উন্নত জীবনের আড্ডায় অন্যের উন্নয়ন সাধিত হতে পারে।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৪ নভেম্বর, ২০১৫, ০৮:১৬:০১ রাত

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সহ আমাদের দেশেও সভা ,সেমিনার ও আড্ডা হয়ে থাকে।যারা এ অনুষ্ঠানগুলো প্রযোজনা করেন তাদের থাকে বিভিন্ন উদ্দেশ্য।বিশেষ করে গত কয়েক দশক থেকে এক ধরনের ব্যাবসায়ীরা তাদের ব্যাবসায়কে সম্প্রসারনের নিমিত্তে এ অনুষ্ঠান গুলো করে থাকে যাদের মুল লক্ষ্যই হলো পুঁজিবাদকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা।কিন্তু আর এক ধরনের সেমিনার সিম্পোজিয়াম হয়ে থাকে যাতে থাকে বুদ্ধিবৃত্তির উন্নয়ন।এ শ্রেনীতে থাকে আলোকিত মানুষ বা সমাজের চৌকশ মানুষগুলো যারা আলো ছড়িয়ে দিতে চান।এ যে আড্ডার কথা বললাম, এটিকে অনেকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে কারন হলো, অধিকাংশ মানুষ একে ডেস্ট্রাকটিভ ওয়েতে নিয়ে যায়।এই আড্ডা শব্দের ইতিহাস অতি প্রাচীন।এর উৎপত্তি দ্রাবিড় অড্ডা শব্দ থেকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডার একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন।তিনি ৩০-৪০ এর দশকে অধ্যাপনা করতেন।দেশ বিভাগের পর তিনি দিল্লিতে চলে যান।সেখানেও তার ভাল লাগেনি।তিনি সেখান থেকে একটি চাকুরি নিয়ে নিউইয়র্ক চলে যান এবং কিছুদিন পর মারা যান।তিনি একটি বিখ্যাত তত্ত্ব রচনা করেছিলেন তা হলো ভ্যাগলোজি বা ভ্যাগ জিনিসের বিজ্ঞান।ভ্যাগলোজির বিষয় হলো এতে বাক্য থাকবে কিন্তু কোন অর্থ থাকবে না এবং অর্থহীন ভাবে বক্তৃতা দিতে হবে।অনেক আড্ডাতে এমনই হতে দেখা যায়।

বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের আড্ডা থেকে শিখার অনেক কিছু রয়েছে।জীবন বোধের বিকাশ সাধনে সাহিত্য কলা,বিজ্ঞান,সমাজ বিজ্ঞানের তত্ত,ইতিহাস ঐতিহ্য ও ধর্মের নিরেট আলোচনা হয়।সত্তর ও আশির দশকে এমন অনেক আলোচানায় আমরা যোগ দিয়েছিলাম যেখানে সপ্তাহ পূর্বে একটি অসাধারন সাহিত্য দেয়া হতো যা পড়ে আসতে হতো সদস্যদের।যেদিন আলোচনায় যোগ দিত সদস্যরা চমৎকার আলোচনায় শিখা হয়ে যেতো অনেক কিছু।আমি নিজে আজ লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এমন একটি বীজ বপন করে দেয়া হয়েছিল যার ফলেই লিখা সম্ভব হচ্ছে।তবে কিছু দু:খবোধ যে নেই তা নয়,জীবনের একটি সময় পারিবারিক টানাপোড়েনে জীবনের একটি বিশেষ অংশ কাজে লাগাতে পারিনি।তবে এমন একটি সময় আসলো, একজন কাছের বন্ধু আমার ঘুমন্ত প্রতিভাবে জাগিয়ে তুললো।একজন লেখক হঠাৎ করে গড়ে উঠে না।এর জন্য একটি সময়ের প্রয়োজন,যে সময়টি কাটবে পড়াশুনায় আর মিশবে ভাল ভাল মানুষের সাহচর্যে যেখানে রয়েছে গভীর জ্ঞান।মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ হয় গভীর জ্ঞানে।জ্ঞান আহরিত হয় বই পড়া ও বিদগ্ধদের মিলামিশায়।জীবনে যারা এই পরিবেশটি তৈরি করতে পেরেছেন তারাই সমাজে আলোকিত হয়েছেন।

জার্মানির মহাকবি গেটে বলেছেন,একজন মানুষ যখন একটি পাইন গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যায়,যাওয়ার আগের মুহূর্তে যে মানুষটি ছিল পরে সে একই মানুষ থাকে না।তার মধ্যে একটি পরিবর্তন সূচিত হয়।কারন পাইন গাছ হলো স্নিগ্ধ ,কোমল ও সুন্দর।বিশাল কিছুর সাথে যখন একজন মানব বা মানবীর সাক্ষাৎ হয় তখন সেই ,মানব বা মানবী বিশাল হতে বাধ্য।কেউ যদি দার্জিলিং গিয়ে থাকেন দেখবেন সেখান থেকে কান্চন জঙা পর্বতমালা দেখা যায় যদি আকাশ পরিস্কার ও স্নিগ্ধ থাকে।যারা সেখানে গিয়েছেন তাদের বর্ননায়,সে সময় প্রকৃতির এই লিলাভূমি অন্তরকে যে কি অভিভূত করে তা ভাবা যায় না।ভাল বা বড় কিছুর সামনে গেলে মানুষ ছোট থাকে না, বড় হয়ে যায়।সুন্দরের কাছে গেলে সুন্দর হয় আর কদাকারের কাছে গেলে কদাকার হয়।আমরা যখন এই আলোকিত ও বিকশিত ব্যাক্তিত্বদের সাহিত্য কর্ম পড়ি তখন অনুমান করতে পারি তাদের অন্তরকে।তাদের আবিস্কার করি, কত তীখ্ন তাদের লেখা যা বজ্রের মত সমাজকে আলোড়িত করে।আমরা যদি আমাদের মহানবীর জীবন চরিত পড়তে শিখি দেখবো আলোক বিচ্যুরিত হচ্ছে।মাত্র তেইশ বছরে সারা বিশ্বকে আলোকিত করেছেন যা কেয়ামত পর্যন্ত আলোক ছড়াবে। তেমনি কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে-নজরুল,রবীন্দ্রনাথ,প্লেটো,সক্রেটিস,এরিস্টোটল,শেখ সাদি,ওমর খৈয়াম, ইকবাল,মেক্ক্সিম গোর্কি,শেক্ক্সপিয়ার,মিল্টন,লিও তলেষ্টয় ও গেটে সহ এরকম কবি সাহিত্যিকদের ভাল লেখাগুলো পড়ি দেখবো, আলো বিচ্যুরিত হচ্ছে।আলোকিত মানুষ তৈরি হয় পড়ার মাধ্যমে।ডক্টর মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ ১৮টি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন।তার জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে লাইব্রেরিতে।শেখ সাদি একটি কবিতায় লিখেছেন,আমি একটি মাটির ঢেলা কুড়িয়ে পেলাম,নাকের কাছে নিয়েছি দেখি যে, মাটির ঢেলায় মিষ্টি অপরুপ গন্ধ।তিনি অবাক হলেন যে মাটির ঢেলা থেকে তো বিভৎস গন্ধ আসার কথা কিন্তু মিষ্টি গন্ধ কোথা থেকে আসে।তখন কবি মিষ্টির ঢেলাকে জিজ্ঞাসা করলেন,হে মাটির ঢেলা তোর গন্ধতো সুন্দর নয় কিন্তু তোর গায়ে এত সুন্দর গন্ধ এলো কোথা থেকে।মাটির ঢেলা বললো,ঠিক বলেছ কবি,আমার গায়ের গন্ধ এত সুন্দর নয় কিন্তু আমি যেখানে ছিলাম তার উপর ছিল একটি গোলাপের গাছ যেখানে চারদিকে আশ্চর্য গোলাপের গন্ধ।তাজা অবস্হায় গোলাপ আমার উপর পড়তো না,পড়তো যখন ঝরে যেত।আমার গায়ের উপর পড়তে পড়তে এমন হলো যে আমিই গোলাপ।'ভাল লেখকের,ভাল কবির,ভাল সাহিত্যিকের লেখা থেকে এভাবে গন্ধ বের হয় কিন্তু আমরা ক'জনই পড়ি বা পড়ে বুঝে থাকি।

মানুষের জীবন একটি অর্থে শেষ হয় যা চিরন্তন সত্য।আল্লাহ যখন যার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন তখনই মানুষ চলে যাবে।একটি কচ্ছপের জীবন চক্র তিনশত বছরের অধিক,একটি ফড়িং এর জীবন চক্র মাত্র দুই বা তিন বছর।হাদিস অনুসারে একজন মানুষের জীবন চক্র একশত বছরের মধ্যে।প্রতিটি জীবের কাছে তার জীবন চক্রটি অতি মুল্যবান।কেউ সময়গুলো কাজে লাগায় আবার কেউ লাগায় না।কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র দৈনিক তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে যে সৃষ্টি কর্ম সৃষ্টি করেছেন আমাদের অনেকের জীবনের সময়গুলো কাজে লাগালে ও আমরা অনেক কিছু করতে পারতাম।যে যত বছরই বাঁচুক তার জীবনের একটি ক্রিয়েটিভ টাইমফ্রেম রয়েছে।সে সময়ে উত্তীর্ন না হতে পারলে ভাল কিছু করা সম্ভব নয়।আমরা অনেকে ভাবি আমার জীবনে আর সময় নেই,কিছুই করতে পারলাম না।আসলে ঠিক নয়।যে মুহূর্তে আপনি এ কথাটি ভাবলেন সে সময়টিকে জীবনের মহেন্দ্রক্ষন ধরে নিয়ে যা আপনার কাছে আছে তা নিয়ে জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন, নিশ্চই কিছু করতে পারবেন।একসময় সাহিত্যিকদের একটি চমৎকার আড্ডা হতো যেখানে সাহিত্যমনারা থাকতেন।আমার মনে আছে আশির দশকের প্রথমে জাতীয় যাদুঘরের মিনি অডিটোরিয়মে 'সাপ্তাহিক স্মরনীয় বরনীয়' একটি অনুষ্ঠান হতো যেখানে বরেন্য সাহিত্যিক,সাংবাদিক,কলামিষ্ট,রাজনীতিক,বুদ্ধিজীবিদের এক একজনকে নিয়ে আলোচনা হতো।সভাপতিত্ব করতেন তখনকার যাদুঘরের ডিজি জনাব এনামুল হক।আমরা বন্ধুরা প্রতি সপ্তাহে সমস্ত কাজ বিসর্জন দিয়ে সেখানে উপস্থিত থাকতাম।এখন সে সমস্ত আলোচকদের সিংহভাগ পরপারে।দেশকে আলোকিত করার জন্য তাদের অবদান রয়েছে।কিন্তু একটি বিষয় না বললেই নয় যা ছিল একটি আড্ডার চমৎকার একজন বিশেষ অথিতির ভাষ্য-তিনি বলেছিলেন,আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তির অংশটি এখন ঝরে যাচ্ছে।নৈতিক পদস্খল হচ্ছে ব্যাপক হারে।এই নৈতিক পদস্খলনের কারন হলো আমাদের রাজনৈতিক ব্যাবস্হা।মোগল সাম্রাজ্য যখন ভেংগে পড়েছিল তখন সামাজিক অবস্হা ছিল করুন।ডাকাতি ,নৈরাজ্যজনিত দুর্বল অবস্হার কারনে ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশকে দখলে নিয়েছিল।উমিচাঁদকে লর্ড ক্লাইভ ঘুষ দেয়ার ভান করেছিল তিন লক্ষ পাউন্ড।লর্ড ক্লাইভ ছিল একটি ধূর্ত শাসক।পরে এই টাকা না দেয়ায় উমিচাঁদ পাগল হয়ে মারা যায়।সেই একটি সময় ছিল এ দেশের জন্য একটি ভয়ংকর সময়।লর্ড ক্লাইভ ভারত উপমহাদেশে শাসন কাজে তিনবার এসেছিলেন।প্রথমবার এসে অপরাধের এমন কিছু ছিল না যে তিনি করেন নাই।মিরজাফরের কাছে তিন লক্ষ পাউন্ড ঘুষ নিয়ে তাকে মসনদে বসিয়েছিল।ক্লাইভ প্রথমবারেই অপরাধ করেছিল।দ্বিতীয়বার এসে বললো কোন রকম অপরাধ করা চলবে না।ব্রিটিশ অফিসাররা নজরানা , ঘুষ খেত ও ব্যাবসা করতো।তিনি সব অপরাধ বন্ধ করে দিয়ে বললেন,তোমরা শুধু চাকুরির টাকা দিয়ে চলবে।তখন তার বিরুদ্ধে সেনা বিদ্রোহ হয়েছিল।তিনি দুইশত অফিসারকে এরেষ্ট করে ফেললেন।শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ব্রিটিশ অফিসাররা একটি ব্যাবসা করবে তা হলো লবনের ব্যাবসা যেটি ভারতীয়রা করতে পারবে না।মহাত্মা গান্ধি একটি আন্দোলনও করেছিলেন ,'লবন আইন অমান্য অন্দোলন।'বৃটিশরা দুইশত বছর টিকে থেকে ছিল তাদের আইনের শাসনের জন্য।তখনকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত ছিল,কাউকে যদি অন্ধকার রাতে মাঠের মধ্যে ভূতে তাড়া করে তাহলে কোনভাবে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠেবে।কারন ওটা ছিল ব্রিটিশের রাস্তা যেখানে গেলে মানুষ নিরাপদ।এটি ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন।ব্রিটিশ সরকার বড় রকমের অপরাধকে সহ্য করে নি।তবে ছোট খাট কিছু অপরাধ তারা করতে দিয়েছিল তাদের শাসন কার্যের সুবিধার খাতিরে।দারগাকে তারা ঘুষ খেতে দিত।কারন দারোগাদের দিয়ে তারা দেশ শাসন করতো।লর্ড মিকলে লিখেছিলেন,আমরা যদি সেদিন প্রমান করতে না পারতাম ব্রিটিশ সরকারের নৈতিকতা এদেশের সরকারের উপরে, তাহলে এত দূর থেকে এ দেশ আমরা শাসন করতে পারতাম না।'আমাদের দেশের আজকের অবস্হা দেখলে কি মনে হয় না,সেই উমিচাঁদ ,রায় দুর্লভ,জগৎশেঠ ও মীরজাফররা সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।যত রকম অপরাধ সম্ভব তা আমাদের স্বাধীন দেশে হচ্ছে।আমরা জনগন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।আমাদের দেশে যে সেমিনার ও আড্ডাগুলো হয়,শ্রোতাদের হাততালি দেখে সত্যিই মনে জাগে আমরা বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে কত দুর্বল।আমাদের সকলের দায়িত্ব দেশকে ভালবাসা ও দেশকে টিকিয়ে রাখা ও দেশের জন্য কাজ করা।আমাদের চরিত্রগুলো হয়েছে এমন একটি গল্পের মত,' একদিন এক লোক থানায় এসে দারোগা বাবুকে বললো,আমি ঘরে ঘুমাইতেছিলাম।হঠাৎ দেখলাম চোর ঢুকে আমার সব চুরি করে নিয়ে একটি থলেতে ঢুকাচ্ছে।আমি তবু তাকে কিছুই বলি না।আমি অপেক্ষা করে দেখলাম ঘরের আরো অন্যান্য জিনিস নিল তখনো আমি কিছুই বলি না।নিতে নিতে সব নিয়ে গেল এবং এক সময় আমার বিবিকেও নিয়ে গেল।আমি তবুও কিছুই বলি না দেখি চোর কি করে।আমাদের অবস্হা হচ্ছে তেমনই।আমরা জনগন সব তাকিয়ে দেখছি ও আড্ডাগুলোতে কথা শুনছি ও হাততালি দিচ্ছি।আমাদের আড্ডায় আনন্দ যেমন থাকবে তেমনি থাকবে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের অংগীকার।তাহলেই আড্ডা হবে একটি জীবন ঘনিষ্ট আড্ডা যা মানুষের উন্নয়ন ঘটাবে ও দেশকে সমৃদ্ধ করবে।

বিষয়: বিবিধ

১১১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File