মায়ের অশ্রু বৃথা যায় না।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৫ নভেম্বর, ২০১৫, ০৯:৩৪:০৮ রাত
বিলের পাশে গুচ্ছগ্রাম।এই গ্রামে রয়েছে বিশটি পরিবার।তার মধ্যে ফকির আলি একজন।ফকির আলি তার বাবার কিছু বিষয় সম্পত্তি পেয়েছে।হাড় ভাংগা পরিশ্রম করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন।একটি পুত্র সন্তান ফকির আলি দম্পতির।বিলে একটি ফসল ফলে।বর্ষায় বিল পানিতে ভরে যায়।মাছের চাষ হয় তাতেও কিছু আয় হয়।দারিদ্রতা এই গ্রামের মানুষদের নিত্য সংগী।ফকির আলির পুত্রটি শৈশবে হারায় তার মাকে।বাবা তার ছেলেটিকে কোলে পিঠে করে বড় করে তোলে।নিজের অর্জনে একটু একটু করে কিছু সম্পদ আহরন করে।জীবনের টানাপোড়েন থাকলেও পৈতৃক সম্পদ হাতছাড়া করেন নি।একমাত্র পুত্রটিকে তেমন পড়ালেখা করাতে পারেন নি।সে গ্রাম থেকে অনেক দূরে স্কুল থাকায় পাঠানো যায় নি আর ছেলেও পড়ায় ছিল অমনযোগী।নিজে যতটুকু পেরেছেন নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন।একমাত্র পুত্রটি যৌবনে পদার্পন করে গ্রাম্য কবি ও পালাগানের লোকদের সাথে বাউন্ডুলে জীবনে পদার্পন করলো। যখন বাউন্ডুলে জীবন যাপন করা শুরু করলো তখন পিতা বিয়ে দিয়ে দেন গ্রামেরই একটি পরিবারে।গরীব হলেও অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্র পরিবার।বিয়ের পরও ছেলেটির ঘরে মন বসতো না।ছেলেটি বৃদ্ধ পিতার তেমন খবর রাখতো না।ছেলে বউ তার একাকিত্ব কাটিয়ে উঠতে কিছু স্বপ্নের জাল বুনে।বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে।স্বামির ভালবাসা ও মমতার অভাব যেন তাকে বিড়ম্বিত না করে সেজন্য হাতে নেয় কিছু কাজ। একদিন ছেলের বউ ফকির আলিকে বলে বাবা বাড়িতে আমি কিছু কাজ করতে চাই।ফকির আলি বলে কি করবা।পুত্র বধুটি বললো,আমি বাড়ির যায়গা জমিন গুলো খালি দেখতে চাইনা। বাড়িতে গাছপালা ও তরুলতা লাগানো,হাসমুরগী ও গরু ছাগল পালনের কাজ শুরু করতে চাই।ফকির আলি বলে মা,খুব ভাল কথা।আমি তোমাকে সব ব্যাবস্হা করে দিব তবে আমার তো এখন আর কাজ করার সেই শক্তি নাই।ছেলের বউ বললো,আল্লাহ সাহায্য করলে আমি একাই করতে পারবো।বাড়ির পাশে ছিল কয়েকজন গরিব মেয়েছেলে।ফকির আলির ছেলের বউ তাদের সাহায্য নিল কাজে।যা উৎপাদিত তা থেকে তাদের খরচ দেয়। অল্প দিনেই ফকির আলির সংসারটি যেন আগের মত আলোকিত হয়ে উঠলো।ফকির আলির ছেলেটি মাঝে আসে আবার কোথায় চলে যায়।প্রথম প্রথম ফকির আলির ছেলের বউ তার স্বামিকে কিছুই জিজ্ঞাসা করতো না।একদিন বলে,আপনি আমাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছেন। ঘরে ছাওয়াল এসেছে।আমাদের একা রেখে কোথায় চলে যান।আবার কিছুদিন পর ফিরে আসেন।আমি একা কিভাবে সংসারের হাল ধরে রাখবো।ফকির আলির ছেলে বলে,বউ দুনিয়াটা বিচিত্র।ঘুরে ঘুরে এই দুনিয়ার রুপ রং দেখে দেখে আমার সময় কাটে।গ্রামে গন্জে বিচিত্র মানুষ দেখে ঘরে মন বসে না।এই দুনিয়া দুই দিনের।শুধু শুধু মায়ামমতা করে লাভ কি।একদিন সবাইকে চইলা যাইতে অইবো। বউটি বলে আপনার কি সংসারে কোন মন নাই? ফকির আলির ছেলে বলে আচ্ছা বউ, সংসারে যদি মন না-ই থাকে তাহলে মাঝে মাঝে কেন আসি? আমার কয়টি ছাওয়াল দেখেও তুমি বুঝ না।বউটি বলে,শুধু ছাওয়াল জন্ম দিলেই বাপ হয় না,সংসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়,তাদের খাওন পরনের যোগান দিতে হয়।ফকির আলির ছেলে বলে,আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহ কাউকে না খাওয়াই রাখে না।কয়েক বছরের মধ্যে ফকির আলির নাতি নাতনি লকলকে হয়ে বেড়ে উঠলো।এদিকে ফকির আলির শারিরিক অবস্হাও ভাল যাচ্ছে না।দূরে হাঁটা হাঁটি করা বা সংসারের কোন কাজ করার সামর্থ তার নেই।পুত্র বধুটি সংসারের ঘানি টেনে আসছে একা।কয়েকটি শিশুর লালন পালন,সংসারের অন্যান্য কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছে।ছেলেটি একটু বড় হয়েছে।সে বাড়ির উৎপাদিত দ্রব্য কাছের হাঁটে বিক্রয় করে টাকা মা'র হাতে এনে দেয়।কিছু খরচ হয় বাকিটা জমা হয়।সারাদিন খাটুনির পর ছেলে মেয়েদের খাইয়ে রাতে নামাজ পড়ে গুন গুন করে অশ্রু ফেলে ফকির আলির ছেলের বউ।মায়ের রোজ কান্না দেখে ছেলেটি ঘুম থেকে উঠে মায়ের চোখের আপনি মুছে দেয় আর বলে ,মা তুমি কাঁদবানা আমি তোমার সব দু:খ দূর করে দিব।মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে বাবা আমার,আমি তোমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি।আল্লাহর কাছে স্বপ্নের কথা বলি। আমাদের অনেক যায়গা জমিন হবে,হালের গরু হবে,মাঠে গভীর পানির কল হবে,বাড়িতে দালান হবে,তোমরা সবাই স্কুলে যাবে,বড় শিক্ষিত হবে।ছেলেটি বলে মা,আমি তোমাকে সব কাজে সাহায্য করবো।ফকির আলি এখন আর চলাফেরা করতে পারে না।ছেলে বউয়ের সংসারের খাটুনি দেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করে আর বলে,মা আমি দেখে যেতে হয়তো পারবো না,আল্লাহ তোমাকে অনেক বড় করবে।তুমি সংসারের হাল না ধরলে এই সংসার থাকতো না।আমার এই বৃদ্ধ অবস্হায় কোন সহায় থাকতো না।তুমি ছবর কর।ছেলে বউ তার শ্বশুরকে বাড়িতে আসার পর নিয়মিত পরিচর্যা করে আসছে।এভাবে কেটে যায় কেয়ক বছর।ফকির আলির ছেলের কোন খবর নেই।ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে।স্কুল একটু দূরে হলেও স্কুলে যাচ্ছে।ছেলেটি সংসারের কাজ কর্ম দেখাশুনা করেও প্রাইমারি বৃত্তি,জুনিয়র বৃত্তি নিয়ে এসে এসসিতে ভাল করেছে।এবার কলেজে পড়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হলো।বহু বছর পর একদিন ফকির আলির ছেলে বাড়িতে এসে উপস্হিত।সংসার ও ছেলে মেয়ের উন্নতি দেখে ফকির আলির ছেলে কান্নায় ভেংগে পড়লো।বউয়ের কাছে অতীতের কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলো।বৃদ্ধ পিতার প্রতি অবজ্ঞার জন্য পিতার পায়ের কাছে গিয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো।ছেলেটি তার পিতার সামনে এসে বলে,বাবা বলুনতো আপনি আমার মায়ের জীবন থেকে কতগুলো বছর কেড়ে নিয়েছেন।আপনি আমাদের সবাইকে ভুলে থেকেছেন।আমার মা সারাদিন খেটে আমাদের খাইয়ে ঘুমিয়ে দিয়ে প্রতি রাতে আল্লাহর কাছে অশ্রুপাত করেছেন।আমি রোজ রাতে তা নিজের চোখে দেখেছি।মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব কি আমি পড়েছি।আমি চেষ্টা করেছি আমার মা'কে খুশি রাখার জন্য।আল্লাহ তার রহমতের সুধা দিয়ে প্রতিটি মাকে সৃষ্টি করেছেন। মা শব্দটি মানুষ মাত্রেরই প্রিয়। তাদের বানিয়েছেন করুণার আধার হিসেবে। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা, করুণা মমত্ববোধ আল্লাহর অশেষ কুদরতেরই নিদর্শন। এটি শুধু মানুষ নয় প্রাণিজগতের সব প্রাণীর জন্যও এক সাধারণ সত্যি। এ জন্য আল্লাহ এবং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর মায়ের হক বেশি। একাধিক হাদিসে এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল 'ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি সর্বাগ্রে কার সঙ্গে সদাচরণ করব? রসুল (সা.) বলেন, তোমার মায়ের সঙ্গে। লোকটি প্রশ্ন করল, তারপর? উত্তর এলো তোমার মা। লোকটি আবার জানতে চাইল অতঃপর কে? রসুল (সা.) এবারও জবাব দিলেন তোমার মা। ওই লোক চতুর্থবার একই প্রশ্ন করলে রসুল (সা.) বলেন, তোমার পিতা।' (বোখারি ও মুসলিম)রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশবে তার জননীকে হারান। জননীর প্রতি দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য তার সেভাবে হয়নি। আবু দাউদ শরিফের হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন তার দুধমা বিবি হালিমা আসতেন তখন তিনি তাকে দেখামাত্রই সম্মান জানিয়ে ওঠে দাঁড়াতেন। নিজের পাগড়ি অথবা গায়ের চাদর বিবি হালিমাকে বসার জন্য পেতে দিতেন। মায়ের প্রতি সদাচরণ সন্তানের জন্য অবশ্য পালনীয়। আল্লাহর কাছে মায়ের মর্যাদা কেমন তা প্রকাশ পেয়েছে বায়হাকি শরিফের হাদিসে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মায়ের দোয়া অতি দ্রুত আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। আল্লাহ বান্দার সব গোনাহ ইচ্ছমতো ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু মাতা-পিতার অবাধ্যতার গোনাহ আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। বরং ওই অবাধ্য সন্তানকে এই পার্থিব জীবনের মৃত্যুর আগে শাস্তি দিয়ে থাকেন। (বায়হাকি)।মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। মায়ের অবাধ্য সন্তানকে আখিরাতে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। আলকামা নামক এক সাহাবি মারা যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে তার জবান থেকে কালেমা বের হচ্ছে না। খবর পেয়ে রসুলুল্লাহ এলেন এবং তিনি আলকামার মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি পুত্রের ওপর অখুশি? উত্তরে তিনি বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমার ছেলে আমার চেয়ে তার স্ত্রীকে বেশি গুরুত্ব দিত। এ কারণে আমি তার প্রতি নারাজ। তখন রসুলুল্লাহ হুকুম দিলেন, আলকামাকে আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দাও। আলকামার মা এ কথা শুনে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমার চোখের সামনে আমার সন্তানকে আগুনে জ্বালিয়ে দিলে আমি মা হয়ে কেমন করে তা সহ্য করব? রসুলুল্লাহ সা: তখন আলকামার মাকে অনুরোধ করলেন, তাহলে আপনার সন্তানকে ক্ষমা করে দিন। তা না হলে অনন্তকাল ধরে সে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। তা আপনি কী করে সহ্য করবেন? একথা শুনে মায়ের মন নরম হয়ে গেল, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করে দিলেন। তারপর আলকামার জবান থেকে কালেমা তাইয়্যেবা জারি হয়ে গেল এবং কালেমা পড়তে পড়তে ইমানের সঙ্গে আলকামা মৃত্যুবরণ করলেন।আমার মা'র দোয়ায় আমি ভাল রেজাল্ট করেছি। আপনার ফিরে আসা আমার মায়ের অশ্রুপাত ছাড়া কিছুই নয়।আল্লাহ আমার মায়ের দোয়া কবুল করেছেন।ছেলেটির পিতা বললো,বাবা আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও।আমি আর তোমাদের কাউকে কষ্ট দিব না।এই বলে জীবনান্দদাশের কবিতার ক'টি লাইন শুনালো-হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,সিংহল সমুদ্র থেকে নিশিথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি।বিন বিশর অশোকের তুষার জগতে সেখানে ছিলাম আমি,আরো দূর অন্ধকারে বিদর্প নগরে আমি ক্লান্ত প্রান এক।চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সপেন।আমাকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।'
বিষয়: বিবিধ
২৩০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন