

ছাত্রদের বিভিন্ন দলের লেজুর বৃত্তি, ছাত্র সংসদ , মিছিল, মিটিং মূলতঃ শুরু হয় যেই মাত্র কলেজে ভর্তি হয় ছাত্ররা৤ আর এখানে শিক্ষকেরা ই তাদের জীবনের টার্ণিং পয়েন্টে যত অসততার শিক্ষা দিয়ে দেয়৤কারণ শিক্ষকেরাও করে লেজুর বৃত্তি৤ ভাল পোষ্টিং, এলাকায় থাকা, নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য ঠিক রাখা, প্রভাব বিস্তার করা ইত্যাদি কারণে তারা ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ রাখে৤

ছাত্র সংসদ নামে আছে আমাদের কলেজ গুলোতে অনন্য এক ছাত্র প্রতিনিধির আসন, যাদের কাজই হল বিভিন্ন ভাবে বখরা খাওয়া৤ শাসক দলের হলে তো কথাই নেই৤ টেন্ডার হতে শুরু করে ভর্তি বাণিজ্য, উন্নয়ণ বাণিজ্য, ইলেকশন বাণিজ্য আরোও কত কি? বিদ্যালয় আহা বিদ্যালয় সে যেই পর্যায়েরই হোক না কেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়, মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানে, মানুষ গড়ার কারিগরদের যদি এই অবস্থা হয় তবে আমরা কোথায় যাব?

২৯শে আগষ্ট,২০০৭ইং

বিষয়: বিবিধ

২১১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File