একজন মুক্তি যুদ্ধার গল্প।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৫ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৪৮:১৬ বিকাল
১৯৭১ সালের প্রথম প্রহর।আমার পাশের বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু ভাইয়ের বাড়ি।টগবগে যুবক লম্বাচূড়া গড়নে।পরিবারের ছোট ছেলে।কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যলায়ে যাবে এমন সময় ডাক এলো যুদ্ধে যাওয়ার।কবি হেলাল হাফিজ তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামক কবিতায় লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।বাচ্চু ভাইকে দেখে আমার তা-ই মনে হয়েছিল।এক ঝাঁক তরুনকে বোমার মুখোমুখি হওয়ার আনন্দে উৎসারিত দেখে আজ বৃদ্ধের কোঠায় নিজেকে অসহায় মনে করছি।তারাই ছিল আসল দেশপ্রেমিক যারা নিজের জীবনকে বাজি রেখে দেশ ও মানুষকে আগলে রেখেছিল। আমাদের এলাকাটি ছিল অজপাড়াগাঁ ,যেখানে রাস্তাঘাট ভাংগাচুরা।শহর থেকে খুব সহজে যাওয়া যেতো না ঐ গ্রামগুলোর দিকে।মনে হচ্ছিল তারা নব জীবনের দিকে ধাবিত হওয়ার মনোবাসনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।আন্চলিক মুক্তি যোদ্ধাদের অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে উঠেছিল বাচ্চু ভাইয়ের বাড়িতে।আশে পাশের নির্ভরযোগ্য বাড়িতে ও অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখা হতো।উপজেলার প্রায় ১০টি গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের টিম দিন রাত পরিকল্পনা করতে থাকে।মুক্তিবাহিনীদের বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে দেয়।তাদের খাবারের নির্দিষ্ট কোন ব্যাবস্হা ছিল না।যখন যেখানে যেত মানুষ তাদের আপ্যায়ন করতো।ক্ষুধার্ত হয়ে যখন তারা কোন ঘরে আসতো তখন যা পেতো তা-ই গোগ্রাসে গিলতো। আমরা তাদের খাবার খেতে দেখে আশ্চর্য হতাম যেন কয়েক মাস তারা খাবার খায় নি কিন্তু চোখে মুখে হাসি। সে দৃশ্য যখন আমরা দেখতাম তারা বলতো নিশ্চই আমরা দেশ স্বাধীন করে ছাড়বো।কী তীব্র বাসনা ছিল তাদের কিন্তু তারা কি পেল? এভাবে যুদ্ধের দিনগুলো কাটে মুক্তিযোদ্ধাদের।তারা হাতছানি দিয়ে রাখে উপজেলাকে।যুদ্ধের এক একটি রাত আমাদের কাটতো ভীষন ভয়ে।দূর থেকে মর্টারের শব্দ আসতো।মনে হতো এই নাকি হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকে পড়েছে।কারো অসুখ হলে ডাক্তার ডাকা ছিল কঠিন ব্যাপার।আর গ্রাম্য ডাক্তাররা বাড়ির বাহির হতো না।বড় কোন অসুখ হলে শহরে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না।ঔষধ পথ্য ও খাবারের অভাবে কত মানুষ যে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে তার হিসেব নেই।যাদের ঘরে ছিল যুবতী ও কিশোরী মেয়ে তাদের চিন্তার অন্ত ছিল না।অনেক বাবা মা যুবতী মেয়েদের নিয়ে রাতে বাগানে কাটিয়ে দিত।শুধু যে হানাদারদের ভয় ছিল তা নয়,ভয় ছিল রাজাকার ও আলবদরদের।তারাই উঠিয়ে নিয়ে যেত মেয়েদের হানাদারদের ক্যাম্পে।সে কি অত্যাচার যার ভার সইবার ক্ষমতা ছিল না বাবা মা'দের।বাচ্চু ভাই ও তার বন্ধুদের দল দূরে গেলেও রাতে পাহারা দিয়ে রাখতো গ্রামকে।মনে হতো গ্রামের সব পরিবারগুলো তার আপন।নির্ঘুম দিন রাতে কখনো একটু সময় পেলে গাছের ছায়ায় চোখ বুজে নেয়ার মতই ছিল।
বিশ্রামযুদ্ধের দিনগুলোতে দেখতে পেয়েছি কিছু মানুষ মানুষের কত কাছে আবার কিছু মানুষ কাছের হয়েও অনেক দূরে।যুদ্ধ শেষ হলে দেশীয় শক্রুদের আর একটি যুদ্ধ শুরু হলো দখলদারিত্বের।অ-মুক্তিযোদ্ধারা , লোভী আওয়ামিলীগের একটি অংশ ঝাঁপিয়ে পড়ে সম্পদ আহরনে।মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ থেকে শুরু করে সুবিধাগ্রহনের যত পথ আছে তা কুক্ষিগত করার জন্য তখনকার সরকারকে নাস্তানাবুদ করার ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত জাসদের সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল অভিনব তবে দুর্বোধ্য। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সাংগঠনিক প্রভাব বিস্তারের চেয়ে জাসদ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংঘাতমূলক ভূমিকায় বেশি সক্রিয় ছিল। ফলে জনগণের সামনে জাসদের রূপ ধরা পড়ে ভিন্নভাবে। ব্যাপারটা এমনভাবে দেখা দেয়, যেন শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ের চেয়ে ক্ষমতা দখলই ছিল জাসদের প্রধান টার্গেট। বিপ্লবের স্বপ্নে আচ্ছন্ন জাসদ বেশ কিছু ভ্রান্ত কর্মসূচি হাতে নেয়, যেগুলোয় ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় লিপ্ত বুর্জোয়া দলের চরিত্রই প্রকাশ পায়। সিরাজুল আলম খানের চে’গুয়েভারা হওয়ার স্বপ্ন দলকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়। আর এ বিভ্রান্তির প্রাথমিক পর্যায় হলো, ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও। বুর্জোয়া সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে গোটা সমাজের চেহারা পরিবর্তন কখনো সম্ভব নয়। অথচ এটা জাসদ নেতারা উপলব্ধি করতে চাননি বা পারেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের জের হিসেবে হতাহত হলেন দলের বিপুলসংখ্যক কর্মী। আর গ্রেফতার হন সিনিয়র নেতারা। এ ঘটনার পর জাসদ আরও অভিনব রাজনীতিতে নামে। গঠন করে গণবাহিনী। গণবাহিনী গঠনের কারণ হিসেবে বলা হয়, যেহেতু ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, সেহেতু বলপ্রয়োগ করেই তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। মার্কসীয় এ ব্যাখ্যার আলোকে গণবাহিনী গঠন করা হলেও মার্কসীয় মতবাদকে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করেনি জাসদ। মহামতি মার্কস বলেছেন, ‘পুরাতন সমাজব্যবস্থার গর্ভে নতুন সমাজ রূপ লাভ করার পরই দরকার বলপ্রয়োগ। এর আগে নয়।’ ’৭৪ ও ’৭৫ সালের বলপ্রয়োগের মতো কোনো পরিস্থিতির জন্ম হয়নি। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় না, সঠিক বিপ্লবী ভাবধারা থেকে জাসদ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল? আর জাসদ গণঅভ্যুত্থানের যে চেষ্টায় লিপ্ত ছিল, সে পরিস্থিতিও তখন ছিল না। লেনিনের মতে, ‘অভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কোনো দলের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। সমাজের ক্রান্তিলগ্নে যখন পরিবর্তনকামী মানুষ তাদের অগ্রণী বাহিনীর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হবে তখনই অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি পেকে উঠবে।’ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাসদ গণঅভ্যুত্থানের যে চেষ্টা চালায় তাও বাস্তবানুগ ছিল না। বিপ্লবের পর্যাপ্ত উপাদান ও অনুকূল পরিস্থিতি তখন ছিল না। তবে ’৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এ উপমহাদেশে প্রথম সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সম্পর্কে পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি নেতা কমরেড ফরহাদ বলেছিলেন, ‘জাসদ এ ধরনের উদ্যোগ নেবে জানলে আমরাও সহযোগিতার হাত বাড়াতাম।’ এখানে আরেকটি রহস্য ছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে সিরাজুল আলম খান এক দিনের জন্যও আটক হননি। শুধু তাই নয়, ১৫ আগস্ট তিনি ছিলেন ভারতে। এর আগে তার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তিনি ঢাকা ছেড়েছিলেন। সিরাজুল আলম খান এ নিয়েও কখনো মুখ খোলেননি। জাসদ তৈরিতে ভারতের ভূমিকা ছিল বলে যে গুজব ছিল তা নিয়েও আজ পর্যন্ত কেউ কোনো কিছু স্পষ্ট করেননি। তাদের ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েও রহস্য ও হঠকারিতা ছিল। ’৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর জলিল, রব, কর্নেল (অব.) তাহেরসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির জন্য জাসদ ভারতীয় দূতাবাসে কমান্ডো হামলা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল হাইকমিশনারকে হাইজ্যাক করে দাবি আদায় করা। কিন্তু হাইকমিশনের নিরাপত্তারক্ষীরা সে হামলা তছনছ করে দেন। পাল্টা প্রতিরোধে ঝরে পড়ে জাসদের কয়েক কর্মীর প্রাণ। আটক হন অনেকে। সেই হামলাকারীদের একজন এখন আওয়ামী লীগের এমপি। শুধু হঠকারী কর্মসূচি নয়, দলে অভ্যন্তরীণ বিরোধও ছিল সেই শুরু থেকেই। সিরাজুল আলম খান রহস্যময় নেতা হিসেবে ঐক্য ধরে রাখেন। কিন্তু বিপর্যয় শুরু জিয়াউর রহমানের আমলে। ৭ নভেম্বরের ব্যর্থতায় ফাঁসি হয় কর্নেল তাহেরের। এর মাঝে ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট সরকার ঘোষিত পিপিআরের অধীনে জাসদ রাজনৈতিক অনুমোদন লাভ করে। একই বছর দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক গণবাহিনী বাতিল করা হয়। গণবাহিনী বাতিল, অ্যাকশনধর্মী তৎপরতা হ্রাস জিয়ার পদক্ষেপকে পরোক্ষ সমর্থন বলে প্রশ্নের সৃষ্টি করে।
১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে কলহ-বিবাদের মধ্যেও জাসদ কিছুটা সক্রিয় ছিল। নেতাদের জেলে রেখে দলের একটি অংশ ’৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু আ স ম রব কারাগার থেকে নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভও ব্যক্ত করেছিলেন। নির্বাচনে জাসদ ৯টি আসন পায়। ’৭৯ সালের শেষ দিকে দলে রাজনৈতিক বিরোধ চরমে। ’৮০ সালে জাসদ নেতারা দাদার ইঙ্গিতে ১৮ দফার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থনই বিপর্যয় বাধে। তা ছাড়া অস্পষ্ট পেটি বুর্জোয়া চিন্তাচেতনা তৎকালীন ছাত্র-যুব নেতৃত্বের কাছে রহস্যময় ঠেকে; যার পরিপ্রেক্ষিতে জাসদের যুব নেতৃত্ব প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানায়। এ ঘটনার জের হিসেবে ’৮০ সালের ১৪ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির ঝড় বয়ে যায়।’৮০ সালের সেই পরিস্থিতি নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আ স ম রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে তারা দুজন দুজনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করেন। এর কিছু দিন পর ৭ নভেম্বর জাসদ থেকে বেরিয়ে আসা নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ’-এর জন্ম হয়। এ ভাঙনে জাসদ রাজনীতির ভিত কেঁপে ওঠে। ভাঙন সম্পর্কে পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ‘ঢাকা’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘জাসদ ভাঙার কারণটা ছিল রাজনৈতিক। গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের নামে বুর্জোয়া তোষণকারী একটা ভুল রাজনীতি অনুসরণ করেছিল তারা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বললেও পরিচালিকা শক্তি শ্রমিক শ্রেণির পার্টির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়েছিল। আমাদের প্রথম সফলতা আমরা একটা ভুল রাজনীতি বর্জন করে সঠিক রাজনীতি অনুশীলনের চেষ্টা করছি।’জাসদ ভেঙে বাসদ গঠিত হওয়ার পর বাসদেও নেতৃত্বের বিরোধ দেখা দেয়। ’৮৩ সালের ৫ নভেম্বর দলের এক বৈঠকে খালেকুজ্জামান ভূইয়াকে পার্টির আহ্বায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আ ফ ম মাহবুবুল হককে নতুন আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। খালেকুজ্জামান ভূইয়া আলাদা আরেকটি বাসদের নেতৃত্ব দেন। ভাঙন সম্পর্কে বাসদের সাম্যবাদ গ্রন্থে বলা হয়, ‘খালেকুজ্জামান, মবিনুল হায়দার চৌধুরী বিশ্বাস করেন SUCI (Socielist unity centre of India) নেতা শিব দাস ঘোষ এ যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঠিক ধারণার বাহক। বাস্তব হলো দুই বাসদের মধ্যে টিকে আছেন খালেকুজ্জামান সমর্থকরা। ১৯৮০ সালের পর জাসদে শান্তি ছিল না। বিভক্তির পর দলে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেন হাসানুল হক ইনু, কাজী আরেফ আহমেদ, শরিফ নুরুল আম্বিয়া ও মার্শাল মণি। আর সে সময় আ স ম রব, মেজর (অব.) এম এ জলিল, শাজাহান সিরাজদের প্রভাব কমতে থাকে। আর জাসদের ওপর রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খানের প্রভাব প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে মেজর (অব.) জলিল রাজনীতি ছেড়ে আদম ব্যবসায় নামেন। আদম ব্যবসায় কিছু উন্নতি করার পর যোগ দেন হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে। সেখান থেকে বেরিয়ে আলাদাভাবে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব একটি দল গঠন করেন। একই সময় আ স ম আবদুর রব মাগুর মাছের খামার শুরু করেন। শাজাহান সিরাজ বাকি থাকবেন কেন! তিনিও ব্যবসা-বাণিজ্যের সন্ধানে নামেন। এভাবে কিছু দিন কেটে যায়। তারপর আবার রব ও শাজাহান সিরাজ রাজনীতিতে সক্রিয় হন। যথারীতি রবের পেছনে এসে দাঁড়ান সিরাজুল আলম খান। এক পর্যায়ে নেতৃত্ব নিয়ে রবের সঙ্গে ইনুর বিরোধ বাধে। রব আলাদা অবস্থান নেন। সিরাজুল আলম খান সমর্থন দেন আ স ম রবকে। রব ’৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে গঠিত সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন। এর আগে দলটি ভেঙে তৈরি হয় তিন জাসদ হয়- জাসদ রব, জাসদ সিরাজ, জাসদ ইনু। কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। ’৮৬ সালের নির্বাচনে ইনু ‘নির্বাচনে গেল যারা জাতীয় বেইমান তারা’ স্লোগান দিয়ে ১৫ দল থেকে বেরিয়ে আসেন। শাজাহান সিরাজ যান নির্বাচনে। এ ভাঙনে লাভবান হন হাসানুল হক ইনু। কারণ কাজী আরেফ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মার্শাল মণিসহ দলের মূল অংশ তার পক্ষে আসে। এমনকি শিরীন আখতার, ডা. মুশতাক হোসেন, নাজমুল হক প্রধানসহ ছাত্রলীগ আরেফ ও ইনুর প্রতি আস্থা রেখে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখে। পরে ডাকসু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐকমত্যে সুলতান মনসুরের সঙ্গে মুশতাক জিএস হন। এদিকে শাজাহান সিরাজের জাসদ ’৮৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে আরেক দফা ভাঙনের শিকার হয়। এবারের ভাঙনের জন্যও শাজাহান সিরাজকে দায়ী করা হয়। কারণ, শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। অন্যদিকে, মীর্জা সুলতান রাজা আলাদা জাসদ গঠন করেন। তার নেতৃত্বাধীন জাসদ মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে এরপর আরেকবার ভাঙে। জাসদের ভাঙাগড়া নিয়ে আশির দশকে অনেক লেখালেখি হয়েছিল। বিশিষ্ট লেখক আহমদ ছফা সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’-এ ‘জাসদের রাজনীতি একটি সেন্টিমেন্টাল মূল্যায়ন’ শীর্ষক নিবন্ধে দলীয় রাজনৈতিক ব্যর্থতা, হঠকারিতা ও সুবিধাবাদী নীতির জন্য মূল তিনজন নেতাকে দায়ী করেন। তিনি লেখেন, বহু তরুণের সম্ভাবনাময় জীবন ও রক্তের বিনিময়ে এই স্বনামখ্যাত ‘বিপ্লবী’ নেতারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। বিপ্লব ছেড়ে কেউ কেউ সরকারের দালালিতে নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন। আহমদ ছফা জাসদ রাজনীতির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সংযোগ ও সহমর্মিতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ আজকাল অনেক বুদ্ধিজীবী কথায় কথায় জাসদের সমালোচনা করেন। অথচ একালে তারাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে জাসদ কর্মীদের রাজনৈতিক তালিম দিতে এগিয়ে যেতেন। আমি যখন জাসদের সমালোচনা করি তখন মনে হয় আমার নিজের বুকে ছুরি চালাচ্ছি। এ ব্যর্থতা ও ভণ্ডামির জন্য তিন নেতা আ স ম আবদুর রব, মেজর (অব.) জলিল ও সিরাজুল আলম খানকে যদি খুন করতে পারতাম তাহলে নিজের এ অনুতাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতাম।’