বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলাম ‘জারজ সন্তান’!
লিখেছেন লিখেছেন মোনের কোঠা ০৬ অক্টোবর, ২০১৩, ০৯:১৫:১২ সকাল
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলাম ‘জারজ সন্তান’! জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই : সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর ছেলে সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে ‘জারজ সন্তান’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, জারজ সন্তানের যেমন পৈত্রিক সম্পত্তিতে কোন অধিকার থাকে না, তেমনি জামায়াতে ইসলামীরও বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। ‘ধর্ম ও রাজনীতি : দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক দুই দিনের আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মিলনী অনুষ্ঠানের শেষ দিনে কথা বলতে গিয়ে তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন, যে দল এ দেশের জন্মে বিশ্বাস করে না, এ দেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে না, সে দল এ দেশে রাজনীতি করে কিভাবে? তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোন নৈতিক অধিকার নেই। তিনি মনে করেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলো যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধিতা করেছে তাই, বাংলাদেশে কোন ধর্মভিত্তিক দলকে রাজনীতি করার অনুমতি দেয়া উচিত নয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল- স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধকরণ। ওই সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল হিসেবে পাঁচটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সে দলগুলো ছিল- জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজাম-ই-ইসলামী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাই করেনি, পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা এবং যুদ্ধাপরাধ করেছে। অবশ্য ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন।
পাকিস্তানের নাগরিক সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী ১৯৪১ সালে ইসলাম ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তাঁর নয় সন্তানের কেউ এ রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। শুধু তাই নয়, আবুল আলা মওদুদী নিজে ধর্মভিত্তিক রাজনৈকিত দলের প্রতিষ্ঠা করলেও, তাঁর সন্তানদের তিনি তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের অনুসারী হতে নিষেধ করে যান। ফলে তাঁর সন্তানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাঁরা কেউ পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে জড়িত নয়। জামায়াতে ইসলামীর কট্টর সমালোচনাকারী হায়দার ফারুক মওদুদী বলেন, পাকিস্তানের স্রষ্টা কায়দে আজম জিন্নাহ একটি ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তান গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু মওদুদীর মতো ধর্মীয় নেতাদের চাপে তিনি তা করতে পারেনি। তিনি পাকিস্তানকে ইসলামীকরণ করেছেন। আর ওই ইসলামীকরণের ফল আজ পাকিস্তান যেমন ভোগ করছে, তেমনি ভোগ করছে জামায়াতে ইসলামীও।
তিনি বলেন, জিন্নাহ সাহেব ‘লা ইলাহা ইল্লাললাহুকে’ মূলমন্ত্র করে মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠান করেন। এটা দেখে মওদুদী কেন বসে থাকবেন। তিনিও ‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু’র ভিত্তিকে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। তবে জিন্নাহ-মওদুদীরা রাজনীতি করতে গিয়ে যা বলেছেন, সব সময় তার বিপরীত কাজ করেছেন। ফলে জামায়াতে ইসলামীর যে পরিণতি হচ্ছে, পাকিস্তানেরও সেই একই পরিণতি হচ্ছে। পাকিস্তান সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হায়দার ফারুক মওদুদী বর্তমানে লাহোরে অবস্থান করছেন। তিনি পাকিস্তানের একজন জনপ্রিয় কলামিস্ট। ‘ধর্ম ও রাজনীতি : দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক দুই দিনের আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মিলনীতে যোগ দিতে গত বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকায় আসেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম তাঁর ঢাকায় আগমন। দুই দিনের সম্মেলনের শেষ দিনের সমাপনী অধিবেশনে তিনি মঞ্চে বসে কথা বলেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি তাঁর লেখা ও বক্তৃতায় সব সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করে আসছেন। যা তাঁর বাবা মওদুদীর মতাদর্শের বিরোধিতার শামিল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হায়দার ফারুক মওদুদী বলেন, আমার বাবা মওদুদীর যেমন কথা বলার অধিকার ছিল, তেমনি আমারও কথা বলার অধিকার আছে। আমি আমার বাবার বই পড়েই এটা জেনেছি।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের নেতাদের বিচার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে যেমন কাজ করে সে তেমন তার ফল পায়। বাংলাদেশেও জামায়াতে ইসলামীর প্রবীণ নেতারা সে ফল ভোগ করছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে কেউ শাস্তির বাইরে থাকতে পারে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই তাদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, জিন্নাহ যেদিন বললেন বাংলা নয়, পাকিস্তানের মাত্র চার শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা উর্দুই হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রা ভাষা। সে দিনই বাংলাদেশের জন্ম হয়। আর ইসলামীকরণের মাধ্যমে যখন পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশের জন্ম হয়। তৃতীয় দফায় ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়, যখন ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে নেমে পাকিস্তানীদের বিরোধিতাকারীদের খতম করার নির্দেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে হায়দার ফারুক মওদুদী আরও বলেন, নিয়াজীকে যখন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হয়, তখন তিনি বলেছিলেন তাকে আত্মসমর্পণের জন্যই পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। বাস্তবেও তাই ঘটেছে। নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে দেশে ফিরে গিয়ে কোর্ট মার্শালে তাঁর বিচারের দাবি করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সেনা শাসকরা আমৃত্যু তাঁর কোর্ট মার্শাল করেননি। কারণ সেনা শাসকরা যুদ্ধে হেরে যাবে -এটা জেনেশুনেই তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের জন্য পাঠিয়েছিল। কারণ ওই নাটক মঞ্চস্থ না করলে বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার জন্যই সেনা শাসকরা পরাজিত সৈনিক হিসেবে কোন দিন নিয়াজির কোর্ট মার্শাল করেনি। হায়দার ফারুক মওদুদী জানান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে। দুই দেশে দুই দল হলেও এর মাথা একটিই সেটি পাকিস্তানে। ওখান থেকে দুই দেশের দুই জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত হচ্ছে।
তাঁর বাবা ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করলেও তিনি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্ম থাকলে তা খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র হচ্ছে একটি ছাতার মতো। এ ছাতার নিচে সব ধর্মের মানুষের বসবাস। গণতন্ত্রে ধর্মের কোন স্থান নেই। কোন রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক চর্চা করতে চায় তাহলে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন ধর্মের স্থান থাকতে পারে না। ধর্মকে যদি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে সেখানে মানবতার মৃত্যু ঘটে। হায়দার ফারুক মওদুদী ধর্ম প্রসঙ্গে বলেন, ধর্ম আমাদের ভাল হওয়ার নৈতিক শিক্ষা দেয়। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, শিখ-প্রত্যেক ধর্ম তার বিশ্বাসীদের ভাল হওয়ার শিক্ষা দেয়। ধর্ম আমাদের আরও শিক্ষা দেয়, আমাদের পূর্ব পুরুষ এক এবং কোন ধর্মের মানুষকে আমাদের ঘৃণা করা উচিত নয়। আর পবিত্র কোরান আমাদের আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়।
-
বিষয়: রাজনীতি
১৫০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন