একটি চিঠি একটি মৃত্যু ও একটি ভাষার যবনিকাপাত

লিখেছেন লিখেছেন টাংসু ফকীর ১২ জুন, ২০১৩, ০৭:৪৬:৫৭ সকাল



টোকিও ১৫ই মার্চ,২০০৫ইং (এপি) , ছেলের মৃত্যুতে সমবেদনায় চিঠি পেয়ে আরো বেশি শোকাভিভূত হয়ে পড়েছেন জাপানী এক মা৤ দেড় বছরের ছেলে তাইশির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে মা ‘মাসামি উয়েনকা‘ পত্রিকায় একটি চিঠি ছাপিয়েছিলেন৤ গত জানুয়ারীতে ‘কোবে’ শহরে ভুমিকম্পে ‘তাইশি’ মারা যায়৤ গত ৮ই ফেব্রয়ারীতে প্রকাশিত ঐ চিঠিতে মা উয়েনকা লেখেন, আমি জানাতে চাই মানুষকে বিশ্বে তাইশ উয়েনকা নামে ছোট্ট জীবন ছিল৤ সে ছিল শান্ত সাধারণ এবং নিষ্পাপ৤ তবে সে আর আমাদের মাঝে নেই৤ এই চিঠি প্রকাশিত হবার পর উয়েনকাকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন ৫শ’র বেশি লোক৤ এদের একজন লিখেছেন ‘তাইশি’ মরে গিয়েও আমার হৃদয়ে ছোট্ট প্রদীপের মত প্রজ্জলিত৤ ‘উয়েনকা’ পত্রিকাকে বলেন তিনি ঐ চিঠিটি লিখেছিলেন হাসপাতালে বসে৤ ভূমিকম্পে আহত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৤ তিনি আশ্চর্য হয়েছেন চঠিটি ছাপা হওয়াতে৤ কেননা ঐ ভূমিকম্পে বহু লোক নিহত হয়৤ তাদের মধ্যে ‘তাইশি’ এক জন মাত্র৤ দৈনিক বাংলা ১৬-০৫-২০০৫ইং

আমি যখন মার্কিন মূলকে পা রাখি তখন আমার স্ত্রী ৯ মাসের অন্তঃসত্বা৤ ২২শে সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে নিউইয়র্কে পৌঁছি আর ১৩ই অক্টোবর ‘কুইন্স হাসপাতালে’ আমার প্রথম ছেলে মোঃ আহসান আতিফ এর জন্ম হয়৤ এর পরে ধীরে ধীরে বড় হতে হতে এখন তার বয়স ৭৤ আমার বউ বলে, আমার ছেলের দেশ, বাংলাদেশ নয়, এই কথা চিন্তা করলেই আমার প্রেসার বেড়ে যায়৤ মা ও ছেলে দুই জন দুই দেশী৤ ‍দুই জনের মাতৃভাষা দুই রকম৤ তাহলে আমার বাংলা ভাষা কি সে বলবেনা? এটা কি তার মাতৃ ভাষা নয়? এ ধরনের নানা চিন্তায় থাকি সারাক্ষণ৤ চিন্তার কারণ বাংলাদেশী সমাজ৤ এ সমাজ খুবই ভয়ংকর৤ কারণ তারা নিজেরা কখনো নিজের সাহিত্য ও নিজের ঐতিহ্য নিয়ে ভাবেনা৤ কবি বলেছেন ‘‘পরের মুখে শিখা বুলি পাখির মত কেন বলিস? পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?’’ বাংলাদেশীরা এই কাজটাই সবচেয়ে বেশী করে৤

ভারতের বাচ্চারা এক সাথে হলে তারা কথা বলে হিন্দিতে৤ পাকিস্তানি বাচ্চারা এক সাথে হলে কথা বলে উর্দুতে কিন্তু বাংলাদেশী বাচ্চারা এক সাথে হলে কথা বলে ইংরেজীতে৤ এ দেশে এসে বাচ্চারা ইংরেজীতে কথা বললে সব বাংলাদেশীরাই গর্ববোধ করেন৤ আমি করি না আমি কষ্টে মরে যাই৤ পরিচিতি সমস্যায় ভোগে সব সময় এমন কিছু অর্ধ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত পরিবারের সন্তানের সমস্যাই বেশি৤ আর ডাক্তার ইঞ্জিয়ারদের ছেলে মেয়েদের তো আরেক হিসাব৤ আমার ছেলে যখন প্রথম কথা বলতে শুরু করে, তখন বাংলায় আব্বা, আম্মা, দিয়ে প্রয়োজনীয় সব কথাই বাংলায় বলা শুরু করে৤ এর পরে সকল কথাই সে পরিস্কার শুদ্ধ বাংলায় বলতে বলতে পারে এবং বুঝতেও পারে৤ যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করল তখন স্কুলের শিক্ষকদের সাথে সাথে ইংরেজী বলা শুরু হলে মাঝে মধ্যে বাসায় ইংরেজী বলতে থাকে৤ যেমন ঃ আস -কাম৤ হঠাৎ করেই আমার বুকের মাঝখানে একটু ধাক্কা লাগল৤ আস্তে আস্তে সেই ধাক্কাটা ব্যথায় পরিণত হতে লাগল৤ এখন বুকে প্রচন্ড ব্যথা৤ আমার ভাষা কি হারিয়ে যাচ্ছে? হ্যাঁ আমার ভাষা হারিয়েইত যাচ্ছে৤ আমার বাবাকে আমি শিখিয়েছি ‘‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান? ‘‘তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে----৤ ‘‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়-----৤ আমার ছেলে এ গুলো সুন্দর করে গাইতে পারে৤ কিন্তু যত বড় হচ্ছে সে আস্তে আস্তে কথা বলছে বাংলা ইংরেজী মিশিয়ে৤ শুক্রবার জুমার নামাজের পরে ওদের স্কুলে বই মেলা হয়৤ আমি ওকে স্কুলে যাওয়ার সময় ১০ টি ডলার দিয়েছিলাম৤ স্কুল থেকে ফিরে এলে বললাম বাবা সব টাকা ই শেষ? সে বলল না, এইট ডলার দিয়ে বই কিনেছি আর ওয়ান ডলার স্পেন্ট করেছি কেন্ডিতে আর ওয়ান মোর ডলার লেফ্ট আছে৤ আমার বুকে কেমন জানি ব্যথা হয়৤ এক দিন ওর ছেলে মেয়েদের সাথে আর বাংলায় কথা বলবেনা৤ আমি যেমন বাবাকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম এই বলে ‘‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, ঢাক ঢোল ঝাজড় বাজে---‘‘৤ এত সুন্দর ভাষা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই৤ আমি শুধু চিন্তা করি আমার ভাষার এমনই যবনিকাপাত হল৤ আমি বুকের মধ্যে কি জানি কি কষ্ট নিয়ে ভেসে বেড়াই মেঘের ভেলায়৤ আমার বুকে দিন দিনই কষ্ট বাড়ছে৤ এই কষ্টের শেষ আর কখনো হবে না৤ ‘‘গন্ধ বণিকের’’ কবির সাথে আমার সন্তানের কোন দিনও দেখা হবে না৤ প্রেমের কবির ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো গান, ‘‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী খোপায় দেব তারা ফুল‘‘ কোন দিনও জানতে পারবেনা৤ তার ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর সময় বলবেনা খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে৤ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিবো কিসে?

বিষয়: বিবিধ

১৫৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File