বাচ্চু ভাইদের মত একজনকেও দেখিনি কোন সনদ সংগ্রহ করার জন্য বা কোন লোভনীয় পদ গ্রহন করার জন্য এগিয়ে গেছে।যুদ্ধ শেষে বাচ্চু ভাই যখন দেখলো অ-যুদ্ধারা সব ভোগদখলের দিকে হাত বাড়িয়েছে তখন ক্ষোভে দু:খে তাদের সংগ ছেড়ে দিল।বাচ্চু ভাইয়ের পরিচিত একটি পরিবার ছিল।যে পরিবারের সাথে ছিল তার বিশেষ সখ্যতা।সে পরিবারের খোঁজ খবর নেয়া ছিল তার নিত্যদিনের কাজ।মাছ ধরা ছিল তার দিনের একটি সৌখিন কাজ।তখন খালে বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো।বাড়িতে যাওয়ার সময় সে পরিবারে কয়েকদিন খেতে পারে সে পরিমান মাছ দিয়ে যেতো।বলা যেতে পারে রক্ত সম্পর্কের মতই সম্পর্ক।যুদ্ধের কয়েকমাস পর পরিবারটি শহরে চলে যায়।পরিবারের বড় মেয়েটি ছিল বাচ্চু ভাইয়ের পছন্দের।কিন্তু কেউ কাউকে প্রকাশ করতে পারে নি।মেয়েটি উচ্চ শিক্ষিত হয়ে এক সময় বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়।এর পর থেকে শুরু হয় তার জীবনের আর এক অধ্যায়। তার সাথের মুক্তি যোদ্ধারা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে চাকুরি ও ব্যাবসায়ে প্রভূত উন্নতি করলেও বাচ্চু ভাইয়ের জীবনে কোন সমৃদ্ধি আসে নি।গ্রামের বাড়িতে নিভৃতে বসবাস করে নিজেকে একাকিত্বে রেখে দিল অনেকগুলো বছর।পরিবারের তাড়নায় বিয়ে হয় উপজেলার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে।একটি সন্তান আসে তাদের।মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা বাচ্চু ভাই অর্থসংকটে পড়ে যায়।সে কুল কিনার করতে পারে না কোথায় যাবে।ধীরে ধীরে জীবনের চলার গতি মোড় নেয় অন্যদিকে।নাওয়া খাওয়া ও জীবনের সুভ্রত জীবনের কোন বোধ নেই।কিছুদিন পর তার পরিবার ও চলে যায় বাবার বাড়ি চিরদিনের জন্য।এর পরের ঘটনা আরো ভয়াবহ।প্রচন্ড গরমের দিনেও মাথায় একটি ক্যাপ,পায়ে বুট জুতো,গায়ে কোট।ময়লা অপরিচ্ছন্ন একটি মানুষ ঘুরে বেড়ায় গ্রাম গন্জে।এক কথায় যাকে বলে পাগল।দেখতে পাগল কিন্তু কারো কোন ক্ষতি করে না।আমি ঢাকা থেকে গ্রামে গেলাম।আমাকে দেখে ছুটে এসেছে।ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।বললাম বাচ্চু ভাই,আপনি কি স্মরন করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরের দিন গুলোর কথা? কোন কথা না বলে চোখের পানি ফেলে বললো, আমি কি ঢাকা যেতে পারবো?তুমি কি বলতে পার শাহিনা এখন কোথায়? আমি বললাম উনি তো এখন অন্যগৃহে।বাচ্চু ভাই বললো,সবাই আমাকে পাগল বলে।আরো বলে পাগল মুক্তিযুদ্ধা।হাঁ আমি একজন পাগল মুক্তি যুদ্ধা।এর কয়েক মাস পর খবর পেলাম হাজিগন্জ থেকে রেলগাড়িতে উঠেছিল।প্রত্যক্ষ দর্শীদের মতে ট্রেন কিছুদূর যেতেই একটি ডোবায় জাম্প দেয়।সেখানেই তার ইহকাল সাংগ হয়।আমাদের দেশের প্রকৃত অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধাদের জীবনে রয়েছে বিচিত্র কাহিনী।যুদ্ধশেষে তাদের পুনর্বাসনের কোন পরিকল্পনা ছিল না আর ছিল না হাতে কলমে খুঁজে দেখা কারা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে।আমরা এখনো জানি না কারা এদেশের প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধা।যারা যুদ্ধের সময়ে এপারে ওপারে পালিয়ে বেড়িয়েছে তারা এখন নব্য কোটিপতি যারা প্রভুত্ব করছে ষোলকোটি মানুষের।শহিদ ও বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা তাদের ঘৃনা করছে,ধিক্কার দিচ্ছে ও করবে অনন্তকাল।
বিষয়: বিবিধ
২১৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন