সংকোচ।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৬ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:৩০:১৭ সকাল
রতন একটি সুবোধ বালক।অজপাড়াগাঁয়ে তার জন্ম।বাবা স্হানীয় ক্ষুধে ব্যাবসায়ী।গ্রামের মেঠো পথের ধারে তাদের ছোট্ট কুটির।বাবা মা দুই ভাই বোন নিয়ে সংসার।ছোট পরিবার হলেও শিক্ষিত ও মার্জিত পরিবার।পড়ালেখা করে দুই কিলোমিটার দূরে একটি স্কুলে।স্কুলের নাম হাজি কলিমুল্লাহ স্কুল।বড় সন্তান ও ভাল ছাত্র।প্রাইমারি ও হাই স্কুল শেষ করে ভর্তি হয় স্হানীয় কলেজে।কলেজ উত্তীর্ন হয়েছে ভালভাবে তবে বড় শহরে গিয়ে পড়ার ব্যাবস্হা নেই।রতন এতগুলো বছর পার করে এসেছে কিন্তু বাবা মা বা অন্য কারোর দ্বারস্হ হয় নি।বাবা পড়াশুনার খরচ যা দিয়েছে তাতেই চলে গেছে।বাড়তি কোন বায়না ও কখনো ধরেনি।তার একটিই কারন সংকোচ।বাড়িতে আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসলে অন্য একটি রুমে জড়োসড়ো হয়ে নিজেকে নিয়েই ভাবতে সে পছন্দ করতো।পরিবারের সাথে খাবারের সময়গুলো ছাড়া তেমন একটা মেলামেশা ছিল না।স্কুল সার্টিফিকেট অর্জনের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বড় শহরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবা মা'কে বলতে পারে নি।নিরুপায় হয়ে থানাপাড়ার কলেজে পড়ার জন্য ভর্তি হলো।ক্লাসের প্রথম দিনে নিজের বন্ধুদের অনেককে না দেখে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।ক্লাসে অমনোযোগিতার ব্যাপারটি একজন প্রভাষক দেখতে পেয়ে ক্লাস শেষে রতনকে ডেকে পাঠালেন।রতনকে শিক্ষক বললেন,রতন তোমার মন কি খারাপ? রতন সুবোধ বালকের মত উত্তর দিল তেমন না স্যার।প্রথম দিন তো এই যা! প্রভাষক মহাশয় বললেন,রতন আমি তোমাকে বুঝতে পারি।আমি যখন কলেজ উত্তীর্ন হয়েছিলাম খুব ইচ্ছে ছিল ঢাকা শহরে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই।কিন্তু আমার আর্থিক অবস্হা স্বচ্ছল না থাকায় আমার একজন শিক্ষক বলেছিলেন ,তুমি জেলা কলেজ থেকে ইকোনিক্সে বিএ(অনার্স) করবে।পড়াশুনা করলে ভাল রেজাল্ট করবে।আর যেখানেই পড় ভাল রেজাল্টটি জরুরি।তার পর আমি পড়াশুনা করে অনার্স ও মাষ্টার্সে বেশ ভাল করলাম।আমাদের কলেজ ম্যানেজমেন্ট আমাকে আর কোথাও যেতে দেন নি।এখানেই জয়েন করলাম।প্রভাষক মহাশয় রতনকে বললো আমি তোমাকে পড়াশুনায় সহযুগিতা করবো।তোমার মধ্যে যতপ্রকার সংকোচ আছে সব ঝেড়ে ফেলে পড়াশুনায় বসে যাও।রতন ভর্তি হয়ে গেল ইকোনোমিক্সে। ইকোনমিক্সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে মাষ্টারস এ ভর্তি হলো।মাষ্টার্সে ভর্তি হওয়ার আগে বাবা মা'কে বললো,প্রভাষক স্যার আমার পড়ালেখায় অনেক সহযুগিতা করেছেন।আমি যত বড়ই হই উনাকে ভুলতে পারবো না।মাষ্টারসের শেষের দিকে, এমন সময় নিউজ পেপারে দেখলো এমেরিকা ডিবি লটারি ছেড়েছে।চুপি চুপি কাউকে না জানিয়ে ফর্ম পূরন করে পাঠিয়ে দিল।মাষ্টার্স পরীক্ষা দিচ্ছে এমন সময় তার বাড়ির ঠিকানায় একটি চিঠি এলো।রতনের বাবার কাছে চিঠি আসলে তার বাবা চিঠিটি না খুলে রতনকে দিল।রতন চিঠি খুলে বাবাকে বললো,বাবা পড়ে দেখ।বাবা মা পড়লেন কিন্তু তেমন খুশি হলেন না।কারন হলো তাদের পাশের গ্রামের একটি পরিবারের কামাল নামের একটি ছেলে ছোট বেলা থেকে মেধাবি ছিল।বাবা মা তাকে প্রকৌশলি বানিয়েছেন।বুয়েট থেকে পাশ করেছে।সে বিবাহ করেছিল তারই গ্রামের একজন যিনি ঢাকায় ওয়াপদাতে চাকুরি করতেন তার মেয়ে।ঐ মেয়েটি ডিবি পেয়ে এমেরিকা গিয়েছিল।পরে তার স্বামি প্রকৌশলী কামালকে নিয়ে গেল।কিন্তু কামাল ওখানে ভাল কোন কাজ পেল না।দীর্ঘদিন কাজ না থাকায় স্বামি স্ত্রীর মধ্যে কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়।এক পর্যায়ে তারা দু'জন থেকে পৃথক হয়ে যায়।প্রকৌশলী কামাল ভারতীয়দের একটি মেছে উঠে।এদিকে তার কাছে তেমন কোন টাকা পয়সা ও নেই।মাসের শেষে মেছের খরচ না দিতে পারায় ভারতীয়রা একদিন রাতে জিরো ডিগ্রি হিমান্কের নিছে এমন তাপমাত্রায় তার জিনিস পত্র সহ বাইরে বের করে দেয়।প্রচন্ড ঠান্ডায় যখন সে থর থর করে কাঁপছে,এমন সময় টহল পুলিশের দৃষ্টিতে আসে।তারা তাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়।হাসপাতাল কতৃপক্ষ তার শারিরিক বিপর্যস্ততা ও কর্মক্ষমতা না থাকায় সরকারি সহযুগিতায় দেশে পাঠিয়ে দেয়।দেশে এসে এক সময়ের প্রানচন্চল ছেলেটির স্হান হয় তার গ্রামের বাড়িতে।শারিরিক অসুস্হতা ও বিপর্যস্ততায় থেকে বছর দেড়েক পর একদিন পৃথিবি থেকে চলে যায়।রতন সব ঘটনা শুনে বললো,বাবা আমাকে তোমরা অনুমতি দাও।আমি পড়ালেখা জানি।সেখানে গিয়ে নিশ্চই ভাল কিছু করবো।এদিকে যাওয়ার আগে প্রভাষক সাহেবকে ঘটনাটা খুলে বললো।প্রভাষক সাহেব রতনকে বললো,তোমার ইচ্ছে কি? রতন বললো,স্যার ডিবি যখন পেয়েছি পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেয় এমন দেশটি ঘুরে আসি।প্রভাষক সাহেব রতনকে বললেন,ঐ দেশটির সামাজিক অবস্হা ঠিক আমাদের মত নয়।নিজের ব্যাক্তিত্বকে ঠিক রাখবে। কাগজ পত্র ঠিক করে রতন চলে গেল এমেরিকায়।সেখানে গিয়ে তার অনুমান হলো নিজের সমাজ সম্পর্কে।মানুষের মধ্যে কোন মমত্ব নেই শুধু কাজ আর কাজ।প্রতিবেশিদের সাথে দেখা হলে কোনভাবে সুপ্রভাত! কেমন আছ বলেই বিদায়।দেশের মানুষ হলেও চা চক্রের মত কোন আপ্যায়নে কোন আমন্ত্রন নেই।স্বামি স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনেও বাধা।স্বামি যখন বাসায় ঢুকে স্ত্রী তখন তার কর্মক্ষেত্রে চলে যায়।এভাবে কত পরিবার যে জীবনের সামান্য পাওয়ার আশায় স্বপ্ন দেখছে।সব কিছু ছকছকে মনে হলেও দেশটি যে পৃথিবীকে শোষন করছে তা রতনের অনুমান হয়।তারা যে সভ্যতার দোহাই দেয় সামাজিক অবস্হা দেখে তার অনুমান হয়েছে তারা কি রকম সভ্য? যে সমাজে ব্যাভিচার ও মাদকের ব্যাবহার প্রকট সে সমাজ সভ্য হয় কি করে? রতন কয়েক বছর থাকতে বাধ্য হলো।পড়াশুনার ইচ্ছা থাকলেও করতে পারেনি।একটি হোটেলে কাজ পেয়েছে।রোজগার ভাল হলেও কাজটি ভাল নয়।হালাল খাবার পাওয়া খুবই দুষ্কর।শুকরের মাংস আর পানীয় দ্রব্যের সেখানে সমারোহ।রতন এমেরিকার সামাজিক অবস্হা পর্যালোচনা করেছে।সেখানে অবিবাহিত মহিলার একটি বিশাল অংশ স্বামি পাচ্ছে না বিবাহ করার জন্য।ছেলেদের বিরাট একটি অংশ মাদক সেবন করে। সেখানকার সংসদে বিল পাস হয়েছে সমকামি বিবাহের।রতন মনে মনে বলে এটি কোন সমাজ? এটি তো লুত আ: এর সম্প্রদায়।সমাজের এই অন্ধগলি থাকলেও তাদের কাছে কিছু মানবতা রয়েছে।বিপদে পড়লে সোশাল সিকিউরিটি রয়েছে যা থাকার দরকার ছিল মুসলিম দেশে।যারা কষ্ট করে শিক্ষা গ্রহন করতে চায় করতে পারে।সরকারের পক্ষ থেকে ক্রেডিট দেয় আবার চাকুরি হলে কেটে নেয়। রতন সিদ্ধান্ত নিল এই পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে হবে।আল্লাহ ব্যাভিচারের জন্য কখন এই সমাজকে ধংস করেন তা বলা যাবে না।
দেশের প্রতি তার ভালবাসা বেড়ে যায়।তার কলেজের প্রভাষক মহাশয়ের সাথে যোগাযোগ করে ও বিস্তারিত বলে।প্রভাষক মহাশয় ততদিনে কলেজের প্রিন্সিপাল।তিনি বললেন চলে আস তোমার জন্য আমার কলেজে একটি পদ না থাকলেও আমি সৃষ্টি করবো।রতন চলে এলো এমেরিকা থেকে।বাড়ির অবস্হা গত কয়েক বছরে বেশ ভাল হয়েছে।বাবা মা বললেন,রতন আমরা একটি মেয়ে দেখে রেখেছি তোমার পছন্দ হলে বিয়ে দিতে চাই।রতন মাথা নিচু করে বসে রইলো।রতনের মা বললেন,রতন তুমি এমেরিকা ঘুরে আসলে এখনো আগের মতই সংকোচে মাথা নিচু করে আছ।রতন উত্তর দিল, মা আমি এমেরিকা থেকে এসেছি ঠিক কিন্তু এই সংকোচটিই আমার জীবন চলার পথে সাহায্য করেছে।তোমরা যদি সেদেশের অবস্হা চোখে দেখতে তাহলে অনুমান করতে পারতে আমরা কত ভাল আছি।আমাদের টাকা পয়সা না থাকতে পারে,আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সামাজিক কাঠামো।আমরা একে অন্যের সাথে হৃদয় দিয়ে মিশতে পারি।একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি।আমাদের কাছে একটি মহৎ অন্তর আছে কিন্তু তাদের সেই অন্তরটি নেই।রতন কলেজে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে গেল।প্রাক্তন প্রভাষক ও বর্তমান প্রিন্সিপাল সাহেব রতনকে দেখে বললো,আমার সোনার ছেলে দেশে এসেছে।শিক্ষকদের একটি সভা ঢেকে বললো , আগামি কাল থেকে রতন আমাদের ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টে জয়েন করবে।প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন,রতন চল তুমি লান্চ করে যাবে।রতন তাই করলো। বাড়িতে গিয়ে মা'কে খবর দিতেই মা বললো,বাবা আমি চেয়েছিলাম তুমি আমার কাছেই থাকবে।আল্লাহ আমার আশা পূরন করেছেন।রতন এমেরিকা গেলে তার বাবা প্রাক্তন প্রভাষক সাহেবের সাথে মাঝে মাঝে দেখা করতে যেতেন।প্রভাষক সাহেবের পরিবারের সদস্য সম্পর্কে শুনেছেন।একটি মেয়ে আছে জানলেও সংকোচে বলতে পারেন নি,কি জানি প্রভাষক সাহেব কিছু বলে ফেলেন কিনা।তবে প্রভাষক সাহেবকে বলতেন,আমার ছেলে যাওয়ার সময় আপনার খুব প্রশংসা করেছে।তাছাড়া আপনি তার পড়াশুনায় সাহায্য করেছেন এটি আমরা ভুলবো কিভাবে? কথায় কথায় প্রভাষক সাহেবকে রতনের বাবা বললেন,আমি যেমন রতনের একজন অভিভাবক আপনিও তেমন।আপনি রতনের জন্য একটি মেয়ে দেখে দিন যেন তার জীবনটা সুন্দর হয়।প্রভাষক সাহেবের মেয়েটি ছেলের ছোট।ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় বর্ষ অতিক্রম করেছে।রতনের বাবা মা একদিন ভয়ে ভয়ে গিয়ে বাসায় হাজির।রতনের মা মেয়েকে দেখে খুব পছন্দ করলো।মেয়ের মাকে বললো আমি আপনার মেয়েকে বউ করে নিতে চাই।তারাও অমত করলো না।প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন তবে রতনকে জানাবেন না।সে যদি মেয়ে দেখে পছন্দ করে আর মেয়েও পছন্দ করে তখনি বিয়ে পাকাপাকি হবে।এভাবে কথা ঠিক হয়ে রইলো। রতনের বাবা মা বললো,চল আগামি কাল আমরা একটি মেয়ে দেখতে যাবো।পছন্দ হলে বিয়ে পাকাপাকি করে আসবো।রতন আসার সময় বিয়ের ভাবনায় কিছু কেনাকাটা করে এসেছিল।মাকে সেগুলো দিল।একটি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে আসা হলো।প্রভাষক সাহেবের বাড়ির দিকে যেতেই মা'কে বললো এতো স্যারের বাড়ি।মা বললেন,হাঁ তোমার স্যারের মেয়েটি আমাদের পছন্দ হয়েছে।রতন বললো ,মা আমার সংকোচ লাগছে আর স্যারের মেয়ে আছে তো আমি জানিই না।মা তার বাবাকে বললেন,দেখোতো ছেলের কান্ড! দেশ বিদেশ ঘুরে এসেও আমার ছেলের সংকোচ এখনো কাটে নি।রতন বললো মা এবার শেষ সংকোচটি কেটে গেল।মেয়ে দেখে রতনের পছন্দ হলো ও ধূমধামে বিয়ে হয়ে গেল।
বিষয়: বিবিধ
১৯৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন