সেই যে ছোঁয়া

লিখেছেন লিখেছেন টাংসু ফকীর ০৬ আগস্ট, ২০১৩, ০১:৫১:৪৩ রাত

সন্ধ্যায় কালু মামা ফোন দিয়ে বলল, বাস ছাড়বে বকুলতলা থেকে ঠিক সকাল সাতটায়৤ একটুও যেন দেরী না হয়৤ ঠিক সাতটায় বকুলতলায় হাজির হলাম৤ তুহিন মামা সফেদ পাঞ্জাবী পড়ে আসছে যা সুন্দর লাগছে! কালু মামাও সুন্দর হাতের কাজ করা একটা পাঞ্জাবী পড়েছে তাকেও সুন্দর লাগছে, যদিও মামা আমার মহিষের মত কালো৤ যা হোক লক্কর ঝক্কর ময়মনসিং -- আইতে যাইতে কয় দিন? এমন করতে করতে বারটায় পৌঁছলাম কিশোরগঞ্জে৤

শহরতলীর একটি রাস্তা দিয়ে বাস যেয়ে থামল একটি শহীদ মিনারের সামনে৤ সবাই আস্তে আস্তে নেমে কনের বাড়ীর দিকে হাটা শুরু করল৤ আমি, কালু আর তুহিন তিন জনে এক সাথে হাটতে হাটতে শহীদ মিনারের দিকে এগুতেই তুহিন মামা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল বাহ কি সুন্দর বাড়ী৤ কার বাড়ী এটা? পাশের একজন রিক্সাওয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল, এটা পৌর চেয়ারম্যানের বাড়ী৤ তুহিন মামা বলল বেশতো চেয়ারম্যানের জামাই হতে পারলেতো ভালই হতো৤ কালু মামা সামনে যেতে যেতে বলল, জামাই পরে হইও এখন যাও শাহীন ভাইয়ের বউ নিয়ে ভালয় ভালয় বিদায় হই৤ তিন জন এক সাথে বিয়ে বাড়ীর গেইট পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ালাম৤ কালু মামার নাম কি জানেন, মো. আনোয়ার হোসেন সোহেল আর তুহিন মামার নাম মো. শামসুল হাসান তুহিন৤ কালু মামার আরেকটা নাম আছে , সেইটা হল কুত্তা সোহেল আর তুহিন মামার নাহ সেইটা বলা যাবেনা৤ বললে আমারে আছাড় মাইরা মাইরা ফালাব৤ তবে হেড স্যার ওরে ডাকত সরাইলের কুত্তা৤ হেড স্যার হইল ওর পিতা৤ আমাদের এস.এস.সি পরীক্ষায় এক সাথেই সিট পড়েছিল।

মোটামুটি বড় গেইট তৈরী করে জামাইকে আটকিয়ে রেখেছে৤ আর দরকষাকষি চলছে কত টাকার বিনিময়ে ফিতা কাটতে হবে? হই হুল্লোড়ে একাট্টা বিয়ে বাড়ী৤ এর মধ্যে ঘটনা ঘটেছে আরেকটি৤ জামাই দেখি রিক্সার মধ্যে মুখে রুমাল দিয়ে বসে আছে৤ কথা কাটা কাটি চলছে৤ ঘটনা কি ?

এক জন বলল এরকম চোরা মার্কা বর পাট্টি জীবনেও দেহি নাই৤

কারণ জানা গেল বাসের ড্রাইভার ভুল করে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছে৤ কনে পক্ষ গেইট করেছে তিনটা ,অন্য দুই গেইট ডিঙ্গিয়ে একেবারে বাড়ীর গেইটএ এসে পড়েছে বিধায় তারা দুই গেইটের পাওনা হাত ছাড়া, এই জন্য মাথা খারাপ৤ কিন্তু আসলে আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানিনা৤ ড্রাইভার যে দিক দিয়ে নিয়ে গেছে আমরা সেই দিক দিয়েই গিয়েছি৤ আমরাত আর রাস্তা চিনিনা৤

যাই হোক কথা কাটা কাটি কোনমতেই থামছে না৤

আপনারা চোরামি কইরা মিয়া দুই গেইট টপকাইয়া এইখানে আইছেন৤ আমরা কিছু বুঝিনা মনে করছেন? আমরা কি ঘাস খাই?

আচ্ছা ধরেন দুই হাজার ৤

কি কইলেন? আমরা কি জামালপুইরা ফকীর নাহি, দুই হাজার টেহাত মিয়া আমরা ভিক্ষা দেই৤

আচ্ছা তিন হাজার৤ আমরা আবার তিন হাজার টেকা দেই ভিক্ষা৤ এর মধ্যে বর পক্ষের এক জন বলল,

চিনেন মিয়া আমাদের? আমি হইলাম ১৬ মামলার আসামী, আপনারে মাইরা কিন্তু ১৭ নম্বর আসামী অমু৤

মাবুদে ইলাহী, এই কথা না, কইল আর কই যাস? দাঁত উচা, চিকন চাকন এক জন লাফ দিয়া ভীড়ের মধ্যে ওই লোকের কলারে ধইরা মারল এক ঘুষি৤ আমি ২২ বছর পরে বাইর অইলাম দুই সপ্তাহ আগে আমারে কস ১৬ মামলার আসামী! তুই আইজকা পায়খানা খাওয়ামু৤

আল্লাগো শুরু হয়ে গেল মাইর পিট৤ হুড়ো হুড়ি দৌড়া দৌড়ি আর এই গাছের ডাল ভাঙ্গে ওই ঘরের চাল ভাঙ্গে৤ চিৎকার চেঁচামেচি৤ মাবুদে মাওলা৤ এর মধ্যে বুড়া চাচা তিন জন মনে করেন গড়াইয়া গিয়া পড়ল ক্ষেতের মধ্যে৤ বোরো ক্ষেতের পানি দেওয়া, মাত্র কয়েক দিন হইছে মনে হয় ক্ষেত লাগাইছে৤ গড়া গড়ি করে ক্ষেতের চারা যে গুলো আছে সব মই দেওয়ার মত, আর সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী কাদা-পেঁকে ‌'যেমন খুশি তেমন সাজ'৤ চতুর্দিকে মনে হয় দৌড় প্রতিযোগীতা শুরু হইছে৤ যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে৤ এর বাড়ী ওর বাড়ীতে ঢুকছে৤ গাছের আড়ালে দাড়িয়ে দেখি শুধুমাত্র বর রিক্সায় অসহায়ের মত মুখে রুমাল দিয়ে বসে আছে৤ আর পাশে কেউ নেই৤ তুহিন মামা মনে করেন মইষের মত শক্তি চার জনকে ধাক্কা মাইরা ফালাইয়া দিয়া দৌড়৤ কালু মামার কথা বলতে পারবোনা৤

বিয়ের মধ্যে মাইর পিট আরো দেখেছি কিন্তু বর পক্ষকে যে কনে পক্ষ এমন মাইর দেয় এইটা মামা জীবনে দেখি নাই৤

হঠাৎ করেই দেখি ওই দাঁত উচা লোকটা আমার দিকে আসছে মাবুদে আল্লাহ এখন কি করি? দিলাম দৌড়৤ দৌড় দিতে যেয়ে তিনবার ক্ষেতের আইলে গড়াইয়া পড়লাম এর মধ্যেই লোকটার হাতে ছিল জিগাড় গাছের ডাল৤ দিল আমারে এক বাড়ি৤ বাড়ি খাইয়া মাথা দিয়া ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল৤ রক্ত না দেখে ২২ বছরের জেল খাটা লোক মনে করেন হকচকিয়ে গেল৤ উল্টোদিকে লুঙ্গি তুলে মনে করেন কুত্তা দৌড়৤

আমি হাত দিয়ে মাথা চাপ দিয়ে আবার দৌড়৤ দৌড়ে কোন দিকে যাব কুল কিনারা না পেয়ে এক বাড়ীতে ঢুকে পড়লাম৤ দেখি এক জন মহিলা বারান্দায় বসে হাত পাখায় নিজেকে বাতাস করছে৤ হুড়মুড়ো করে ঢুকতে দেখে তিনিও আশ্চর্য৤ আমি বললাম, মাগো পরে সব জিজ্ঞাসা করবেন আগে আমাকে একটু আশ্রয় দেন বিয়ে বাড়ীর মাইর খেয়ে এই অবস্থা৤ তিনি আমাকে পরম মমতায় ধরে ডাক দিলেন, ‘ছবি’ মা কই তাড়াতাড়ি সেভনল আর ব্যান্ডেজ নিয়ে আয়৤ চেয়ারম্যান বাড়ী বলেই মনে হয় এগুলো ছিল৤ ‘ছবি’ আর ‘মা’ আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল৤ মা বললেন বাবা তুমি অস্থির হইওনা আমি দেখছি৤ আল্লাহ মাবুদ সে কি যত্ন! মাথা পরিস্কার করে সেভনল দিয়ে ব্যান্ডেজ করে হাত পাখায় বাতাস করছে ‘ছবি’৤ মানুষের মমতা যে কত গভীর হয় আমি সেই দিন বুঝেছি৤ আর ‘ছবি’র কথা৤ সে ত এক কাব্য গাথা৤ পরম, পরম ভালবাসায় আমার পাশে বসে বলল, ‘এখন কেমন লাগছে? আমি কি বলব? শত সহস্র বছর ধরে জীবনান্দের সাথে যদি পথ হেটে হেটে বলি ‘ছবি’ তোমার পাশে বসে থাকা, আমার আজন্ম লালিত স্বপ্নের চেয়েও বেশি মমতাময়৤ তুমি কি বিশ্বাস করবে? শঙ্খচিল কিংবা পাতি হাঁসের পাখা দিয়ে বাতাস করলেও এমন হিম শীতল অনুভূতি পাওয়া দুস্কর, তবে তুমি কি বিশ্বাস করবে? নার্গিস কিংবা শিউলি, মোমেনা কিংবা রোকসানা, কার সাথে তুমার তুলনা? আমি জানি না৤ ছবি তুমি শুধুই ছবি৤ ‘ছবি’র হাতের সম্মোহনী ছোয়ায় আমার সারা শরীর হতে মূহুর্তে সব ব্যথা দূর হয়ে গেল৤ ছবির হাতের স্পর্শ আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুতের মত শিহরণ খেলে যায়৤ আমার মাথায় যখন সে হাত বুলিয়ে দেয় তখন আমার মনে হয় এই অনুভূতির মত পৃথিবীতে কোন অনুভূতি নেই৤ সে কি অবিশ্বাস্য রকম সুখানুভূতি! যদি ৯৭৭ বছর ছবি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, তবে কতই ভাল হত। কত দিন পরে আবার দেখা হবে? কোন দিনও না, আবার হতেও পারে৤

মাঝখানে কিছু দিন যোগাযোগ ছিল৤ চিঠি দিতাম৤ ছবিও আমাকে চিঠি দিত৤ ওর একটি চিঠির অপেক্ষায় কেটে যেত শত বছর৤ মানুষ কত কিছুর জন্যই না অপেক্ষা করে, সব অপেক্ষারই শেষ হয়না৤

আজ ষোল বছর পর 'ছবি'র সাথে দেখা স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে৤ কালো সানগ্লাসের আড়ালে ‘ছবি’র চোখ ঠিক বুঝা যাচ্ছে না৤

এই যে ভাই ঐ ছেলেটা কি আপনার? পানির একেবারে কাছে চলে যাচ্ছে৤ একেবারে সরাসরি বাংলায় কথা শুনে চমকে গেলাম৤ তাকিয়ে দেখলাম নির্জন বিমশ্র চাঁদ বৈতরনী থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে৤ ধান সিঁড়ি নদীর কিনারে শুয়ে আছি পৌঁষের রাতে কোন দিন জাগবনা জেনে, কোন দিন জাগবনা আর৤ এও কি সম্ভব? অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিনা৤ ছবি! তুমি! হ্যাঁ আমি৤

এই বুঝি তুমার মেয়ে? কি সুন্দর একেবারে মায়ের প্রতিচ্ছবি৤

আমার ডাক্তার স্বামীর সাথে থাকি নিউজার্সিতে আজ ছয় বছর৤ আপনি?

আমি নিউইয়র্কে একটা কলেজে পড়াই৤

কি আশ্চর্য ! সেই যে গেলেন! আর---৤

বাবা----৤ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে লাগল বাবা আর বাবা৤ পুত্রধনের ডাকে খানিকটা সম্বিত ফিরে পেলাম৤ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ডাক৤ কোন পাখিও এমন সুন্দর ডাক দিতে পারবেনা৤ এই ডাকেই এখন আচ্ছন্ন থাকি, প্রচ্ছন্ন থাকি৤ ভালবাসার নিজস্ব কোন রঙ নাই৤ পরিবারের রঙ দিয়ে ভালবাসা সাজে৤

পুত্রধন আপনার মাশাল্লাহ খুবই হ্যান্ডসাম৤

সবই আল্লাহর ইচ্ছা৤ ‘ছবি’র কথা মনে আছে?

সাত আসমান জমীন আমার মাথার উপর এখুনি ভেঙ্গে পড়বে৤ জবাব দিলাম না৤ আমার অস্তিত্ব জুড়ে এখন নাহার৤ আমার মা ওকে দেখে এসে বলেছিল জাপানী মেয়েদের মত গুটি গুটি পা হেটে বেড়াবে আমার সারা আঙিনা৤ আমি আর কিছুই করতে পারিনি৤ হয়ত আমি ব্যর্থ এক জন প্রেমিক৤ পরাজিত ভালবাসার সৈনিক৤ ওর কোন কমতি নেই ভালবাসায়৤ তাহলে কি ভালবাসার রূপ শক্তির নিত্যতা সূত্র মেনে চলে? সাগরের ঢেউয়ের দোলা, পাখির কলতান, ঝর্ণার মন হরণ করা শব্দ, নিবিড় পল্লীর মেঠো পথ, সন্ধ্যার সময় আমার বাড়ীর পিছনের বিশাল খোলা মাঠের ধানক্ষেতের নিস্তব্ধতা, সব আমার নেত্রকোনায় লুকোচুরি খেলছে৤ ‘ছবি’র কথার মাঝে আমি এখন নাহারকে খুজি৤ পৃথিবীর সব কোলাহল এখন আমার অস্তিত্বে৤ কেন সব কিছুই উল্টা পাল্টা হয়ে যায়? কে জানে?

বিষয়: বিবিধ

১৯১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File