৭ মার্চের ভাষণ ও শেখ মুজিব

লিখেছেন লিখেছেন শাহবাগের গাজাখোর ০৭ মার্চ, ২০১৩, ০৭:৪৩:০৭ সন্ধ্যা

এ মার্চ মাস বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবাহী উত্তাল কালপর্ব। ১৯৭১ সালের এ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রাম আরম্ভ করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে কুচক্রী জান্তার কবল থেকে বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল তারা।

সঙ্ঘাত শুরু হয়েছিল সামরিক শাসকগোষ্ঠী জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে যখন হঠাৎ ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন মুলতবি করে দেয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠকের পরবর্তী তারিখ ধার্য করা ছাড়াই এবং মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলাপ না করেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বৈঠক বা অধিবেশন মুলতবি করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ এ পদক্ষেপকে জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য করে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামে বিদেশী দলের সাথে ক্রিকেট খেলা পরিত্যক্ত হলো সাথে সাথেই। সারা পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিব কর্তৃক ২ ও ৩ মার্চ পূর্ণ হরতাল ঘোষিত হলো। সামরিক সরকার ঢাকায় কারফিউ জারি করেছিল। এ দিকে হামলা ও সংঘর্ষে বহু লোক হতাহত হয়।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বক্তব্য রাখেন। এ বক্তৃতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ এ বক্তৃতাকে স্বাধীনতা ঘোষণা মনে করেন। কেউ মনে করে এ বক্তৃতাকে সুকৌশলে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘোষণাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া বলে।

৭ মার্চের এ বক্তৃতা একটি অভূতপূর্ব ভাষণ। এটি ছিল বাগ্মিতার অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ। তখন বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধু ছাত্র-জনতার প্রচণ্ড চাপে। তাই কৌশলী বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের প্রচণ্ড ক্ষোভকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকে ফিরিয়ে নিতে প্রয়াস পান এবং এতে সফল হন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, পাকিস্তানি জান্তা এর মূল্যায়ন করেনি। সেদিন মুজিবের ছিল চারটি দাবি। ১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। ২. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ৩. সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরীহ ও নিরস্ত্র লোকজনকে হত্যার তদন্ত করতে হবে। ৪. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

সে দিন জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন মুজিব। ওই চার দাবির মধ্যে এমন কর্মসূচি ছিল না, যা জান্তার শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে আসলে রোধ করতে পারে। পরে ১৫ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর সংলাপ নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছিল। তিনি যদি ৪ দফা দাবির সাথে আর একটি দাবি যুক্ত করতেন তা হলে নিশ্চিতভাবে বলা যেত, তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ৭ মার্চেই প্রস্তুত ছিলেন। সে দাবিটি হলো, ‘আজ থেকে বিমানবাহিনীর এবং পিআইএ’র বিমান বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য আনা বন্ধ করবে; অন্যথায় লাখো মানুষ বিমানবন্দর ঘেরাও করবে।’ এ দাবির দুই রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারত। ১. সৈন্য আনা বন্ধ করে শান্তিপূর্ণভাবে দাবিগুলো মেনে নেয়া; যেমনিভাবে ৭ মার্চের বক্তৃতা বেতার ও টিভিতে প্রচার করতে বাধ্য হয়েছিল। ২. যদি মেনে না নিত এবং বিমানবন্দর ঘেরাও হতো, তখন নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হতো। পাঁচ-সাত হাজার মানুষ হয়তো শহীদ হতেন। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্য আনা বন্ধ হয়ে যেত। অবশ্য বিমানবন্দর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতো। কারণ মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়ন জয়দেবপুরে ছিল অক্ষত অবস্থায়। তারা পাল্টা আক্রমণ করত তখন। তবে এ জন্য পাকিস্তানিদেরও ভয় ছিল (দেখুন, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিকের বই)। তখনো ঢাকার বিমানবাহিনী স্থাপনায় ছিলেন বেশির ভাগ বাঙালি বিমানসেনা। এ ছাড়া, স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য ছিল প্রায় এক হাজার এমওডিসি এবং ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য বাহিনী। বাস্তবে তাদের সাথে থাকত ঢাকার লাখো লাখো মানুষ।

এরপর ঘটতে পারত ‘সবচেয়ে বড় বিস্ময়’! ব্রিগেডিয়ার মজুমদার তখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম সামরিক ঘাঁটির কমান্ড্যান্ট। সেখানে মেজর জিয়ার দশম ব্যাটালিয়ান ছাড়াও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে হাজার দুই রিক্রুট ও সৈন্য এবং ক্যাপটেন রফিকের নেতৃত্বে ছিল ইপিআর। তাদের একটি শক্তিশালী দল দিয়ে যদি ফেনী নদীর ওপর শুভপুর ব্রিজ দখলে নেয়া হতো, জান্তার সামরিক শক্তিকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে বলা হলে তখন তা তারা করতে বাধ্য হতো। তখন পর্যন্ত তাদের শক্তি ছিল অসংহত এবং তারা ছিল আমাদের তুলনায় দুর্বল।

বর্তমান জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎসংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবHappy সুবিদ আলী ভূঁইয়া তার মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস বইতে কুমিরার লড়াই (পৃ: ১৩) অধ্যায়ে কিভাবে তিনি একটি দুর্বল বাহিনী দিয়ে (মাত্র এক কোম্পানি সৈন্য) এক ব্যাটালিয়ান সৈন্যকে (পাকিস্তানি) ঘায়েল করেছেন, তা বিস্তারিত লিখেছেন। এ ঘটনা আমার উপরিউক্ত বক্তব্যের পক্ষে একটি বড় প্রমাণ। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ২০ মার্চে পরে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বলা যায়, উল্লিখিত যেকোনো দৃশ্যপট উন্মোচিত হলে আমরা অপেক্ষাকৃত স্বল্প ক্ষতিসাপেক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম। লাখ লাখ মানুষ এবং অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেত। এটি সম্ভব হতো যদি রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ নেয়া হতো অথবা স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত টার্গেট থাকত। মার্চের দ্বিতীয়ার্ধে সংলাপের আলোকে অনেকেই মনে করেন, মুজিব চেয়েছিলেন ৬ দফার ভিত্তিতে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসিত একটি দেশ। তাই ২৫ মার্চ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ড. কামাল হোসেন, তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম তার বাসায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাদের কিছু জানাননি স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে। বরঞ্চ বারবার তিনি সামরিক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিশেষ টেলিফোন কল আসা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। ড. কামাল হোসেনের ভাষায় ‘২৫ মার্চে ভয়াবহ রাতের আগে সারাক্ষণ আমি একটি টেলিফোন পাওয়ার অপেক্ষা করলাম। ওই টেলিফোন কখনোই আসেনি। এমনকি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি যখন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখনো তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, ওই টেলিফোন পেয়েছি কি না। তাকে জানালাম, তা আমি পাইনি। ওই রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং গণহত্যা ও রক্তস্নান শুরু হলো’ (স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা পৃ: ৭৩)। সে দিন সন্ধ্যায় ঢাকায় গণহত্যার হুকুম দিয়ে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করা সত্ত্বেও তিনি জান্তার টেলিফোনের আশা ত্যাগ করেননি [এয়ার ভাইস মার্শাল (অবHappy এ কে খন্দকারের ভোরের কাগজ লিখিত প্রবন্ধ মতে]।

বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন। তাদের এতদূর উদ্বেলিত করেছিলেন যে, তারা একটি বিরাট সামরিক শক্তিকে প্রতিরোধ করতেও পিছপা হয়নি। এ কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুরই পাওনা।

গত বছর এ দিনে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে মেজর জেনারেল (অবHappy শিকদারের প্রবন্ধ চোখে পড়েছিল। তিনি লিখেছেন, একটি জাতির সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতখানি সফল ও বিফল, তা পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল সে দেশের রাষ্ট্রনায়কদের দূরদৃষ্টির ওপর। আরো লিখেছেন ‘যুদ্ধের ফল বহুলাংশে নির্ভর করে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের নিরাপত্তা রক্ষাকালে সে রাষ্ট্রের পূর্বপ্রস্তুতি কতখানি প্রজ্ঞাজনিত ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিল তার ওপর।’ তিনি বলেছেন, ‘নেতার সমরকৌশল এবং আধুনিক প্রচলিত ও অপ্রচলিত উভয় যুদ্ধেই Daniel Plan কার্যকর করা যুদ্ধের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতায় এ উভয় দিক অনুপস্থিত। Daniel Plan কার্যকর করার অর্থ, শত্রু যেন কোনো সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার না করতে পারে। সে জন্যই প্রয়োজন ছিল ওপরে বর্ণিত ৫ নম্বর দাবি কার্যকর করা। কিন্তু তা হয় নি। প্রসঙ্গত, তখন ২৪ দিন বাংলাদেশের প্রকৃত শাসক ছিলেন শেখ মুজিব, তা মনে রাখতে হবে।

৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক নির্দেশনা হিসেবে ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, আর ‘তোমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ এই দু’টি কথা অনেকে উল্লেখ করে থাকেন।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আমাদের সহকর্মী এয়ার কমোডর (অবHappy মরহুম আবদুল মান্নান চৌধুরীর করাচির ড্রিগরোডের বাসায় যাই তার ভাই মরহুম মেজর জেনারেল (অবHappy শফিউল্লাহ চৌধুরীর (তখন মেজর) সাথে দেখা করতে। ঢাকার তথা বাংলাদেশের অবস্থা জানাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। পাকিস্তানে আমরা সবাই ছিলাম আতঙ্কগ্রস্ত। তার কথা, বাঙালিরা আর্মির ফায়ার পাওয়ার সম্পর্কে ধারণা রাখেনা। এক ব্যাটালিয়ানে কত ফায়ার পাওয়ার, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা নেই তাদের। ‘যার কাছে যা আছে তা দিয়ে’ প্রতিরোধকে, এ যুগে কার্যকর সামরিক কৌশল বলা যায় না। বাংলাদেশে যার যা কিছু বলতে বুঝি দা, খন্তা, কুড়াল, বর্শা, লাঠি, বঁটি, ছুরি, গুলতি আর তীর-ধনুক। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়া ছিল প্রতীকী বক্তব্য।

যা হোক, বঙ্গবন্ধু মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ২৫ মার্চ স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা ছিল একটি নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলন। এর ব্যাপ্তি অসাধারণ কিন্তু কার্যকারিতা ছিল বাস্তবে অপর্যাপ্ত।

ফলে শত্রুপক্ষ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তাদের শক্তি বাড়াতে সক্ষম হয়। অন্য দিকে আমাদের নিজস্ব শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। এ অবস্থায় তারা ২৫ মার্চ আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে স্থগিত না করেই অপ্রস্তুত জনগণের ওপর নৃশংস হামলা চালায়, যা পরে জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল

বিষয়: রাজনীতি

১৩৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File