কত মুহূর্ত !
লিখেছেন লিখেছেন যোদ্ধা ০৩ অক্টোবর, ২০১৩, ০৬:১৭:১৬ সন্ধ্যা
।।১।।
শওকত আজ বহুদিন পর আধো আলো , আধো অন্ধকারে পাতারচরের চেহারা দেখছে । এই বাড়ি ফেরার জন্য কত রাত আকুলি বিকুলি করেছে! উথাল পাথাল মন নিয়ে মেসের জানালার সাথে লাগোয়া -পাশের বিল্ডিঙের নিশ্ছিদ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকেছে! সেই বাড়িতে শওকত ফিরল ,পাতারচরে এলো ঠিকই ,কিন্তু এভাবে সে কি আসতে চেয়েছিল ? জোয়ান মর্দ ছেলে বলে দুই ফোঁটা চোখের পানিও ফেলতে পারছেনা এমনই কপাল ।
গতকাল শওকতের বড় ভাই মকসুদ মোবাইল করে জানিয়েছে যে তিনদিনের জ্বরে ভুগে কুট্টি ফুফু নাকি মরে গেছে !মরার আগে শওকতকে খুব ডেকেছিল বুড়ি । তাই শেষবারের মত হতভাগীকে দেখতে সে যেন অবশই বাড়ি আসে ।
সারাটা পথ শওকত লঞ্চের ডেকে ঝিম মেরে বসে ছিল । মনে মনে আফসোসে মরে যাচ্ছিল । পাগলীটাকে কোন জেদে জানি ফাউল্লার হোটেলে একবেলা ভাত খাওয়াতেই অনেক হিসাব কষেছিল এতদিন ।
গেলবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় পাড়াগুলো কতই না জমজমাট ছিল । বাগদী পাড়া , বুইন্না পাড়া যেখানেই গিয়েছে সেখানেই অবিরাম হট্টগোল - হা হা হি হি আর আনন্দ । সাড়ে চৌদ্দ ইঞ্চি ট্রাঙ্কটা বোগলে চেপে হাতে এক কাঁদি কলা আর পাউরুটির প্যাকেট নিয়ে ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটার সময় শওকতের চোখ পড়েছিল হনুফাদের বাঁশবাগানে । কেউ একজন এই ভোরে ফাঁকফোকর দিয়ে খুব উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে ।কি মনে করে সে এগিয়ে যেতেই ধুপ করে ওর সামনে ঝাপ দিল মানুষটা । ইয়া লম্বা ঘোমটা পরে এরকম লম্ফঝম্প আর কেইবা করবে ...
শওকত চিনতে পারলেও উনি পিঁচুটি পড়া চোখে ওকে অনেকটা সময় নিয়ে নিরীক্ষণ করলেন । শেষমেশ ব্যাকাত্যাড়া লাল খয়েরি দাঁতের পাটি খুলে দিলেন নিশ্চিত হয়ে ।
´´অ কেডা ? মোশারেফ ? লাল শুক্কুরবার ঢাহাত গেছেলা না ? তাত্তারি বাড়ির ধারে যাও ! হেই মাতারি বিলাপ হইর্যা কানতে আছে, দ্যাহো গিয়া..´´
আর শওকতও , একদম বত্রিশ দাঁত বের করে দিল।
´´মাতারি পামু কই ? মোরে কি বিয়া দেছেলা ?ফুবু আম্মা , মুই শওকত , ঠাহর হরতে পারলেনা মোরে , ভুইল্ল্যাই গেছো মোরে।´´
বুড়ির ঠোটের দুই প্রান্ত কানের লতিতে গিয়ে ঠেকল এবার ।
´´দ্যাহো পরিস্থিতি ! শওকত আইছো ? জোয়ান ধাওয়ান ব্যাডার লাহান চেহারা অইছে তোমার , কেমনে ঠাউরামু ?´´
তারপর কণ্ঠস্বর এককাঠি নিচে নামিয়ে নিচে নামিয়ে ইতি উতি দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল -
´´অ্যাহা ! এউগগা জাদু দেকবি অ্যা ?´´
অসময়ে সে এমন প্রস্তাব পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ল ।
´´দ্যাহাবা ? দ্যাহাও !´´
তখন টুপ করে কলার কাঁদি ছিনিয়ে নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ কুট্টি দিল ভোঁ দৌড় ! জাদু দেখে শওকত প্রথমে চোখ ছানাবড়া করে ফেললেও পরে একাই একাই কতক্ষন ঠা ঠা হেসেছে । ´´পাতারচরে আইটটা কলায় এরহম দুর্ভিক্ষ ?? ´´
।।২।।
সেদিন বাড়ির উঠান ছিল গরম । শওকতের আব্বা মাওলানা নুরুজ্জামান রেগে ফায়ার হয়ে উঠানে হাঁটাহাঁটি করছিলেন । গ্রামের মসজিদের ছা পোষা ইমাম তিনি । এই টুকু ভিটে ছাড়া সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই । তার ওপর নদী ভাঙতে ভাঙতে একদম বাড়ির ধারে ।এখন মান ইজ্জত নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকাটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে । শওকত চৌহদ্দির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে আব্বার গলা শুনতে পাচ্ছিল ।
´´আহুক আইজকা ঘরে ! জুতাইয়া লাম্বা বানাইয়া হালামু । হাওলাদার বাড়ির ইজ্জত মারাতাছে পাগল ছাগল কুনহানকার ! বাজারে বাজারে ভিক্ষা বিরিত্তি এক্কেরে ছুডাইয়া দিমু।´´ মসজিদের খাদেম অহিদুজ্জামান কাকাও ভীষণ ক্ষ্যাপা ।
´´হ বাই , ছোড বইন , এর উপর সেন্টিমেনটার । মাথায় উডাইয়া বহানোই অন্যায্য হইছে । আল্লা করিম রব্বানা ! শামছুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে পরিচয় দিয়া খয়রাত করছে , বলছে মুই নুরু মওলানার বইন , অহিদ খাদেমের বইন , মোরে এউগগা সন্দেশ দেবেন শামছু বাই ! আবুল হোশেন বিচার লইয়া আইছে কাইলও । হ্যার পোলার আত থেইক্যা ছামুছা কাইড়া লইয়া গেছে কুট্টি ........
´´আব্বা আসসালামালেকুম , কাহা আসসালামালেকুম´´ বলে শওকত বাপ চাচাকে কদমবুসি করল । পাকঘর থেকে ওর আম্মা , আকলিমা - নিলুফা আর মাজেদের মাও ছুটে এল ।
শওকতের আম্মা ছেলেকে পেয়ে আয়োজন করে মরাকান্না জুড়ে দিতেই স্বামীর কঠিন ধমক খেল ।
´´মাতারির উপলক্ষ পাইলেই বিলাপ হরতে অইবে .....´´
ওয়াজেদ আর মাজেদ ঠিক তখনই পাঁজাকোল করে ধরে নিয়ে এল । এবার নুরুজ্জামান সাহেব তেড়ে মেরে কুট্টির শণের মত রুক্ষ চুল ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকানো শুরু করলেন ।
´´অহিদুজ্জামান ! দড়ি দিয়া অরে বান ! আইজকা অরে জব কইরা হালামু ! ক , কিল্লেইগগা পেত্যেকদিন তুমি খয়রার কর ? তোমার খাওনে কোনডা কম পরছেলে ? ভিক্কা করছেলে ক্যা তুই হারামজাদী ....´´
কুট্টি হাত- পা ছুড়তে ছুড়তে শুধু তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল , ´´বাই ... বাই ...! ইন্নালিল্লা ইন্নালিল্লা! বাইগো ইন্নালিল্লাহ ....´´
শওকত কোনমতে ফুপু কে ছাড়িয়ে নিয়ে ফজলুদের দোকানে পুকুরঘাটে নিয়ে গিয়েছিল । ভয়ার্ত মুরগী ছানার মতন শওকতের শার্টের এক কোণা খামচে রেখেছিল পাগলী । কি এক মায়ায় শওকত হঠাৎ দিশাহারা হয়ে গেল । কোমল গলায় বলল ,
-ফুবু আম্মা , তুমি ওরহম কর কেন ? পোলাপান গুঁড়াগাড়ার লাহান না হরলে হয়না ? খাউজ্জায় ?
কুট্টি চোখ বড় বড় করে আনন্দিত হয়ে বলল ,
-হ খাউজ্জায় । তর সোয়ামীরে জেনের বাদশা গাইর্যা হালাইতো পুশকুনির তলায় , তর তিন মাইস্যা মাইয়ারে হিয়ালে লইয়া যাইত জঙ্গলে - তাইলে বোজতে ওহে শওকত কেমন হইর্যা ছুঁচোর বাচ্চা গর্তে পলায় আর খাউজ্জায় .....!
শওকতের ফুবু আম্মা শওকতকে শুদ্ধ অশুদ্ধ আধা খ্যাচড়া কথা অতপর বিরাট অট্টহাসি দিয়ে পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিল । হঠাৎ ওর হাত ধরে বলল ,
-তোমার কাছে মোর এউগগা দাবী ছেল । মোরে ফাউল্লার হোটেলে মুরহার ঝোলের লগে আলু দিয়া একথাল ভাত খাওয়াবি আব্বা !
এত সামান্য দাবী অসামান্য আবেগ নিয়ে পেশ করায় শওকতের চোখে হয়ত পানি চলে আসা উচিৎ ছিল । কিন্তু ওর ভীষণ রাগ হল । খানাখাদ্য ছাড়া কুট্টি ফুফুর কি আর কোন কথা থাকতে নাই ?
-আম্মায় কি মুরহা রাইন্দা তোমার পাতে দেয়না ?এক্কালে ফাউল্লার হোটেলই ক্যা ?
-আলেনূরের রান্দা আর ফাউল্লার রান্দা কি এক হইলে ? কই আব্দুল হাদী আর কই ছাগলের লাদী ! মুই ফাউল্লার রান্দা ঘন ঝোলের মুরহা খামুই। তোমার সমুস্যা কই, তুই না কামাই কর ?
-আইচ্ছা খাওয়ামুনে , সময় আউক ...... এহনো হেই সময় আহে নাই ।
মুরগীর সুরুয়ার সাথে সময়ের জটিল সম্পর্ক কুট্টি ফুফু বুঝতে পারেনা , তাই ভাইপোর মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।
।। ৩ ।।
বুকে একরাশ সাহস সঞ্চয় করে শওকত মরা বাড়ির উঠানে পা রাখল ।এরপরের এক এক মুহূর্ত যেন বিশাল এক একটা পাথরের চাঁই । চুরমার করে দিচ্ছে শওকতকে । মরা বাড়ির ছোট খাট আচার অনুষ্ঠান , মহিলাদের শোকগাথা , আকলিমা নিলুফার বিলাপ , আব্বার ভেঙ্গে নুয়ে পড়া চেহারা , অহিদ কাকার কোরানখানি কিংবা মকসুদ ভাইর নিষ্ঠাবান তদারকি - সব কিছুর মাঝে ঘুরে ফিরে একটা দাবী , একটা আবদারই খুঁজে বেড়াচ্ছিল সে ।
´´মোরে ফাউল্লার হোটেলে মুরহার ঝোলের লগে আলু দিয়া একথাল ভাত খাওয়াবি আব্বা !´´
গোর দিয়ে ফেরার সময় কেউ একজন বলে উঠলো , ´´ইমাম সাব ভাইঙ্গা পড়ছে বেশি । পাগল হইলেও তো বইন ছেল । তয় পাগল ছাগলের বাঁচন মরন এক্কেলে হোমান । মরছে বাপের হাড্ডি খাইয়া উপদ্রোব কোমাইছে ...´´
উপদ্রব কমেছে তবু শওকতের মুরগীর ঝোলের দায় কমছেনা এই যন্ত্রণায় শওকত বারবার ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে , ফুবু আম্মা খুব অভিমান করে শুয়ে শুয়ে বলছে ,
´´অ্যাহা মনুরা ! তোরা চালাডা ইটটু উসকাইয়া দেতে পারলেনা ? মাতার ধারে ঠ্যাহে । চাডাইডাও তো দেছো ফুডা ! মোর বেরেনে না হয় সমুস্যা ছেলো , কিন্তু মুই তো নুরু মাওলানার বইন , অহিদ খাদেমের বইন ......´´
যাবতীয় মরদগিরি ভুলে গিয়ে শওকত এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো ।
বিষয়: বিবিধ
১৪৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন